পাহাড় আমার ভীষণ প্রিয়। অবশ্য এই ছোট জীবনে খুব কমই কাটিয়েছি সেখানটায়। ডিসেম্বর মাসে প্রায়ই ছোট-বড় ফ্যামিলি ট্যুরে যেতাম যখন ছোট ছিলাম। কক্সবাজারে যেবার গেলাম সেবার প্রথম পাহাড়ের বিশালতা টের পেয়েছিলাম। একটু বড় হতেই যাওয়া হয়েছিলো রাঙ্গামাটি। বড় বলতে ক্লাস থ্রি-ফোর হবে। ফ্যামিলি ট্যুরের ভালো দিক হলো, প্রচুর ছবি থাকে আর খাওয়া-থাকার কোন সমস্যা নাই। কিন্তু ট্রেকিং বা এডভেঞ্চারের জন্য ফ্যামিলি ট্যুর না। উঁচু পাহাড়ে দুই পা দিলেই আব্বু ডাক দিতো চলে আসতে। ফ্যামিলির সাথে কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করা প্লাস আব্বুর ইয়াশিকা ৩৫ মডেলের ক্যামেরায় ফ্রেমবন্দি হওয়াটাই মুলত ছিলো ফ্যামিলি ট্যুরের বেসিক স্ট্রাকচার।
যখন আরেকটু বড় হলাম, ঘুরাঘুরি শুরু করলাম তখন নিজেকে একটু ইন্ডিয়ানা জোন্স ভাবতাম। টম সয়্যার কিংবা দস্যি কজন পড়া ছেলেপেলের যা হয় আরকি। ভৌগলিক কারনে পাহাড় কাছে থাকায় ওদিকটাতেই বেশি যাওয়া হতো। কিন্তু পাহাড়ের মাদকতায় হারিয়ে গিয়ে একটিবারও পাহাড়ে বেঁচে থাকা মানুষদের দিকে তাকাই নাই। ঝামেলাটা বাঁধল ২০১৮ সালে। ভার্সিটি ট্যুরও পড়লো রাঙ্গামাটি আর খাগড়াছড়িতে। সাজেক ভ্যালি তখনো ট্রেন্ডী। সেই ট্যুরটা অনেক কারনেই আমার লাইফের সবচেয়ে স্মরণীয় ট্যুর গুলোর একটা, কিন্তু এই লেখাটা খুব ভিন্ন কিছু অভিজ্ঞতা নিয়ে।
খাগড়াছড়ির দীঘিনালা থেকে সাজেকের উদ্দেশ্যে চাঁদের গাড়ি ছাড়ে। যাওয়ার পথে সারি সারি পাহাড়ি জনবসতি। আর সেখানটায় অনেকটা সিরিয়াল ধরে বাড়ির উঠান থেকে বাচ্চারা হাই দিচ্ছে। কিন্তু ভালো করে দেখলাম আসলে ওরা চাচ্ছে আমরা তাদের দিকে কিছু একটা ছুড়ে দেই। গাড়ির ভেতরে থাকা একজন বললো টাকা ছুড়ে দিতে। যিনি বললেন তাতে মনে হলো, টাকা ছুঁড়ে দেয়াটা খুব পুণ্যের কাজ। মাটির বাসা, বিদ্যুতের নামগন্ধ নাই, "পাছায় জোটে না ত্যানা" টাইপের লাইফস্টাইল, শত শত বাচ্চাদের ছোটবেলা থেকেই হাত পাততে শেখানোর উৎসবটা কিন্তু হাজার হাজার টাকা খরচ করে যেতে চাওয়া টুয়োরিস্ট ডেসটিনেশন সাজেকে ঢুকবার আগেই দেখা যায়। পরিকল্পিত পর্যটন কেন্দ্র সাজেকের বাইরের অপরিকল্পিত দুর্দশা আসলে কেউ দেখতে চায়নি সেদিনও। হয়তো পাহাড়ের বিশালতার জন্যই। আমরা তো বার্বিকিউ পার্টি করতে এসেছিলাম, রিলিফ ওয়ার্কে নয়।
সেখানে হেলিপ্যাড বলে একটা জায়গা আছে, ফটোশুট হটস্পট। আমার সাথে আরেকজন হাটছিলো সেখানটায়, দেখে ভেবেছিলাম লোকাল লুসাই কিংবা ত্রিপুরা হবে। তারপর আমাকে উনি ওনার একটা ছবি তুলে দিতে বললে বুঝলাম উনিও টুরিস্ট। হালকা আলাপে জানলাম, ত্রিশালে ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। উনি ফোনটা এগিয়ে দিতেই দুইজন আর্মি পার্সোনেল এগিয়ে এসে জেরা করা শুরু করলো। এনআইডি, স্টুডেন্ট আইডি দেখে প্রায় জেরাই করছে মনে হলো। আমি ক্যামেরা ফেরত দিতে এগোলেই মনে হলো রণে ভঙ্গ দিলাম। তারা চলে গেল। আমি বললাম, "কোন সমস্যা ভাই?" আমার হাত থেকে ফোনটা নিতে নিতে তিনি বললেন, "আরেহ ভাই এগুলা কিছু না। আপনার অন্তত চিন্তা থাকার দরকার নেই।"
রাতে প্রায়ই চা-কফি খেতে বের হতাম। মোটেলের বাইরে একটা বেশী সেরা কফিশপ ছিলো। ওখানটায় অনেক টাইম কাটাতাম। তো আমি সেখানটায় একা ছিলাম না। আমার সাথে শপে আরেকজন বাঙ্গালী ছিলো। শপের যিনি কাজ করছিলেন তিনি লোকাল লুসাই। যুবতি বলা যেতে পারে। বেশ ভালো মিউজিক টেস্ট। লুইস আর্মস্ট্রং শুনছিলেন আর কাস্টমারদের কফি সার্ভ করছিলেন। তো আমার সামনের মানুষটা আলাপ জমাতে চাইলেন। টপিক হলো, কেন সাজেকে কফি না বেঁচে কফিশপের সেই যুবতীর ঢাকায় এসে মডেলিং বা এক্টিং ক্যারিয়ারে যাওয়া উচিত। কফিশপের কর্মচারী মোটেও এই টপিকে কথা বলতে চাচ্ছিলেন না তা স্পষ্টই বুঝা যাচ্ছিলো। তারপরে মানুষটা কিভাবে তাকে হেল্প করতে পারবে তা বলতে থাকলো। ভদ্রতা বজায় রেখে হ্যা/না সুচক উত্তর দিচ্ছিলেন ওই দোকানি। একপর্যায়ে তিনি বললেন মিডিয়া পাড়ায় নাকি "উপজাতিদের" অনেক ডিমান্ড, ওনার অনেক পরিচিত। উনি ফোন নাম্বার চাইলেন, কিন্তু কফিশপের সেই কর্মচারী না বলছেন। এরপরেও অনেক প্রভোকেটিভ কথা বলে নাম্বার দিতে বললেন তিনি। তাও যখন পেলেন না তখন সেই কর্মচারীকে বেশ কিছু বাজে মন্তব্য করতে থাকলেন। তখন আশেপাশের কিছু মানুষও বিরক্ত হয়ে লোকটাকে সরাতে গেলো।
ট্যুরের শেষদিকে সুভিনিয়র শপে গেলাম হালকা কেনাকাটা করার জন্য।
হুট করে আর্মি চেকপোস্ট থেকে মাইকিং হলো যে সব দোকান বন্ধ করার জন্য। বিনা নোটিসে দোকান বন্ধ করতে বলা হলো। দোকানি আমারে দ্রুত কাজ শেষ করতে বললেন। আমি একটু সার্ক্যাস্টিকলি বললাম, "ব্যবসা আপনার না আর্মির?" দোকানি উত্তর দিলো, "ব্যবসা আমার হলেও চালায় তো ত্যানারা।" একা ছিলাম তাই হয়তো উত্তর দিয়েছিলেন।
যাইহোক, এটা শুধু আমার অভিজ্ঞতা সাজেক ভ্রমনের। জানি অনেকেই বলবে, আর্মি তো খামোখা নেই। এই কথাটাও সত্য আমি মানি। যেদিন দীঘিনালা দিয়ে সাজেক রওনা দিয়েছিলাম সেদিন দীঘিনালায় ১৪৪ ধারা ছিলো। বাজারে সবার সামনে পলিটিকাল মার্ডার হয়েছে তাই। আর্মি কনভয় করে সাজেক যেতে হয় সিকিউরিটির জন্য। কিন্তু আমি সেটা বলছি না। আর্মি নিয়ন্ত্রিত ট্যুর তো নর্থ কোরিয়াতেও থাকে। কিন্তু পোভার্টি জিনিসটা আইওয়াশ করে তারা। আর আমাদের এখানটায় দেখা যায় সরাসরি।
সাজেক কাছে চলে এসেছে বুঝা যায় পাহাড়ি রাস্তায় প্লাস্টিকের বর্জ্য দেখে। পরিকল্পিত ট্যুরিজম দিয়ে পাহাড়ের অপরিকল্পিত কিংবা পরিকল্পিত দারিদ্র্য আর ঢাকা যাচ্ছে না সেখানটায়। আর আদিবাসী দেখলেই বাঙ্গালী টুরিস্টদের "চিং চং" করা বাসি হিউমারের ব্যবহার আর পাহাড়ি মেয়ে দেখলেই উত্যক্ত করতে যাওয়া তো এখন লোকাল আর টুরিস্টদের মধ্যকার টানাপোড়নের সম্পর্কে অন্য মাত্রা দিয়েছে। বান্দরবানের ম্রু উৎখাত করে ফাইভ স্টার বানানো এই নিপিড়নেরই আরেকটা পর্ব। যেখানটায় স্কুল নাই, যেখানটায় বিদ্যুৎ নাই, সেখানটায় ফাইভ স্টার হোটেল হবে। মজার কিন্তু ব্যাপারটা।
সত্য বলতে, আমার মনে হয় আমরা ভুলে গেছি শুধুমাত্র টুরিজমের জন্য পার্বত্য অঞ্চল না। সেখানকার মানুষগুলোও আমাদের। তাদের দুর্দশাগুলোও আমাদের। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে এসে যদি এইসব আমরা ভুলে থাকি, তবে এদেশের সার্বভৌমিক নাগরিক হিসেবে নিজের অবস্থানটা নিয়ে আবার হিসাব কসার কাজে বসতে হবে। যত কাছে টানবেন, তত বুঝবেন আসলে এই অঞ্চলের খেঁটে খাওয়া মানুষের কপাল কতটা পোড়া। হতাশ হবেন। এক অজানা অপরাধবোধ কাজ করবে আপনার মধ্যে। আর বার বার মনে প্রশ্ন জাগবে, সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট আর জিডিপির মতো বড় টার্মগুলার ছায়া এই পার্বত্যে আর কখনো পড়বে না কিনা।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই নভেম্বর, ২০২০ রাত ১১:৪৮