পার্কের পাশে প্রায় আড়াই ফুট চওড়া ফুটপাতটা দিয়ে ধীরলয়ে উদাসভাবে হাটছে অয়ন।থেমে থেমে বা পাজরে বাম হাতটি ঘষছে।এইটা তার একটা মুদ্রাদোষ।অরনী পাশে থাকলে অরনীর ভয়ে হাতটা বুকের ধারে কাছেও নিয়ে যেতে পারে না।অরনীর চোখ ফাকি দিয়ে গুটি কয়েকবার ঘষার চেষ্টা করে তবে অরনীর রক্তচক্ষু দেখেই ভয়ে চুপসে যায় আর ভাবে মেয়েটার চোখগুলো কত চোট তার দিকে থাকালেই কেন এত্তো বড় হয়ে যায়?
মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় একটা ভৌ-দৌড় দিয়ে পালিয়ে যেতে, তবে যেতে পারে না।
কারন অয়নের বা হাতটি অরনীর মুটিবন্দি।
এইটা একের ভেতর দুইয়ের মত কাজ করে।
অয়ন বা হাতটি আর ঘষতে পারে না সাথে অয়নের দৌড়ে পালিয়ে যাওয়া অপূর্নই থাকে।
এই সব কথা ভাবতে ভাবতে মুখে লেপ্টে থাকা হাসিটা আরেকটু চওড়া হয় অয়নের।
হঠাত্ হলুদ রঙের একটা গাড়ি গগনবিধারী হর্ণে সম্বিত্ ফিরে পায় অয়ন।
অয়ন ভাবে পার্কের পাশে রাস্তাটার কি দরকার?
একটু দূরে হলে ক্ষতি কি হত?
এসব ভাবতে ভাবতে অয়ন কবে যে পার্কের গেইটে চলে এসেছে বুঝতে পারে না।
গুটি গুটি কদম ফেলে পার্কের ভেতর ডুকে পড়ে।
তবে কোনো বেঞ্চিতে বসতে পারে না,জোড়ায় জোড়ায় বেঞ্চিগুলো পূর্ন।
তাছাড়া তারা দুজন তেমন একটা বেঞ্চে বসতো না।
ওই ছোট্ট লেকটার পাশে সবুজ ঘাসের চাদরেই পা ছড়িয়ে বসতো।
অয়ন এগিয়ে যায় লেকটার দিকে তবে খানিকটা গিয়ে ফিরে আসে।
তার ভেতর কেমন যেন এক অপূর্নতা কাজ করে।
দৌড়ে চলে আসে পার্কের সীমানা পেরিয়ে।
খানিকটা দূরে হাজার বছরের পুরনো বটগাছটার নিছে বসে হাপাতে থাকে।
পাশে কিছু পথশিশু তার দিকে অপার দৃষ্টিতে থাকিয়ে থাকে,কেউ কেউ হাসে।
সেইদিনের বাদামওয়ালা আজো বাদামের ঝুলিটা নিয়ে ধারে ধারে ঘুরে।
অয়ন বাদাম খেতে পছন্দ করতো তবে ছিলে খাওয়াটা তার চরম অপছন্দ বলে খেতে চাইতো না।
অরনী মেয়েটার ধৈর্য আছে বলতে হয়,কখনো ঘাসে বসে,কখনো বটগাছটার নিচে বসে বিরামহীন বাদাম ছিলেই যেত,আর অয়ন আরামেই চিবোতো।
হঠাত্ বাদাম ওয়ালার হুংকারে বাস্তবে আসে অয়ন।
হুংকার দিবেই না কেনো?
অয়ন যে বাদামের জন্য রীতিমত বিরক্তই করছে।
অরনী মেয়েটার উপর কিছুটা রাগ এসে পড়ে।
মেয়েটা কেনো যেনো চলে গেলো,অরনী থাকতে যেই বাদামওয়ালা "আপা,বাদাম লইবেন" বলে যেচে বাদাম দিতো আজ সেই বাদামওয়ালা চোখ কটমট করেই থাকায়।
বুকের বা পাজরে একটু দ্রুতই বাম হাতটা চালান করে দিয়ে আবার ঘষতে থাকে অয়ন।
সেদিনের তারিখটা মনে করতে থাকে অয়ন।
কত যেনো...???
ওহ হ্যা মনে পড়েছে।
৮ই নভেম্বর ২০১৪।
অয়নের তেমন কিছু মনে থাকে না,সেই থেকেই ভুলোমনা।
তবে তারিখটা ঠিকই মনে রেখেছে।
বারটাও মনে পড়ে,সেদিন রবিবার।
মেয়েটা একটা সাদা জামা পড়ে এসেছিল,অয়নকে বলেছে লাল টি-শার্ট পড়ে আসতে।
অয়ন ভাবে,সেদিনতো পহেলা বৈশাখ ছিলো না তাহলে লাল সাদা কেনো?
সাদার মাঝে লালটা বেশী ফুটে উঠে বলে?
তারমানে অরনীর সাদা আবৃত দেহে লালের একটু ঠাই দিতে চেয়েছিল?
মেয়েটাকে অনেক বেশী সুন্দর লাগছিল।
অরনী এমনিতেই সুন্দর।
সাদা জামাটাই থাকে একদম সাদা পরী মনে হচ্ছিল।
দূর থেকে অরনীকে দেখে দেখে সাত-পাচ ভাবছিল অয়ন।
সেদিন কি শেষ কাছে পাওয়া বলেই এতো সুন্দর লাগছিল?
যাক বাবা,পরীতো দেখা যায় না,মেয়েটাকে পরী ভেবেই বাহু বন্ধনে আবদ্ধ করতে চায় অয়ন।
-কখন আসছো?
_ (ততমত খেয়ে) এইতো ঘন্টা খানেক। অয়ন ভাবে মেয়েটা হঠাত্ এতো কাছে আসলো কেমনে?সত্যি সত্যি পরী নয়তো?শুনেছি পরীরা যাকে ভাল লাগে তাদেরকে পরীদের রাজ্যে নিয়ে যায়।আমাকেও নিয়ে যাবে না তো?
-কি ভাবছো?
_ ওহহ,না না,তেমন কিছু না।
-তোমাকে আসতে বলছি কয়টায়?
_ কেনো?৫ টায়।
-এখন কয়টা বাজে?
_ ৫ টা ৩ মিনিট।
-এত্তো আগে আসছো কেনো?তোমার তু এসাইনমেন্ট ছিলো ওইগুলা শেষ করছো?
_ না,মানে জী মানে না।
-তোমার এসাইনমেন্ট ফেলেই আসতে তো বলিনি,একটু লেট হত,আমি না হয় অপেক্ষা করতাম।
_ তুমি বরাবরই আমার অপেক্ষায় থাকো,কিন্তু আমি যে লেট অয়ন।আজকে স্পেশাল দিন মনে করে একটু আগে আসতে চাইলাম।
মেয়েটা শুধু শাসন করে আমায়।
শাসন করা শিখতে পারতাম,আমিও আচ্ছামত শাসাতাম মেয়েটাকে ভাবছে অয়ন।
-চলো।
_ কোথায়?
- চলোই না।
অয়নের হাতটি ধরে জোরে টান দেই অরনী।
অয়ন উঠে দাড়ায়।
হাটতে হাটতে সামনে একটা টং দোকান দেখে অরনী।
-চলো,আজ ওইখানেই ফুচকা খাবো।
অরনীর কথায় অবাক হয়ে যায় অয়ন।
মেয়েটাকে কতবার বলেছে চলো কিছু একটা খাই।
তখন মেয়েটা বাদাম নিতেই বলতো।
টং দোকানের কিছু তো দূরে থাক।
অয়ন খেতে চাইলেও অরনী বাধা দিতো।
আজ অরনী নিজেই।
-কি হলো?চলো?
_ হ্যা,চলো।
অতঃপর দুজনে ফুচকা খায়।
ততক্ষনে রাস্তার দু-ধারে সোডিয়াম লাইটগুলো হলুদ আলো ছড়াচ্ছে।
-চলো আজ ওই দিকটাই বসি।
_ ওইদিকে তো তুমি...
-চলো তো,আমি কি?আগে যায় নাই,আজকে যাবো।
_ আচ্ছা,চলো।
দুজন রাস্তার পার হতে যায়,অরনীর ডান হাতে অয়নের বাম হাত বন্দি।
হঠাত্ একটা উজ্জ্বল আলো তাদের দুজনের মুখে পড়ে।
কয়েকটি মুহুর্ত।
একটা বিকট শব্দ হয়।
আবার সব কিছু শান্ত,..
ঠিক আগের মত হয়ে যায়,যেনো কিছুই হয়নি।
হ্যা,হয়নি তো।তাহলে অরনী কালো পিচগুলোতে শুয়ে আছে কেনো?
অরনীতো সাদা জামা পড়ে এসেছিল,তবে এখন লাল কেনো?
মেয়েটা আমার সাথে দুষ্টুমি করার জন্য হয়তো রঙ এনেছিল,তবে রঙগুলো মেয়েটা মেখেই শুয়ে আছে কেনো?
মেয়েটা ঘুমকাতুরে জানি,তবে রাস্তায় ঘুমুবে?
একটা ফোন দিবো নাকি?
যদি ঘুম ভাঙে?
এলোমেলো কথাগুলো কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই অরনীর মাথার কাছে হাটু গেড়ে বসে অয়ন।
অ..র..নী
ডাকতে গিয়ে গলাটা ধরে আসে অয়নের।
নাহ ডাকবে না অয়ন।
কিছুক্ষনের মধ্যেই অনেক লোক হাজির হয় সাথে অরনীর মা বাবাও।
অরনীর মার কান্নাগুলো আজও কানে বাজে অয়নের।
অয়ন কান্না লুকোতে চেয়েছিল তবে অরনীর মায়ের কান্নার তোড়ে লুকোতে পারেনি।
অনেক কেদেছিল অয়ন,অরনীর মা বাবা অরনীকে নিয়ে চলে গিয়েছিল।
আর অয়ন ঝাপসা চোখে ছুটে চলা হলুদ গাড়িটির দিকেই থাকিয়েই আছে।
আজকেই তো ৮ই নভেম্বর,রবিবারও।
অয়ন রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাটে।
বা পাজরে হাত ঘষতে ঘষতেই অপেক্ষা করে আরেকটি হলুদ গাড়ির।
অরনীর কাছে যেতেই যে বড্ড ইচ্ছে করছে।।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে নভেম্বর, ২০১৫ সকাল ১১:৩১