✍ শারদাংবেল
শারদাংবেল এমন একটি একটি গ্রামদেশ যেখানে অধিকাংশ মানুষের বয়স বিশের কম আর শিশুদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। ম্যানগ্রোভ বনের ধারে এই গ্রামের বিশেষ বৈশিষ্ট হলো ৪০ বছর ধরে এখানে সুর্য ওঠেনি। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় আধফালি চাঁদকে আলোর জন্য বন্দী করে রাখা হয়েছে।
যেহেতু চাঁদ গ্রামের এক প্রান্তে অবস্থান নিয়ে থাকে তাই চাঁদের আলোর সুষমভাবে জোছনা দিতে পারে না। পুর্বদিকটা বেশ ঘুটঘুটে অন্ধকার। আলোর জন্য কেউ কেউ মোমবাতি জ্বালায়।
শারদাংবেলে এমন মানুষের সংখ্যা মোটেও কম নয় যারা আজ পর্যন্ত ঝকঝকে সূর্যের আলো দেখতে পেরেছে। তাঁরা শুনেছে কেবল চাঁদের ওপরও নাকি আরো আরো অনেক কিছু আছে।
এ গ্রামদেশের প্রধান ফটকে দুটি বৃহৎ সংবিধান লেখা আছে। সব নাগরিককে এটা পড়তে দেয়া হয়। একটি সংবিধানে বলা হয়েছে কি কি করা যাবে। আরেকটি সংবিধানে লেখা আছে কি কি করা যাবে না।
একটি নিয়ম খুব কড়াভাবে মানা হয়, সেটি হলো- এই দেশে যে কেউ আসতে পারবে। কিন্তু যেতে হলে দেশরাজের অনুমতি নিতেই হবে। তা নাহলে আজীবন কারারুদ্ধ।
✍ হানাবিঃ
এই দেশে বালকের সংখ্যা অর্ধশতাংশেরও বেশি। এরা নীলদিঘী'র পাড়ে হানাবি ফুটায় যাতে অন্ধকার ভেদ করে আলো দেখা যায়। কিছু কিছু হানাবি আছে যেগুলো দীর্ঘসময় ধরে আকাশে থাকে। দেশের অনেকে তাকিয়ে থাকে, চাঁদের ওপরের অস্তিত্ব জানার চেষ্টা করে।
এখানে হানাবি ফুটানো নিয়ে বিস্তারিত বলা নেই। তবে হানাবি ফুটানোর অধিকার যে কারোর আছে এমনটি বলা আছে। আশংকার কথা হলো কয়েকটি বালক হানাবি ফুটাতে গিয়ে মরে গেছে।
✍ দেশরাজ
দেশের জনসংখ্যা কমে যাচ্ছে। শংকিত হয়ে পায়চারি করছেন দেশরাজ। তাঁর কপালে স্বল্পকালীন ভাজ পড়ে গেছে। সভাসদরা এটা পড়তে পারছেন। কারা যেন আতশবাজ বালকদের ঝোঁপ থেকে তীর ছুঁড়ে হত্যা করছে।
অনেক সভাসদ বলাবলি করছেন- দেশরাজ ছাড়া এ সংকটের সমাধান সহজ নয়। উনার হাতেই দেশের আয় উন্নতি নির্ভরশীল। উনিই পারেন জাতিকে এই সংকট থেকে উদ্ধার করতে। বালকদের হত্যা ঠেকাতে দেশরাজ অতূলনীয়। দেশত্রাতা'র ভুমিকার চেয়ে দেশরাজের ভূমিকাই এখানে কার্যকর।
কেউ কেউ ফিসফিস করছেন, দেশরাজের কপালের ভাঁজ ইচ্ছাকৃত।
✍ নীলদিঘীঃ
পূর্বদিকের আঁধারাচ্ছন্ন নীলদিধী'র পাড়ে বসে দশ বারোজন বালক হানাবি খেলছে। কাউকে কাউকে হানাবি খেলতে সাহায্য করছে গ্রামের মানুষ। তাঁরা দু-একজনকে সাধ্যানুযায়ী টাকা দিচ্ছে। কাউকে কাউকে আপাদমস্তক সাদা পোশাকে ঢাকা কোনও মেয়ে এসে সাহায্য করছে, কাউকে পুরো কালো নেকাবওয়ালা নারী এসে সাহায্য করছে। দিঘী'র জল তাদের আতশবাজি'র খেলায় বর্ণিল হয়ে গেছে।
কিন্তু একটি বালককে কেউ-ই সাহায্য করছে না। সে সতর্ক হয়ে চোখ বড় বড় করে চারদিক দেখছে আর ভয় পাচ্ছে। ঝোঁপের আড়াল থেকে তীর ছুঁড়ে ছুঁড়ে অনেক খেলোয়াড়কে লাশ বানিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
✍ ভয় পাওয়া বালকঃ
বালকটি দিঘী থেকে ঘরে ঘরে বলতে লাগল, আপনাদের পাঠানো ছেলেদের হত্যা করা হচ্ছে। আপনারা এদের খেলা থেকে বিরত করুন। অন্ধকার, কৃত্রিম অন্ধকারে ভরে দেওয়া হয়েছে আমাদের শারদাংবেল। আপনারা উপরের কালো পর্দা সরান। দয়া করুন। আমার কথা শুনুন।
বালকটির কাজে ৯৯ ভাগ মানুষই এটাকে এড়িয়ে গেল/বিরোধিতা করল। অপারগ হয়ে সে চিৎকার করে বললো- উপরে আলো আছে, আপনারা যবনিকা সরান। আপনারা চেষ্টা করলেই হবে।
✍ রাষ্ট্রদ্রোহীতাঃ
ভয় পাওয়া বালকটির অপপ্রচারণার খবর দেশত্রাতা'র কানে গেল। তিনি তাকে ডেকে পাঠালেন। কিন্তু বালকটি যেতে রাজি হয় নি। এর একটু পরে দেশরাজও ঐ বালকটিকে ডেকে পাঠালেন রাজফটকে। কিন্তু দেশরাজের নির্দেশও সে অমান্য করলো। সে যায়নি।
সভাসদরা শোরগোল শুরু করে দিলেন। এটা মস্ত বড় বেয়াদবী। রাষ্ট্রদোহীতা। এটা চরম অপরাধ!!
✍ আলোক-স্নানঃ
শারদাংবেলবাসী বিস্ময়ে বিমুঢ় হয়ে গেল আজকের আকাশে। এক মুহুর্তের জন্য তাঁদের দেশের প্রতিটি কোনায় কোনায় আলো এসেছিল। প্রকট আলো। সবাই নিজেদের নতুনভাবে আবিস্কার করেছিল। এক মুহুর্তের জন্য জাতি'র প্রতিটি সদস্য আলোর অবগাহনে নিজেদের স্নান করেছিল। আলোকীয় স্নানে কেউ কেউ নিজেদের পবিত্র করতে পেরেছে।
✍ পরিবর্তনঃ
ভয় পাওয়া বালকের লাশ অশুভ গাছের নীচে পাওয়া গেছে। আলোকমালা আনতে ছেলেটি আকাশে উঠে পর্দা ফাক করে দিয়েছিল। এই অপরাধে তাকে হত্যা করতে গিয়েছিলেন দেশরাজ। কিন্তু দেশরাজ বালকটিকে হত্যা করার পরপরই দেশত্রাতা নিজ হাতে রাজ'কে খুন করলেন। আর যবনিকাপাতও রোধ করতে সক্ষম হলেন।
চিহ্ণিত আতশবাজরা চলে গেলেও অন্য আতশবাজ বালকদের এখন আরো আরো হত্যা করা হচ্ছে। এখন ঝোঁপ থেকে নয়, একেবারে সামনে এসে।
লাল লাল রক্তে রক্তে ভরে গিয়েছে শারদাংবেল। কয়েকদিনে জনগণের বেশিরভাগই অভ্যস্ত হয়ে গেলেও কেউ কেউ চোখ খুললে কিংবা বাতাসের নিঃশ্বাসে কেবলি রক্তের হিমোগ্লোবিনের গন্ধ পান। তাজা তাজা হিমোগ্লোবিনের গন্ধ।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই এপ্রিল, ২০১৬ বিকাল ৪:২০