১.
মেয়েটা চোখের সামনে দিয়ে সাঁই সাঁই করে চলে গেল। চুলে কি মেখেছে আল্লায়ই জানে। বিদেশি কোন কন্ডিশনার মেরে আসছে হয়তো। ভার্সিটির ওপাশের বাতাসও দোল দিয়ে গেল এক ঝটকা। রুমিন, রাইসুল ও আমি রিকশার জন্য ল্যাবের নিচে ওয়েট করছিলাম। রুমিন রাইসুলের দিকে একবার তাকিয়ে আমার দিকে চোখ ফেরাল। ওর চোখে রাগত ভঙি।
- আচ্ছা, তোমরা ছেলেরা এত লুইচ্চা হও কেন বলতো?
থতমত খেয়ে গেলেও আমি কোনমতে সামলে নিলাম। আরে দুর- কে দেখলো? রাইসুল? এই শালা একটা বদের বদ বুঝছিস। জুতা খুলে ওরে দুইটা দে। আমি ধরতেছি।
- শালা তুই কি আর কম যাস? তুই-ই তো গিলে খাচ্ছিলি ইতর কোথাকার। আচ্ছা তোমাদের কি আত্মসম্মানবোধ বলতে কিছু থাকেনা? মেয়ে দেখলে...?
আমি রাইসুলকে চোখ টিপে দিলাম এক সুযোগে। আচ্ছা স্যরি রুমিন। তুই এত হট হলে চলবে, বল? ঐ দেখ মামা এসে গেছে। এই মামা এই..... সাইলেন্সারে যাবা?
রিকশায় চেপে বসেও কটমট করে আমার দিকে তাকাতে লাগলো রুমিন। আমি ওর ক্রোধরশ্মি থেকে বাঁচার জন্য ভেতরে ভেতরে আঁকুপাঁকু করছি আর বেটা রাইসুল আশেপাশে তাকাতেই আছে। অথচ রুমিন ঐ বদটাকে না দেখে আমার দিকেই ঘটমট করে সব শাস্তি দিচ্ছে। আমি স্বভাবতই চোখ বন্ধ করে ধ্যানের একটা ভান করে ফেললাম। এরপর বিড়বিড় করে অং সরনং শান্তি অং শা--ন্তি.... অং...... করতে শুরু করে দিলাম।
অনেক্ষণ বাঁদরামি চালানোর পর মনে মনে ভাবছিলাম এই বোধহয় রুমিন ডাকুনীর শার্দুল দৃষ্টি থেকে বেঁচে যাচ্ছি। হঠাৎ করে টের পেলাম। রিকশা চলছে না। নিশ্চিত হলাম রুমিন আমার এই ফালতুগিরিতে বিরক্ত হয়ে নেমে গেছে। কিন্তু চোখ খুলে দেখি আসাদ কমিশনার সাহেব রিকশা থামিয়ে বাধ্য বালকের মতো আমার দিকে চেয়ে আছেন। আর রিকশাওয়ালার শরীর থেকে ঘামের স্রোতে প্যাডেল ভিজে গেলেও বেটা আমার উল্টাপাল্টা ফালতুমি এনজয় করে খেক খেক করে হাসছে।
- আমি চরি, আপনারে থামাইতে অইলো। আপনে কি পিলোচপি ডিপাটমেন্টের?(কমিশনার)
- জি।
- পিলোচপি মানে দর্চন না?
- জি।
- তাইলে আহেন আপনে। আপনার লগের দুইজনরে লয়া আইবার চান?
- স্যরি, কই যাব আমি?
- আরে চার ডরায়েন না। আমি গুম টুম করুম না। ঐডা আমার কাম না। র্যাবের কাম। এটটুক আমার লগে আন। কাম আচে।
যা বুঝার বুঝলাম। আর গাঁইগুঁই করে লাভ নাই। প্রাইভেটটা আজ মিস হবেই। এই পুরান ঢাকাই পাবলিক অতো ফর্মালিটি বুঝে না। অন্যের সময় আছে কি-না সেটা চিন্তা করার ফুসরৎ নাই উনার কাছে। দেখা যাক, কি হয়। কি আছে আজ কপালে আল্লাই জানে।
২.
আসাদ কমিশনারের বাসায় তো রমরমা অবস্থা। একদম সবকিছু আছে। তবে হাঁটাচলাই একটু যা মুশকিল। ড্রয়িং রুমে ২ সেট সোফা তাও জায়গা চাপাচাপি করে। পাশেই শো-কেস আর বিদেশী স্টাইলের বেশ কিছু জিনিসপত্র। এর মধ্যে আবার ডাইনিংয়ে বিশাল একটা ফ্রিজ। এর ভেতরে আমার মতো ৪/৫ টা ছোকড়াকে রাখা কোন ব্যাপারই না।
ফুলদানী গুলোতে কোথাকার কোন কোন দেশের লতাপাতা দিয়ে আচ্ছাদিত করে রেখেছেন ভদ্রলোক। এমনকি দেয়ালে শসার মতো কি সব শস্য দেখলাম। সে যাইহোক, আমার মাথায় এখনো বিস্ময়। কি এক অজানা কারণে এই লতাপাতা ফুলের ঘরে আমাকে আসতে হয়েছে। পেছনে মাথা ঘুরিয়ে দেখি রুমিন পেত্নিটার মুখে আশংকার ছায়া। হালকা মতোন একটা ভেংচি কাটলো যেন আমি ওর বিএফ এমন আরকি। আমিও হালকা মতোন চোখ টিপে সাধুবাধ জানাতে মোটেই দেরি করলাম না।
সব উৎকন্ঠার শেষ হলো যখন আমরা বাসার অপরপ্রান্তে কমিশনার আংকেলের শোবার ঘরে বরাবর গিয়ে পৌঁছুলাম। বসার জন্য আগেই কয়েকটা আরএফএলের ছোটখাট টুল রাখা আছে দেখে উনার ইশারায় বসে পড়লাম।
- আপনারে আমার দরকার আচে, বুঝচেন? এই খালেদার মা ৪ টা চা দিয়া যা....
- হ্যাঁ, আংকেল বলেন আমি কি করতে পারি আপনার জন্য।
- আমি কোন কথা চুনুম না। তুমি না করতএ পারবা না। আমার মাইয়া চুইটি.....
আমার বুকটা ধক ধক করে ওঠলো। এ কি শুনি। সাথে সাথে রুমিনের চোখেও ভয়ার্ত অবস্থা। কমিশনার আংকেলের মুখে তখন চুড়ান্ত বিরক্তির ছাপ। আমাদের দুজনের অবস্থা দেখে যারপরনাই বিরক্ত উনি।
- কি মনে করচেন আপনেরা। আমার মাইয়ারে বিয়া দিবার নাগচি? অপ যান, বুজচেন?
- স্যরি, আপনি পুরোটা কন্টিনিউ করেন।
- কন্টিনউ করতেচি। আমার মাইয়া চুইটিরে বিয়ার কথা কই নাইক্কা। চেরিটা পড়াচুনায় ভালা না। ও অনার্চে পড়তাচে পিলোচপি চাপজেক্টে। আপনে ওরে চময় দিতে পারবেন কি-না কন।
এই প্রথম একটা ফরমালিটি মেইনটেইন করছেন ভদ্রলোক। রুমিনের দিকে চোখ নিতেই ও চোখ টিপে মাথা বামদিকে নিয়ে বুঝিয়ে দিল না করে দিতে। আমিও অতশত না বুঝে না করে দিলাম।
ব্যাপারটা কমিশনার আংকেলের চোখে পড়েছে মনে হলো। যাইহোক, আমাকে ভাবার সময় দিতেই মনে হয় কমিশনার আংকেল কিছু না বলে ওয়াশরুমের দিকে ওঠে গেলেন।
চা নিয়ে আসার পর আমি চা খেতে খেতে রুমিনকে বললাম, কি করব? এই... মাস্টারির চাকরি ধরমু নাকি। হেঃ হেঃ হেঃ
- শালা বান্দর একটা। তোর যা ইচ্ছে তা কর। তোর লাইফ, তোর-ই ডিসিশন।
- হাঃ হাঃ হাঃ (মিচকা শয়তানি স্টাইলের) হাসি দিয়ে আমি বললাম এখানে লাইফের কোয়েশ্চন নিয়া আসলি ধ্যামড়ি?
- লাইফের একটা পার্ট না, ধর তুই বিয়ে করলি, এরপর টিউশনি করেই সংসার চালালি। মন্দ কী?
- তাইলে সিএসই পড়লাম কেন? ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে যদি মাস্টার হইতে হয় এ দুঃখ কই রাখি?(রাইসুল)
- সেটাই তো। এই রুমিন, এত এত মাথা গরম করলে জামাই নিয়া পরে চলবি ক্যামতে? ক দেখি বাবা!(আমি)
- আসছেন মিস্টার পারফেকশনিস্ট আমির খান।(রুমিন)
- এই আমার নাম আামির। জাস্ট আামির। খান পান টান কিচচু নাই।
- হইসে আর ...
এই মুহুর্তে আংকেল ওয়াশরুম থেকে ওজু করে বের হয়ে আসলেন। উনি জোহরের নামাজ পড়বেন সেটা বুঝা যাচ্ছে। চা পিলাইচো?
- হ্যাঁ আংকেল।
- আচ্চা, চোনেন, আমার মাইয়ারে ঠিকঠাক পড়াইলে মাসে দশ হাজার টাকা পাইবেন। আর ...
- আমার তো হুট করেই জানানোর মতো অবস্থায় নেই আংকেল। তবে..
- তবে টবে বুঝি না। আপনে পারবেন কি-না কন। না পারলে আমি অন্য মাস্টার ধরমু। পপলেম নাই।
- আচ্ছা কাল জানাই প্লিজ?
- উকে। কাইলকা আমার নাম্বারে ফোন দিবেন। বাসায় আহনের দরকার নাই। এই নেন আমার কাড।
- ঠিক আছে আংকেল বাসায় না এসে আপনার ফোনে রিং করব আমি। থ্যাংকিউ।
- উকে। টেনকিউ। আপনারা অহন আইবার পারেন।
৩.
রুমিন আমার ওপরে ক্রাশ খেয়েছে সেটা জানি। ঢের আগেই বুঝতে পেরেছি। ওর ব্যাপারে আমার চিন্তাধারা হইলো সে পারলে বলুক। আমি যে এমনিতেই একটা জিফের জন্য কাঙাল এই ইনফোটা কে না কে ওর কাছে পাচার করে দিয়েছে সে নিয়ে আমার সন্দেহ নাই।
কাল দুপুরের আগ পর্যন্ত ছিল ক্রাশ খাওয়া লাইফ। খালি ক্রাশ খেয়ে খেয়েই জীবনটা কাটাচ্ছিলাম। অবশেষে আজ মনে হচ্ছে শালার প্রকৃতি যেন মুখ তুলে তাকাইসে আমার দিকে।
আমি বেডে শুয়ে শুয়ে কালকের কমিশনার আংকেলের বাসার বড় গেট দিয়ে হেঁটে পার হবার দৃশ্যটি মনে করছি আর উষ্ণ উষ্ণ অনুভূতি নিয়ে চোখ বন্ধ করছি আর শিহরিত হচ্ছি একা একা। ব্যাপারটা ভাবতেই কেমন যেন অদ্ভুত ভাল লাগা কাজ করে।
আমাদের সামনে করোলা এক্স থেকে সে নামলো। ড্রাইভার গাড়ি গ্যারেজের দিকে নিয়ে গেল আর সে আমার সামনে এসে ক্যাটওয়াক ভঙিতে কোমড়টা আলতো নাড়া দিয়ে আমাদের ৩জনকে মখা বানিয়ে দ্রুতগতিতে বড় দরোজার দিকে এগিয়ে গেল।
ভার্সিটিতে যে সুশ্রী মনোহরীণী মেয়ের ওপর আমি আর রাইসুল ক্রাশ খেয়েছিলাম ঐ মেয়েটিই কি-না আমার ছাত্রী! ওফফ!! এই প্রাইভেট টিউশনি পাবার জন্য প্রয়োজনে সাইলেন্সারের ম্যাথ ক্লাশ বাদ দিয়েই দেব। একটু আগেই ফোন করেছিলাম কমিশনার আংকেলের কাছে কনফার্ম করার জন্য টিউশনিটা করানোর ব্যাপারে। কিন্তু পরাণ পাখি কল রিসিভ করে আমার মাত্রাজ্ঞানের বারোটা বাজাই ফেলছে। এত সুমিষ্ট, এতনা কিউট ভয়েস কোন মেয়ের হতে পারে বলে আমার জানা ছিল না। তাই রুমিনকে একটু চেতানোর জন্য আমি ফোন দিলাম।
- এই দোস্ত, কমিশনার আংকেলকে ফোন দিয়ে না করে দিয়েছি।
- সত্যি বলছো?(সে তুমি সম্বোধন সচরাচর করে না। কিন্তু এখন করছে....)
- তুই আমারে ভোদাই পাইছিস? এই আসমানী পরী'রে কোনভাবে মিসামু ভাবতে পারলি?(সেই.... আবারো তুই...)
- এই বান্দর! তোর গুড়ের বস্তায় বালি ঢেলে দিমু কিন্তু!! আমি কিন্তু কম গুটিবাজ না? হেঁএএ-
- এহ! কইলেই হইলো? তুই আমার দোস্ত না? দোস্ত কি এইসব ব্যাপারে বিট্রে করতে পারে??
- ঐ! কথা ঘুরাস ক্যান? তোর লুইচ্চামির বারোটা না বাজালে আমার নাম রুমিন না। শালা পড়িস ইঞ্জিনিয়ারিং আর ফিলোসফির মাস্টার হবি না?? তোর ঐ প্রাণসখীর নাম্বার আমি অলরেডি জোগাড় করে ফেলেছি। ওরে এখুনি ফোন দিয়ে সব বলে দিচ্ছি। তোর লুইচ্চামির সব হিস্টোরি আমি ওর কাছে ক্লিয়ার করে দিচ্ছি। শালা! তুই একটা মিচকা শয়তান।
- এই পাগলী, তুই এত বনু স্টাইলে কথা বলছিস কেন? একটু মাথাটা ঠান্ডা করে শোন দোস্তু। প্লিজ আমারে সুইসাইড করতে পাঠাবি না। আমি প্রাণ হারাব, মরেই যাব, বাঁচাতে পারবে না কেউ.....
- শালা ইতর কোথাকার। তুই তো একটা চিটার। মেয়েদের পটিয়ে তুই অন্য লাইনে হাঁটিস। তোর বেঁচে থাকার কি দরকার?
- শোন, তুই কিন্তু মেন্টালি টর্চার করছিস। আমি কেঁদেই দেব এখন। আর চিটার না টিচার হবে(!)
- দেখি কাঁদ। কাঁদ তো? শুনি একটু।
- সত্যি কাঁদবো?
- হ্যাঁ
- সত্যি?
- শালা তুই কি কাঁদতে পারিস? আমি জানি তো! জানি তোর ভেতর? তুই তো একটা পাষাণ।
- এ্যাঁ এ্যাঁ এ্যাঁ..
- হয়েছে হয়েছে। আর ইতরামি করতে হবে না। ইউটিউবের ট্যাবটা ক্লোজ করে আমার কথা শোন। আমি বোরিং ফিল করছি তোর ওপর।
(আমি কিছুই বলছি না। চুপ করে আছি।)
- তুই কি সত্যিই ঐ ফ্যাশন কুইনরে চাস?
- প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ, দোস্ত! একটা ব্যবস্থা কর। তুই যা চাস আমি দেব। প্লিজ হেল্প। প্লিজ।(অনুনয়)
- এরপর থেকে অন্য মেয়ের দিকে নজর দিবি কি-না বল?
- এই কানে ধরছি। (আসলেই ফোন লাউড অন করে কানে ধরেছি) আমি আর কখনোই কোন মেয়ের সাথে ফ্লার্ট করবো না। আল্লার কসম।
- বাহঃ তাইলে এইবার রিয়েল মনে হচ্ছে। তাইলে মামার হোটেলে বসে প্রোগ্রাম করতে হবে। তুই ফিলোসফি ডিপার্টমেন্টের বলেই তো বিপদে ফেলছিস শালা!
.......
রুমিন এত ভাল সেটা জানা ছিল না। সে যে আসলেই আমার একটা ভাল বন্ধু সেটা মাঝে মধ্যেই টের পাই। এমন একটা বন্ধু কি সবার কপালে জুটে? আমি পরম কৃতজ্ঞতা অনুভব করি ওর ওপর। সে যাইহোক, ব্রেকফাস্ট করে এখুনি আমি বেরিয়ে পড়বো, মিশন লাভ উইথ ফ্যাশন কুইন!!!!!! (চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই আগস্ট, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:৩৪