অনেক চড়াই উতরায় পেরিয়ে শেষপর্যন্ত ১৮ মার্চ, ২০১৫ আমরা ভারত সফরের জন্য মৈত্রী এক্সপ্রেস ঢাকা টু কোলকাতা টিকেট কাটলাম। আবু তালেবের টা নিয়ে যা শঙ্কা ছিল, তা ১৬ মার্চ বিকালে তার ভিসা পেলেই দুর হয়ে যায়। সে আমাদের সাথে যাচ্ছে এবং মৈত্রী এক্সপ্রেসেই যাচ্ছে। ১৭ মার্চ সন্ধ্যার পর বাক্সপেটরা গোছানো শুরু করলাম। রাত একটায় ঘুমাতে গেলাম। পরদিন সকাল ৮ টায় ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়বে। রিপোর্টিং টাইম সাতটায়। উত্তেজনা ও খুব ভোরে উঠতে হবে এই চিন্তায় রাতে এক বিন্দুও ঘুম হলো না।
১৮.০৩.২০১৫
যাই হোক, ভোর সাড়ে পাঁচটায় হল থেকে বের হয়ে অপরাজেয় বাংলার (কলা ভবনের সামনে) সামনে গেলাম। স্টেশন পর্যন্ত যাওয়ার জন্য আমাদের জন্য একটি বাস বরাদ্দ ছিল। মোটামুটি সবাই উপস্থিত। রাজিব দেরি করলো। ওকে রেখে আমাদের রওনা হতে হলো। আমরা খুবই অল্প সময়ের মধ্যে স্টেশনে পৌছালাম। গিয়ে দেখি বিভাগের চেয়ারপার্সন আখতার সুলতানা ও তার মেয়ে আম্বারিন সুলতানা সেখানে আগেই পৌছে গেছেন। কিছুক্ষনের মধ্যে সাইফুল স্যার তার পরিবারসহ চলে আসলেন। এরই মধ্যে রাজিবও চলে এসেছে।
২১ জন শিক্ষার্থী, তিনজন শিক্ষক ও তাদের পরিবারের সদস্যরাসহ আমরা ছিলাম ২৭ জন। সাইফুল স্যারের দেড় বছরের মেয়ে আলিজা ছিল আমদের ট্যুরের অন্যতম আকর্ষণ। সাইফুল স্যারের অর্ধাঙ্গ শাওরিন আপু ও আখতার ম্যামের মেয়ে আম¦ারিন আমাদের ট্যুরের আনন্দকে আরো দ্বিগুণে পরিনত করেছেন। আর শবনম ম্যাম ১৯ মার্চ সকালে আমাদের সাথে কোলকাতায় গিয়ে যোগ দিয়েছিলেন।
ফিরে আসি স্টেশনে। সবাই উপস্থিত হলে আমার চেকিং সম্পন্ন করে প্লাটফরমে প্রবেশ করলাম। এরই মধ্যে কেউ কেউ সকালের নাস্তাটা স্টেশন থেকে সেরে নিয়েছে। আবার কেউ কেউ শুকনা খাবার কিনে নিয়েছে ট্রেনে উঠে খাবে বলে। আমরা যথাসময়ে সবাই ট্রেনে উঠে বসলাম। যথাসময়ে ট্রেন ছেড়ে দিলো। আমরা সবাই হৈ হুল্লোড়ে মেতে উঠলাম। সেই আনন্দ অনুভূতির কথা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। ট্রেন যমুনা সেতুর উপর দিয়ে যাওয়ার সময় সবাই আবার হৈ হুল্লোড়ে মেতে উঠলো। দুপুর দুইটায় আমরা দর্শনা পৌছালাম। ম্যাডাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচয় দেওয়ার কারনে অল্প সময়ের মধ্যে আমাদের ইমিগ্রেশন সম্পন্ন হলো। লাঞ্চের অর্ডার আগেই করা ছিল। ট্রেনে উঠেই আমরা আমাদের লাঞ্চ করে নিলাম।
যতই ভারতে প্রবেশ করছি ততই আমাদের মোবাইল নেটওয়ার্ক হারিয়ে যাচ্ছে। ১৫ থেকে ২০ মিনিটের মধ্যে আমরা নদীয়ার গেদে স্টেশনে পৌছালাম। ইমিগ্রেমনের জন্য সবাইকে সব মালপত্র নিয়ে নামতে হলো। ব্যাগের ভর নির্নয়ের পর সবাইকে একটা ফর্ম পুরণ করতে হলো। সবার শেষে আমরা লাইনে দাড়ালাম। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ট্রেনের একজন যাত্রি বাদ থাকলেও ট্রেন ছাড়বে না। একে একে সবার ইমিগ্রেশন শেষ হলো। ম্যাডামকে সকলের জন্য ২০০টাকা ঘুষ দিতে হলো। আবার সবাই ট্রেনে চেপে বসলাম। ট্রেন ছেড়ে দিলো। তারপর শুধু অপেক্ষা কখন কোলকাতা পৌছাবো। রাত নয়টায় আমদের অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো। আমরা কোলকাতার চিতপুর স্টেশনে নামলাম।
প্রিপেইড ট্যাক্সিতে করে প্রায় দশটায় পৌছালাম মারক্যুইজ স্ট্রীটের হোটেল ওরিয়েন্টালে। হোটেল আগেই ঠিক করা ছিল। হোটেলে চেক ইন করে গোসল শেষে বের হলাম রাতে খাওয়ার জন্য। সকালের দিকে টাকা দাম বেশি ওঠে বলে রাতে শুধু ১০০০ টাকা রুপি করলাম। ৮০০ রুপি পেলাম। এরপর সিম নিতে গিয়ে বিপত্তি দেখা গেলো। ওদের সিম আমদের মতো না। এক রাজ্যের সিম অন্য রাজ্যে গেলে কলরেট বেশি কাটে। কলরেট সবখানে স্থির রাখার জন্য আবার ‘পাওয়ার’ ( মোবাইল অপারেটরের পরিভাষায় রোমিং কস্ট) দেওয়া লাগে। যেটা মুল ব্যালেন্সে যোগ হয় না। একেক কোম্পানীর সিমে আবার একেক রকম পাওয়ার সিস্টেম। আমার ছিল ভোদাফোন কোম্পানীর সিম। আমিও ১০৬ রুপির পওয়ার দিয়ে নিলাম। ইন্টারনেট চালানো ও কথা বলার জন্য অলইন্ডিয়া ভোদাফোনের কাভারেজ সবথেকে ভালো। তবে দোকানদাররা বাংলাদেশীদের কাছে বেশি এয়ারটেল বেচতে চায়। এতে ওদের কি লাভ সেটা বুঝতে পারি নি।
রাতে গরুর মাংস দিয়ে খেলাম। বিল হলো মাত্র ৪০ রুপি। কোলকাতায় গরুর মাংস সস্তা, সবজি, খাসি, ডিম এগুলোর দাম বেশি। এরপর হোটেলে ফিরে টেলিভিশন অন করতে গিয়ে আরেক বিপত্তিতে পড়লাম। ওদের ওখানে টিভি র রিমোর্ট দুইটা। যাই হোক টিভি অন হলো। কোনো বাংলাদেশী চ্যানেল না পেয়ে মনটা খারাপ হয়ে গেলো। আমরা একরুমে ছিলাম তিনজন। আমি, আবু তালেব আর নোমান। টিভি দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে গেলাম।
১৯.০৩.২০১৫
সকাল আটটায় ঘুম থেকে উঠলাম। নাস্তা শেষে নোমান ও আবু তালেব আশেপাশে ঘুরে দেখতে গেলো। আমি আর গেলাম না। ঐ দিন ছিল আইসিসি ওয়াল্ড কাপ ২০১৫ এর বাংলাদেশ বনাম ভারতের কোয়ার্টার ফাইনাল খেলা। খেলা শুরুর আগে খেলোয়াড়রা বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত গাইতে শুরু করলো। বিদেশের মাটিতে বসে ‘আমার সোনার বাংলা’ শোনার অনুভুতি ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। অনেক ভালো লেগেছিল সেদিন। তখন বুঝলাম, ‘মাতৃভুমি কি জিনিস?’
ইতোমধ্যে শবনম ম্যাম আমাদের সাথে যোগ দিয়েছেন। ঐ বিকাল চারটায় আমদের কোলকাতা থেকে দিল্লীর উদ্দেশ্যে রওনা দেয়ার কথা। আখতার ম্যাডাম ঠিক করলেন দুপুর ২টায় আমরা হোটেল ছাড়বো। এরমধ্যে সবাইকে দুপুরের খাবার খেয়ে নেয়ার নির্দেশ দিলেন। কেউ দেরি করলে এর দায়ভার উনার না এটাও বললেন।
দুইটার দিকে মারক্যুইজ স্ট্রীট থেকে আমরা টেক্সিতে করে শিয়ালদাহ স্টেশনের দিকে রওনা দিলাম। ১৫ থেকে ২০ মিনিট লাগলো। সাড়ে চারটায় আমাদের ট্রেন। আড়াইটা থেকে সাড়ে চারটা পর্যন্ত আমাদের ওয়েটিং রুমে কাটাতে হলো। এরমধ্যে আমরা ট্রেন ঘুরে দেখেছি আর অনেক ছবি তুলেছি। এছাড়া সার্বক্ষনিক আড্ডা তো চলছিলোই। আমাদের ট্রেন ছিলো রাজধানী এক্সপ্রেস। সঠিক সময়ে আমাদের ট্রেন ছেড়ে দিল।
বিপত্তি দেখা দিলো, আমাদের সকলের সিট একসাথে ছিলো না। তবে একই কম্পার্টমেন্টে অন্তত দুই তিনজন ছিলো এজন্য তেমন সমস্যা হয় নি। রাজধানী এক্সপ্রেসের সিট থ্রি টাইয়ার বা টু টাইয়ার। আমাদের সব সিট মাঝের সারিতে অথবা উপরে। শাওরিন আপু আর আলিজার জন্য আমারা এক দাদাকে অনুরোধ করায় তিনি তার সিট টা ছেড়ে দিলেন। কিছুক্ষনের মধ্যে আমাদের নাস্তা (ট্রন থেকে বরাদ্দকৃত) চলে এলো। রাজধানীতে উঠলেন। এরপর আপনার দায়িত্ব শেষ। শুধু খাবার আর খাবার। সন্ধ্যা হতে না হতেই স্যুপ আর টোস্ট চলে এলো। স্যুপটার টেস্ট মনে থাকবে অনেকদিন। এরমাঝে চলছে হৈ হুল্লোড়, আড্ডাবাজি। অতঃপর রাতের খাবার এলো রাত আটটার দিকে। আমরা রাতের খাবার খেয়ে আড্ডা দিচ্ছি তখন রেজা আকাশ এলো। সে এক কান্ড ঘটিয়েছে। সে টয়লেটে সিগারেট খেয়ে পুলিশের কাছে ধরা খেয়েছে। স্যারকে বলা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিলো না। বাধ্য হয়ে স্যারকে বলতে হলো। স্যার অনেক কষ্টে ম্যানেজ করলেন। আকাশ ১২০০ রুপির জরিমানার হাত থেকে রক্ষা পেলো। আলিজার ঐ দিন ডায়রিয়া হয়েছিল। সে রাতে ট্রেনের একজন যাত্রী ড. ঘোষ খুব সাহায্য করেছিলেন। রাত একটার দিকে ঘুমাতে গেলাম। মধ্য টায়ারে আমার সিট। রাতে ঘুম আসতে দেরি হলো। তিনটার দিকে ঘুমিয়ে গেলাম।
(চলবে)