আজ আমি কিছু কথা বলতে চাচ্ছি আমার বেড়ে ওঠা নিয়ে শহরকে নিয়ে। অনেকের জন্য অফেন্সিভ হতে পারে। তাই আগেই বলে দিচ্ছি, পারলে আগেই এভোয়েড করবেন। এটা কোন প্রাউড নোয়াখাইল্লা ব্লগপোস্টিং না।
আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা, জীবনের সবচেয়ে মধুর সময়গুলো মাইজদি নামের এই এক রাস্তার শহরের দ্বারেই। জন্ম থেকে কলেজ লাইফ আমি এই শহরেই থেকেছি। নস্টালজিয়ার শেষ প্রতিচ্ছবি থেকে একটা শহর হয়ে ওঠা আমি নিজ চোখেই দেখেছি। আমি নিজেও বড়ো হয়েছি শহরটার সাথে। আমার বেড়ে ওঠা শহরের প্রান নিভে যেতে দেখেছি নিজ চোখেই।
আজ এই শহরকে অনেকে বসবাসের জন্য প্রায়ই অযোগ্য হিসেবেই ধরে নেয়। অপরিকল্পিত নগরায়নের জন্য নয়, বরং অপরিকল্পিত গ্রহনযোগ্যতার জন্য। একটা সময় যে শহর জন্ম দিয়েছিলো সার্জেন্ট জহুরুলদের, আজ সে শহরের নিয়ন্ত্রণে যান্ত্রিকতা ও কুরুচি। তবে দোষ করা? সরকারের? না জেনারেশনটার?
আমার অপিনিয়নে দোষটা আমাদের ঘাড়েই পড়ে। আমরা শুধু সময়ের সাক্ষী হতে চেয়েছি। পরিবর্তন চাইনি। মুখ বুজে সহ্য করেছি সব। বাধা দেয়া দুরের কথা, কথাও বলিনি।
আমরা যখন স্কুলে পড়তাম তখন মোটেও আমরা ধোয়া তুলসি ছিলাম না। প্রচুর ঝামেলা হতো। কিন্তু একটা জিনিস তখন হয়ে উঠে নি। সেটা হলো, হাই স্কুল গুলোয় পলিটিকাল বড়ো ভাইদের দখল। যতদুর মনে পড়ে স্কুলের শেষ দিকটায় শহরের পলিটিকাল বড়ভাইরা প্রভাব খাটাতে চেয়েছিলো। আমরা বেশি কিছু করিনি। নিজের কাঁধ বাচিয়েছিলাম সেবার। এখন শহরের নিয়ন্ত্রণ করে সেই পলিটিকাল বড়ভাইরা , তাদের ছত্রছায়ায় থাকে এ শহরে বেড়ে ওঠা হাজারো কিশোর। উদ্দেশ্যহীন ভাবে, বাছ-বিচার না করে পলিটিকাল এই নেতাদের উদ্দেশ্য সাধনে কাজ করে এই মেজরিটি কিশোর।
আরেকটা সমস্যা হলো, ঝামেলা করার প্রবনতা। এটা একটা আম্ব্রেলা টার্ম। লোকাল ল্যাঙ্গগুয়েজে এটাকে বলে "হ্যাবা"। এটার কোন ডিকশনারি মিনিং নাই। ধরেন নতুন ফোন নিলেন। প্রভাবশালীর পাতি নেতারা প্রভাব দেখায়ে ফোন কাইড়া নিবে। তা ফেরত পেতে হলে গুনতে হবে হাজার দুই-এক টাকা। হ্যাবা কিন্তু অন্য অনেক ক্ষেত্রেই ইউজড হয়। যেমন, ধরেন আপনি আর আপনার বান্ধবি আড্ডা দিচ্ছেন। হুট করে দেখবেন একদল এসে আপনাকে কথিত "নষ্টামি" করার ব্লেম দিয়ে মারবে। এরপর সব নিয়ে চলে যাবে অথবা টাকা আদায় করবে। বাই দা ওয়ে, হ্যাবার কোন বিচার হয় না। বিচার হয় একটা ছেলে আর একটা মেয়ে কেন আড্ডা দিবে। এলাকার মুরুব্বিরা আবার এটাকে ভালো চোখে দেখে। তারা প্রায়শই তাদের ফ্যামিলিকেও হ্যারেস করে থাকে। মাদকের অবাধ চলটাও এর সাথে বেশ ভালোই রিলেটেড।
আমার এক আত্মীয় একবার আমাকে বলেছিলো, "অঝোর তোকে মেয়েদের সাথে টং দোকানে দেখসি। শুন, কিছু মনে করিস না। এখানে এসব না করা ভালো।" বিশ্বাস করেন, উনি মোটেও নারী-বিদ্বেষী নন। উনি আমাকে আর আমার ফ্রেন্ডদের নিয়ে কনসার্নড বলেই এমনটা বলেছেন। আমি প্রায়শই চা দোকানে আড্ডা দেই, আমার ফ্রেন্ডরা থাকে। হ্যা, মেয়েরাও থাকে। অনেক সময় সন্ধ্যাও হয়। কিন্তু এই যে, একটা স্বাভাবিক ঘটনাকে একলাইনে না লিখে চার লাইনে লেখলাম... এটা এই শহরের জন্য মোটেও অস্বাভাবিক নয়। কারন এই শহর একটা মেয়ের চা খাওয়ার নিরাপত্তাও দিতে পারে না। কাছের মানুষটাকে নিয়ে এই শহরের আলোয় হেটে বেড়ানো নিছক কল্পনা বাদে আর কিছু নয়। মেয়েদের উপর চলা হ্যারেজমেন্টের ঘটনা গুলো তো বাদই দিলাম। এখানে ধর্ষন বিরোধী র্যালিতেও মেয়েরা নিরাপত্তার অভাবে আসতে চায় না।
সবচেয়ে মারাত্মক কথা, উপরের যা লিখলাম এই শহরের সবাই তা মেনে নিয়েছেন। কারও কিছু যায় আসে না। এই নর্মালাইজেশনের পিছে দোষ কার তাইলে, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের? না সমাজের? আর কিশোরদের এই আঁধারে ছুড়ে দেয়ার দায় টা কার বলবেন?
দোষটা আমি আবারো আমার ঘাড়ে নিলাম, আমাদের ঘাড়ে নিলাম। একেবারে সহজে বললে, আমরা স্বার্থপর। তাই আমরা এগুলো হতে দিয়েছি। আমরা পলিটিক্সে যাই নি। ঐ পুরো জায়গাটাকে ঠেলে দিয়েছি তাদের দিকে যারা এটাকে ক্ষমতার অপব্যবহারের জন্যই ব্যবহার করবে। পঁচে গন্ধ বের হলেও নাক ঢেকে পাশ কাটিয়েছি। আর আমাদের একটা শহর-ছাড়ার প্রবনতা তো আছেই। আমরা যত দ্রুত পারি এই শহর ছেড়ে অন্যত্রে পাড়ি দেই। কারন পালালেই বাঁচি বাপু।
এই শহরে বিনোদনের ব্যবস্থা নেই। রয়েছে হাজারটা রেস্টুরেন্ট আর শপিং মল। নেই কোন লাইব্রেরী যেখানটায় যাওয়া যায়। মুক্ত-শিল্প চর্চার কোন স্থান নেই এই শহরে। বইয়ের দোকানে গাইডবই গুলোই চলে। আর শিল্প চর্চার নামে চলে প্রতিযোগিতা, যেখানে চর্চা কম আর দাম্ভিকতা বেশী থাকে। ও হ্যা, এই শহরের শিল্প চর্চার দায়ভারও নিয়ে রেখেছে শহরের এলিট ক্লাস মুরুব্বিরা। ঐখানেও চলে ক্ষমতা ব্যবহারের নগ্ন-নৃত্য। ফলে, একটা কিশোর যাবেটা কই আমায় একটু বলেন। তার মানসিক সুস্থতার সব জিনিসই কেড়ে নেওয়া হলো। আমরা কিছুই করলাম না। আর ঐ সুযোগটা হাতছাড়া করেনি সেই পুরোনো শকুনেরা। কো-এডুকেশন এর নামমাত্র প্রয়োগ, জেন্ডার-বেসড ভায়োলেন্স, ঝামেলা করার প্রবনতা থেকে শুরু করে বেসিক নিরাপত্তাহীনতা... প্রত্যেকটা ছোট-বড় সমস্যা আজ এই শহরকে বসবাসের অযোগ্য করে তুলছে। এইজন্য আমরা কিছুই করিনি। ইভেন চাইও নি, রেস্টুরেন্টে চেক-ইন দিয়ে সেলফি আপলোড পর্যন্ত আর নিউজ পোর্টালের নিউজ শেয়ার করে "হায় হায় কেমনে হলো" পর্যন্তই আমাদের দৌড়।
বেগমগঞ্জের ঘটনার পর আমি শহরটাকে জ্বলতে দেখলাম। রাতভর বিক্ষোভ আমি দেখি নাই কখনো এই শহরে। মিডনাইট মার্চ, প্রতিবাদ মিছিলে কেঁপে ওঠা শহরটা বার বার হয়তো চিৎকার করে যেন বলছিলো, মরিনি এখনো। কিন্তু আমি দেখছিলাম, ড্যামেজ হ্যাজ অলরেডী বিন ডান। কারন আবারো আমরা এড়িয়ে যাবো। আবারো আমরা মেনে নেবো। আবার কোন বড় ধাক্কার আগেই হয়তো এই শহরটা পুরোপুরি মরে যাবে। রয়ে যাবে কোন এক হরর ফিল্মের হলুদ ফিল্টার ওয়ালা গুটিকয়েক লোকেশান।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা নভেম্বর, ২০২০ দুপুর ১২:৫৫