কয়েকটা নির্মানাধীন এ্যাপার্টমেন্টের কাছে গিয়ে গিয়ে দেখেছে সুষমা এ ক'দিনে । অনেক ক'টাই ভাল মনে হল । নামকরা বিশ্বস্থ ডেভলপার কিনা সেটাই আগে দেখছে । শেষ প্লটটার কাছে গিয়ে একটু দ্রুত নামল গাড়ি থেকে ; চমৎকার লোকেশন । দক্ষিণ পূর্ব দিকে রাস্তা , কর্ণার প্লট । এটাই , এমন একটা প্লটে বাড়ি চাই । নাহ্ , নিজের জন্য নয় । প্রবাসী বাদলের জন্য ।
বাদল ফোনে বলেছে একটা এ্যাপার্টমেন্ট নিতে চায় সুষমারা যেখানে আছে সেখানে । সে নাকি ওয়েব সার্চ করেও খোঁজ নিয়েছে এই এলাকার । যখন দেশে আসবে পরিবার নিয়ে উঠবে সেখানে । বাদলের ইচ্ছা পূরনের জন্য উৎসাহে শুরু করেছে মনমত বাড়ী খোঁজা ।
সুষমা বাদলের এমন সিদ্ধান্তে পুলকিত ! আবার বিস্মিতও । বাদল থাকবে দেশে এসে তার আশে পাশে কোথাও , কাছাকাছি ! তারপর বুড়ো বয়সে অনেক অনেক গল্প হবে , ইচ্ছেমত বাদলের বিরুদ্ধে সব অভিযোগ মন খুলে বলতে পারবে । বাদলও না জানি কত কিছু জমিয়ে রাখছে বলবার জন্য । দু'জন শুধু সঞ্চয়ে বিশ্বাসী । কোন কথা , কাতরতা কিছু খরচ করে না । কেবল জমায় ।
সুষমা ক'দিন ধরে কল্পনায় দেখে মর্নিং ওয়াকের সময় বাদলের সাথে দেখা হবে রোজ । বাদলের বাসায় দরজার পাশে লতানো গোলাপ , বেলী ঝাড় । ফুটলে প্রথম ঘ্রান নেবে সুষমা । বাদলের বউ শিলা মজার মজার ডিস তৈরী করে ডাকবে ওদের । রাতে খাবার পর হাটতে বেরিয়ে বাদল হঠাৎ হানা দেবে সুষমার ঘরে । বুড়ো বয়সে শিলা আর সুষমার বর হাবিবের মনে কোন মেঘ থাকবে না । ছোটখাট খোঁচা যে দেবে না তারা কথায় কথায় সেটা বলা যায় না । এমন স্বাভাবিক অনেক কিছু কল্পনায় আসে । সুষমার অসুস্থতায় বাদল তার বিছানার পাশে চেয়ারে বসে আছে , এমন একটা দৃশ্য ভেবেও সুষমার সুখ । নাহ্ , বাদলের অসুখে নয় , তার কেন অসুখ করবে ? বাদলের আনন্দ সুখ কানায় কানায় উপচে পড়ছে সেটা দেখে যেতে চায় জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সুষমা ।
কাছাকাছি থাকবে ওরা , যখন তখন আসা যাওয়া । একরাতে সুষমা দরজা খুলতেই ঢুকে না ভেতরে বাদল , অপলক চেয়ে থাকা দু'জনের । সেই ছাত্রজীবনে যেমন করে দু'চোখে দেখার গভীরতা নিয়ে চেয়ে থাকতো সুষমার চোখে তেমনি বাদলের দৃষ্টি ।
বাইরে বৃষ্টি , বাদল ভিজে গেছে। ওকে ভিতরে এনে দরজা বন্ধ করে সুষমা । তোয়ালে আনতে গিয়ে সময় একটু বেশী নেয় সে , কেন আজ বাদলের চোখে ঘোর লেগেছে । মাঝ বয়স পেরিয়ে এসে ওরা দু'জন কেন ভুল করে ফিরে যায় অনেক পুরোন সেই পথের মোড়ে । হাবিব টিভিতে খেলা দেখছিল বেডরুমে , বাদল এসেছে শুনে বলল পাঠিয়ে দিতে সেখানে ।
দেখে বাদল বারান্দায় দাড়িয়ে আছে , বাইরে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে মাঝে মাঝে , বৃষ্টির তেজ বেড়েছে । কাছে গিয়ে তোয়ালে হাতে দিতে গিয়ে টের পেল বাদল তার হাত ধরেছে , সুষমা বুঝতে পারছে না সে কোথায় ! বাদল তাকে টেনে নিল কাছে , দুই হাতে মুখটা তুলে নিয়ে দেখল । সুষমার কপালে দু'ঠোট ছুঁয়ে কি যেন বলে গেল , দিয়ে দিল । সুষমা পেয়ে গেল , ওরা জানল কি জানল না বোঝা গেল না । বিদ্যুৎ বয়ে গেল সুষমার শরীরে ঝড়ের রাতে । সুষমাকে সজোরে বুকে জড়িয়ে রাখে বাদল , সুষমাও শক্তিহীন । পরম নির্ভরতায় তার বুকে আশ্রয় খোঁজে যার জন্য ছুটে চলা তার এতটি বছর । ভাল লাগার চরম বোধে অশ্রুর বাঁধ ভেঙ্গে যায় । বাইরে বৃষ্টি , ঘরেও বৃষ্টি । ছাড়িয়ে নেয় নিজেকে । বাদলকে বারান্দায় রেখে ড্রইং রুমে বসে পড়ে চেয়ারে , নিজেকে স্বাভাবিক করতে সময় নেয় ।
বেডরুমের দরজায় গিয়ে হাবিবকে জানিয়ে আসে বাদল ভিজে গেছে , ড্রইং রুমে বসছে । রান্নাঘরে বুয়াকে বলে কফি করে দিতে তিনকাপ । তারপর ওয়াশ রুমে ঢুকে চোখে মুখে পানি দেয় ।
বেরিয়ে এসে দেখে বাদল হাবিব কফি কাপে চুমুক দিচ্ছে । সুষমা কফিটা ফিরিয়ে দেয় , খায় না । বাদল ঝটপট উঠে পড়ে , হাবিবের কাছ থেকে বিদায় নেয় ভেজা শরীরে তাড়াতাড়ি ফিরবে বলে ।
সুষমা শুয়ে পড়ে , আজ অনেক কিছু ভাবতে ইচ্ছে করছে । অনেকসময় ধরে । তারপর ঘুমিয়ে পড়ে । ঘুম ভেঙ্গে দেখে সে এক স্বপ্নের থেকে ফিরে এসেছে বাস্তবে । কাল রাতে অনেকক্ষন ভেবেছে বাদলের এ্যপার্টমেন্ট কেনার বিষয়টা ।
আজ পছন্দমত লোকেশনে পছন্দমত ডেভেলপারের এ্যাপার্টমেন্ট পেয়ে তাদের মেইল এ্যাড্রেস নিয়ে ফিরল ঠিকই । তবে দ্বিধা কাটছে না । কেমন কেমন স্বপ্ন , কল্পনা তাকে প্রভাবিত করছে । এতকাল বাদল আচ্ছন্ন করে আছে তাকে তবু এতটা কাতর হয় নি সে ।
তারপর শিলার কথা মনে হতে অপরাধবোধ পেয়ে বসে তাকে । সত্য গোপন থাকে না , আর কোনদিন যদি শিলা জানতে পারে সুষমার পছন্দে তাদের কাছাকাছি ঠিকানা গড়েছে বাদল । শিলা কি করে সহ্য করবে ! একটা মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের এতটুকু দু:খ বুঝবে না সুষমা তা হয় না । বারবার শিলার মুখ ভেসে উঠতে লাগল , যে বিয়ের পর থেকে জেনেছে তার বর মনের মধ্যে এক মেয়েকে লুকিয়ে রেখেছে দীর্ঘদিন , অবোধ অবুঝ এক মেয়ে তার বরের বুকের মধ্যে জায়গা দখল করে আছে ।শিলার জন্য কষ্ট হয় ।
সুষমা মেইল করে বাদলকে , এ্যাপার্টমেন্টের বিস্তারিত তথ্য জানিয়ে।
শেষে লিখে দেয় , " সবকিছু ভেবে সিদ্ধান্ত নেবে " ।
জানে বাদল অত্যন্ত বুদ্ধিমান , বুঝে নেবে কি বলতে চেয়েছে ।
মেইল পাঠানোর পর শূণ্যতায় পেয়ে বসে তাকে , বিকেলে বার বার চোখে পানি আসে । কল্পনায় দেখে সকালের আলোয় পছন্দের লোকেশনের বাড়ীর বারান্দায় এসে দাড়িয়েছে বাদল পূর্বদিকে ফিরে , পাশে বেলী আর লতানো গোলাপ । শীত পড়ে গেছে , নিজহাতে বোনা ছাইরঙ মাফলার দিতে এসেছে সুষমা হাবিবের সাথে হাটতে হাটতে । এগিয়ে আসতে থাকে বাদল । বেগুনী তাত শাড়ির আঁচল জড়িয়ে নেয় সুষমা । এগিয়ে আসতে থাকে বাদল , এগিয়ে আসে নেবে বলে ।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে এপ্রিল, ২০১২ সকাল ৮:৪০