সকালে ঘুম ভাঙ্গতেই মনে পড়ল লাবনীর আজ ২৬ তারিখ , আগামীকাল দুপুরে আবীরের ফ্লাইট , চলে যাবে দূরদেশে । মনে হতেই কেমন অবশ লাগতে লাগল শরীর । গতরাতে ঘুম আসবার আগ পর্যন্ত কত কথা মনে পড়েছে তার ।
আবীরের হঠাৎ করে দেশে আসতে হোল , তার পারিবারিক প্রয়োজনে । বছরের এ সময়ে তার দেশে আসা হয়নি কখনো আগে ।
হঠাৎ করেই তো উল্কা পড়ে পৃথিবীর বুকে , অকস্মাৎ একদিন ভূমিকম্প হয় তুমুল স্পর্ধায় ! থেমেও যায় ক্ষনিক পরে । আবীরের দেশে আসবার কথা শুনে ভূমিকম্প শুরু হোল লাবনীর বুকের যমিনে , প্রাত্যহিক জীবন যাত্রায় । থামল না বরং উত্তোরত্তর বেড়েই চলল কম্পন । পাসপোর্টের ঝামেলা নেই কোন , আবীর তার কত কাছে , এই দেশে । বিবেক , সমাজ ,সংস্কার তাদের জন্য যে বাঁধ নির্মান করেছে , সেটা তারা তুচ্ছ করে না ; সেই সুউচ্চ বাঁধের উপরে ভাল লাগার প্রাসাদ গড়ে নিয়েছে শক্ত গাঁথুনীতে ।
আবীরের চলে যাবার দিন এগিয়ে আসতে থাকে । ক্যালেন্ডারের পাতায় সবচেয়ে উজ্জ্বল কেন মনে হয় তার চলে যাবার তারিখ । আগে বলেছিল , যাবার আগে কথা বলবে লাবনীর সাথে । লাবনী কল্পনা করে আবীরের সামনে গিয়ে দাড়িয়েছে সে , চোখ তুলে প্রানভরে দেখছে সে আবীরকে ; লাবনীর হাত আবীরের হাতে -- সমর্পনের ভাষা তাদের ! বাস্তবে লাবনী জানে অসাধ্য এ কাজ ! আবীরের চোখে তাকিয়ে থাকবার মত দু:সাধ্য কাজ আর দ্বিতীয়টি নেই তার জন্য । আর আবীর ? সাহসী সুপুরুষ আবীর কি কোনদিন পেরেছে লাবনীর চোখের ভাষা পড়ে নিতে তার চোখের অতলান্তে ডুব দিতে !
আবীর আছে কাছে কোথাও ! আনন্দ বীণায় ঝংকার তুলে সংসারে ছুটে বেড়ায় লাবনী , খুটিনাটি সব কাজে গভীর মনোযোগ দেবার ভান করে । সে জানে তার সব মনোযোগ কে নিয়েছে কেড়ে ! এতবড় পৃথিবীতে !
বিছানা ছাড়ে লাবনী , সকাল থেকে আজ আরো ব্যস্ততা খোঁজে সে । ছুটির দিনে বর বাড়িতে আজ । বর সহপাঠি ছিল তার , এখনও আছে বন্ধুসুলভ ; লাবনীর সুখ সুবিধার জন্য তার নজরদারী , খবরদারীর কমতি নেই কোন ।
আবীরও তার সহপাঠি ছিল , অন্য সব সহপাঠিদের সাথে কত সহজ সম্পর্ক আর যোগাযোগ লাবনীর । অথচ আবীরের ক্ষেত্রে তেমনটি নয় । কিন্তু কেন ? ভেবে পায় না লাবনী । আবীর কি নিজে থেকে তার বউকে এমন কিছু বলেছে যা ছিল তার একান্তমনে , গোপনে ! যে কারনে আজ আবীর অন্য সব সহপাঠিদের মত আচরন করতে পারছে না ।
লাবনীর মনের আকাশে মেঘ জমে ঘন , অঝোরে বৃষ্টি নামবে কি আজ ! বিকেলে বেড়াতে বের হয় ওকে নিয়ে ওর বর । শহরের কোলাহল ছেড়ে দূরে । আশুলিয়ার পথে যেতে যেতে দুপাশের জলাধার , মেঘভরা আকাশ লাবনীর মনের ছবি আঁকে । গাড়ীর জানালায় চোখ রেখে ঝাপসা চোখে দিগন্ত পারে কাকে যেন খোঁজে বার বার ।
কাল চলে যাবে আবীর , অনেকদিনের জন্য । যাবার আগে ফোন করল না ; না করুক । লাবনী আর কোনদিন কথা বলবে না আবীরের সাথে । আর কত কষ্ট দেবে সে লাবনীকে ! মনে হয় পৃথিবীর সব ভাল , সবাই ভাল একমাত্র আবীর ছাড়া । তার মত এত কষ্ট তো তাকে কেউ দেয়নি অথবা লাবনী অন্য কোনজনকে এমন করে সুযোগ দেয় নি কষ্ট দেবার ! আপন মনে বলে , ' আবীর তুমি একটুও ভাল না , তোমার কোন ক্ষমা নেই , তোমাকে আমি চিনি না , কোনদিন আর খোঁজ করবে না আমার ' ।
অনেকটা পথ যেতে আমানের ফোন , সহপাঠি ছিল লাবনীদের । আবীরের ঘনিষ্ট বন্ধু । বলল , লাবনীদের বাসার কাছে এসেছে একটা কাজে , ওরা থাকলে বেড়াতো ওদের বাসায়। কোনদিন আসেনি এ বাসায় আমান ; লাবনী আর ওর বর ফিরে এল । লাবনীর কষ্ট অনেকটাই কমে যায় আমানকে দেখে , আবীরের ঘনিষ্ট বন্ধু বলে , আবীরের কাছের একজন বলে । এক সময় বলে আমানকে , ' আজ ভীষন মন খারাপ আমার , তোমাকে দেখে ভাল লাগছে , কারনটা আজ বলব না , ১০ বছর পরে বলব যদি বেঁচে থাকি '। আমান কিছু বুঝল বলে মনে হল না ।
রান্না ঘরে ব্যস্ততার মাঝে মোবাইল বেঁজে উঠল ; মোবাইলে আবীরের নাম দেখে রাগ , দু:খ সব কিছু অভিমান হয়ে বেরিয়ে এল । কান্নায় কন্ঠস্বর চাপা পড়ে গেল । বলল , ' কাল না চলে যাবে , কই ফোন করেছো ? আমি কত অপেক্ষায় থেকেছি ।'
আবীর : কেন এই যে করেছি , তোমাকে আমি বলেছিলাম না ফোন করব। আমি কি তোমার সাথে কথা না বলে চলে যেতাম ? আসলে একসাথে দুটো কাজ করতে পারি না আমি । এখন বারান্দায় চা নিয়ে বসেছি তোমার সাথে কথা বলব বলে ।
লাবনী শুনতে পেল সেই হাসির শব্দ যা তার সব ভুলিয়ে দেয় । রাগ অভিমান সব পানি করে দেয় । তবু বলল , ' হ্যা , চলে যেতে দেশ ছেড়ে আর পরে বলতে স্যরি , রাগ করো না যোগাযোগ করতে পারি নি আমি ' ।
আবার হাসল আবীর । তর্ক করল না , এই এক স্বভাব আবীরের , কেবল মেনে নেয় , প্রতিবাদ করে না । অনেকবার রাগ করে কথা বলতে গিয়ে উল্টো নিজের উপরে রাগ করতে হয়েছে । অনেক রাগ জমিয়ে রাখলেও লাবনী ঠিক জায়গায় পৌছে দিতে পারে না সে রাগ , মানুষটা আবীর বলে । সুচতুর সে । এভাবে চিরকাল হারিয়ে দেয় লাবনীকে ; পরোক্ষে সব জয় আবীরের পক্ষে চলে যায় ।
তারপর আমানের কথা জানালো আবীরকে ; ওদের বাসায় এখন আমান , রাতে খাবে একসাথে এসব । আবীর তাকে অবাক করে দিয়ে বলল আমানের মোবাইল নাম্বার দিতে । যাবার আগে বাই করবে আমানকে । বলল , মোবাইলের কারো নাম্বার নাকি নাই সীমের কি ঝামেলার কারনে । লাবনীরটা শুধু আছে এক জায়গায় । কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি এবার ।
কথা শেষ করে রান্নাঘরে ফিরতেই তার বর বলল , এতক্ষন ফোনে কেন সময় দিলে , পরে কথা বলতে ফোনে , যে ফোন করেছিল তাকে বুঝিয়ে বলতে । উচ্ছ্বসিত লাবনী খুশী ভরা মনে বলল , ' কিছু হবে না , আমি সব পেরে যাব , সব ঠিক মত হবে ' । বলতে পারল না ," আমার অনুপ্রেরনা , আমার উৎসাহ যে ফল্গুধারায় বয়ে যায় , তার বিচ্ছুরিত কনা আমি কুড়িয়ে নেই সযত্নে সহস্তে , নিজের শান্তির জন্য "।
রাতে খাওয়ার পরে আমানকে নামিয়ে দিতে রওয়ানা হয় লাবনী আর ওর বর । পথে যেতে যেতে আবীরের ফোন পায় আমান গাড়ীতে বসে । লাবনী বুঝতে পারে সবার আগে । আমান ফোনে কথা শেষ করে লাবনীর বরকে অনুরোধ করে যেন আবীরের সাথে দেখা করবার জন্য আমানকে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় নামিয়ে দেয়া হয় । আরো বলে আগামীকাল চলে যাবে আবীর , দেশে এসেছিল বিশেষ প্রয়োজনে । এখুনি জানিয়েছে ।
তারপর ? তারপর লাবনী কি করবে বুঝতে পারে না গাড়ীর অন্ধকারে ; খুশীতে ঝলমল করতে থাকে । কেন শাড়ী পরে এল না ,কেন সুন্দর করে সেজে এল না ! কেন ঘরোয়া ভাবে চলে এল ! আবার ভাবে ,নাহ্ -- কোনভাবে আবীরের সামনে যাবে না সে। নির্ধারিত জায়গায় নেমে আমান মূহুর্তে উধাও হয়ে গেল । লাবনী তার বরকে বলল , ' যাও , তোমরা বন্ধুরা সাক্ষাৎ কর , আমি নামব না ; আমাকে নামতে বলো না যেন '।
বিস্মিত লাবনী ভেবে পায়না এমন কাকতলীয় ঘটনা কি করে ঘটতে পারে ! আজই আমান গেল ওদের বাসায় , আজ ওরা বেড়ানো রেখে ফিরে এল আমানের ফোন পেয়ে , সত্যি আবীরের কাছে আমানের মোবাইল নাম্বার না থাকাতে আজ নিল লাবনীর কাছ থেকে , আজ আমানকে লিফট দিতে হল , গাড়ীতে একসাথে থাকা অবস্থায় আবীর ফোনে আমানের সাথে যোগাযোগ করে দেখা করতে চাইল । আশ্চর্য্য যোগাযোগ ! বিধাতা মানুষের কোন চাওয়া কি অপূর্ন রাখে ! মনে হয় রাখে না । কত কিযে ভাবনা চলে আসে ; ভাবে বিভোর হয়ে থাকে সে ।
জানালার কাছে অতি চেনা মুখ , আকাঙ্খিত মুখচ্ছবি ! এগিয়ে এল আবীর ।
বলল , ' কেমন আছো ? ভাল আছো তো ? '
কি আশ্বর্য্য ! লাবনীর মনে হল স্বপ্ন দেখছে সে ! তার সামনে কত ব্যবধান , কত আড়াল , কত দ্বিধা -- সব ছাড়িয়ে আবীর দাড়িয়ে আছে । কুশলাদি বিনিময় হল । তারপর সরে গেল গাড়ীর পাশ থেকে আবীর । একটু দূর থেকে লাবনী মন ভরে দেখতে চাইছিল আবীরের হাসিমুখ , কথা বলার ভঙ্গী । আলো তেমন ছিল কই ? আরো কেন উজ্জ্বল ছিল না আলো ? কেন সময় ছিল না অনেক ? নাহ্ , তবু লাবনীর ভাল লাগা পূর্নতায় ভাটা পড়েনি । সেই যে আগের বার আবীর বিদায় নেবার সময় সিগারেট হাতে উদাস দৃষ্টিতে কি যেন এক অব্যক্ত ব্যথাভরা চোখে তাকিয়ে ছিল ; সেটা কুরে কুরে খেত লাবনীকে । যন্ত্রনায় দগ্ধ করত , অপরাধের কাঠগড়ায় দাড় করিয়ে রাখতো বিরামহীন ! সে ছবিটা আজ ঢাকা পড়ে গেল ।
আবীরের অজানা নেই সেই কথা যা কোনদিন লাবনী বলেনি ওকে , বলতে পারে নি । আবার আবীরও বুঝে গেছে তার না বলা কথাগুলো
স্বতস্ফূর্তভাবে লাবনীর মনে জায়গা করে নিয়েছে , লাবনী সে কথার মূল্য
দিতে পেরেছে । তাদের পরস্পরের প্রতি আবেগ , অনুভুতি , ভাল লাগা পৃথিবীর অভাব অভিযোগের দৈন্যতায় ম্লান হবার নয় ।
ফিরে আসে লাবনী চেনা জগতে নিয়মের কাছে , ফিরে যায় আবীর লৌকিক বিদায় জানিয়ে ; জানে আবীর , জানে লাবনী এ শুধু কথিত বিদায় পরস্পর হতে । তারা অনাদিকাল থেকে চলছে দুজন দুজনের দিকে , জীবনে রঙ ছড়াতে আবীরকে থাকতে হবে , জীবনের জটিল পথে লাবন্য না থাকলে চলবে না তাই লাবনী আছে ।
দলিলে , হিসেবের খাতায় পাশাপাশি নাই বা থাকল দুটো নাম পাশাপাশি । অপার্থিব সত্য বলে যদি কিছু থাকে সেই সত্যের আশ্রয়ে সুন্দরের অপ্রকাশিত আলো হয়ে থাকবে আবীর , থাকবে লাবনী অনবদ্য । থাকবে ওদের নির্মল আবেদন নিয়ে পথচলা ।
( ছবি: গুগল থেকে ধার নেয়া )
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে অক্টোবর, ২০১১ বিকাল ৫:২১