রাষ্ট্র বিজ্ঞানে বলা হয়েছে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য সমূহের একটি অন্যতম হল-বাক তথা মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও সরকারের সমালোচনা করা । কিন্তু আজ বাংলাদেশে এই বৈশিষ্ট্য লুপ্ত হল মাহমুদুর রহমানের গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে। গনতান্ত্রিক সরকার ব্যাবস্থা পৃথিবীর একটি সর্বাধুনিক শাসন ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থায় একজন নাগরিক সরকারের সমালোচনা করতে পারে কিন্তু তা অনেক আগেই বিদায় নিয়েছে। আর আলোচনা ও সমালোচনার মধ্য দিয়ে সরকার শিক্ষা নেয়। মাহমুদুর রহমান একজন দেশের খ্যাতিমান সাংবাদিক ও সাবেক জ্বালানী উপদেষ্টা। তাকে মূলত গ্রেফতারের কারণ সরকারের দুর্নীতি ও ব্যর্থতা পত্রিকায় তুলে ধরায়। সরকারের ব্যপক সমালোচনা করলেই গণতান্ত্রিক পদ্ধতি ও সরকারের অনুধাবন বৃদ্ধি পায়। কিন্তু সেই ধারণা পাল্টে গেছে।
গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা একটি সর্বোকৃষ্ট শাসন ব্যবস্থা। তবে গণতন্ত্র নিছক শাসনব্যবস্থা নয়,বরং সমাজ ব্যবস্থাও বটে। এটি বহুবিধ বিরল গুণের অধিকারী। এটিকে জনমতের শাসন ব্যবস্থা বলা হয়। তবে বাংলাদেশের জন্য এটা প্রযোয্য নয়। আবারও গ্রেফতার হলেন মাহমুদুর রহমান। বেশ কিছুদিন দৈনিক আমার দেশ-এর নিজ অফিসে অবরুদ্ধ থাকার পর গ্রেফতার হলেন তিনি। এর আগে ২০১০ সালের ১ জুন ভোরে তাকে পত্রিকার কার্যালয় থেকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। টানা দশ মাস সীমাহীন নির্যাতন ও কারাভোগের পর ২০১১ সালের ১৭ মার্চ মুক্তি পান তিনি। সব রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে যিনি রাতদিন বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও দ্বীন ইসলামের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। নিজের মেধা, যোগ্যতা, সাহস ও বিশ্বাস দিয়ে তিনি এগিয়ে যাচ্ছেন সামনের পানে। কোনো ধরনের মরণের ভয় যাকে স্পর্শ করে না, সত্যের পক্ষে কলম ধরে যুক্তির নিরিখে বাতিলকে একের পর এক পদাঘাত করছেন তিনি। জেল-জুলুম মাহমুদুর রহমানের কাছে কিছুইনা। মাহমুদুর রহমানের মতো সত্যের সাহসী বীর বাংলাদেশে এই মুহূর্তে নেই।
পবিত্র হাদিসে জালেমের সামনে হক কথা বলাকে জিহাদ হিসেবে বলা হয়েছে। মাহমুদুর রহমান কাউকে পরোয়া না করে সত্য কথা প্রচার করে আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন মর্দে মুজাহিদ কাকে বলে। মাহমুদুর রহমান ভারতের পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যার দাবিতে রাজশাহীতে মহাসমাবেশ করেছেন। টিপাইমুখে বাঁধ দেয়ার বিরুদ্ধে লংমার্চ করেছেন। ভারতকে করিডোর দেয়ার বিরোধিতা করেছেন তিনি। সরকারের সব ধরনের অন্যায়-অবিচারকে সুনিপুণ কায়দায় জনগণের সামনে প্রকাশ করেছে আমার দেশ পত্রিকা। রেল কেলেঙ্কারি, শেয়ারবাজার লুণ্ঠন, হলমার্ক কেলেঙ্কারি, পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারি, ডেসটিনি কেলেঙ্কারিসহ হাজারও দুর্নীতির সবিস্তার রিপোর্ট প্রকাশ করেছে দৈনিক আমার দেশ। যুদ্ধাপরাধীর বিচার সবাই চায়। কিন্তু যুদ্ধাপরাধের বিচার করার নামে প্রহসনের বিচার কেউ চায় না। মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারপতির স্কাইপ সংলাপ দৈনিক আমার দেশ সাহসের সঙ্গে জনসমক্ষে প্রকাশ করে দেয়। যে কারণে একজন বিচারপতি পদত্যাগ করেন। মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায় ঘোষিত হওয়ার পরপরই এ দেশে যে গণহত্যা শুরু হয়েছিল তার বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে একের পর এক রিপোর্ট করেছে দৈনিক আমার দেশ। মাহমুদুর রহমান ও দৈনিক আমার দেশ এদেশের স্বাধীনতা ও জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ। তাই দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠে দেশ ও দশের পাশে দাঁড়িয়েছের মাহমুদর রহমান ও তার পত্রিকা। মাহমুদুর রহমান এখন আর কোনো ব্যক্তি নন। মাহমুদুর রহমান একটি আদর্শের নাম। মাহমুদুর রহমান সত্যের পক্ষের সিপাহসালার। নৈতিকতার মানে অনুসরণীয় এক ব্যক্তিত্বের নাম মাহমুদুর রহমান।
একদিকে দেশে যেমন সুশাসন ব্যাহত হচ্ছে, অন্যদিকে গণতন্ত্রের নামে অগণতান্ত্রিক রাজনীতিরও চর্চা চলে আসছে। দেশ আজ কোন পথে ? এর উত্তর আদৌ আছে কি? এতে আমাদের গণতান্ত্রিক শাসন নিয়েও মানুষ সন্তুষ্ট হতে পারছে না। তার পরও দুই দশকের বেশি সময় ধরে দেশে নিরবচ্ছিন্নভাবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে। ভবিষ্যতেও একইভাবে দেশে গণতান্ত্রিক শাসন এবং সাংবিধানিক প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে- এমন আশা প্রকাশ করারও যথেষ্ট যুক্তিসংগত কারণ রয়েছে। দেশে বর্তমানে এক সংঘাতময় রাজনৈতিক অবস্থা বিরাজ করছে। ইসলামী ব্যাক্তিবর্গদের মানবতাবিরোধী অপরাধে আটক রাখছে বছরের পর বছর। বিচারপ্রক্রিয়ার বিরোধিতা করছে জামায়াত-শিবির।ছাত্রলীগ,যুবলীগ ও আওয়ামী লীগ দেশব্যাপী যে নৈরাজ্য চালাচ্ছে, তা শান্তিপ্রিয় যেকোনো নাগরিকের দুশ্চিন্তার একটি বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি জামায়াত নেতা আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুদণ্ডাদেশ হওয়ার পর থেকে তারা বিক্ষোব্ধ জনগনের উপর সারা দেশে সশস্ত্র হামলায় লিপ্ত হয়। প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সমর্থন থাকায় হিংসায় সাম্প্রতিক সময়ে তাদের আক্রমণের মাত্রা আরো তীব্র হয়। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা যেন ব্যাহত না হয় কিংবা শান্তিপূর্ণ থাকে- তা দেখার দায়িত্ব মূলত সরকারের। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার নামে যেন অগণতান্ত্রিক আচরণ করা না হয়, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে যেন আরো দুর্বল না করা হয়, সে বিষয়গুলোও সরকারকেই নিশ্চিত করতে হবে। গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধারায় ভিন্নমতের প্রতি সহনশীল হতে হবে। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে মতপার্থক্য দূর করার চেষ্টা অব্যাহতভাবে চালিয়ে যেতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, গণতান্ত্রিক শাসনের দুর্বলতাই অগণতান্ত্রিক শাসনের সুযোগ করে দেয়। কাজেই গণতন্ত্রকে স্থায়ী ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার জন্য আমাদের গণতান্ত্রিক শাসনের দুর্বলতাগুলোকেই আগে দূর করতে হবে। আমরা আশা করি, সরকার সেই লক্ষ্যেই সব কার্যক্রম পরিচালনা করবে এবং দেশের গণতান্ত্রিক শাসন প্রক্রিয়াকে সুদৃঢ় করবে। ক্ষমতাসীনরা প্রতিপক্ষকে গাল-মন্দ,মিথ্যা অপবাদ,কটুক্তি,বাজে কথা উচ্চারণ করছেন উঁচু সুরেই। তারা নিজদের কে কখনো দায়বদ্ধ ভাবেন না। তারা জনগনের ব্যালটে এসে অধিকার খাটাতে চান বেশি।
জাতীয় দৈনিকের ১৫ জন বিশিষ্ট সম্পাদক এক যুক্ত বিবৃতিতে ছাপাখানা খুলে দিয়ে দৈনিক আমার দেশ প্রকাশ, দিগন্ত ও ইসলামিক টিভির সম্প্রচার চালু এবং সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের মুক্তি দাবি করেছেন। মিডিয়ার ওপর সরকারের চলমান নগ্ন হস্তক্ষেপকে গণমাধ্যম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার আশঙ্কাজনক হুমকি বলে বেশ তারা উদ্বেগ প্রকাশ করেন। মাহমুদুর রহমানের মা ও দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকার সম্পাদকের মামলা প্রত্যাহার করারও দাবি জানান সম্পাদকেরা। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মাহমুদা বেগম ও দৈনিক সংগ্রামের সম্পাদক আবুল আসাদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা দায়ের এবং বেসরকারি টিভি চ্যানেল দিগন্ত ও ইসলামিক টিভির সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়ার ঘটনায় আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।’
‘দৈনিক আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে আইসিটি মামলায় গ্রেফতার করে পত্রিকার প্রেসে তালা লাগিয়ে দেয়া এবং কোনো কারণ না দেখিয়ে দিগন্ত ও ইসলামিক টিভি চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়া অনভিপ্রেত ও দুঃখজনক। অনিবার্য পরিণতি হিসেবে অনেক সাংবাদিককে বেকারত্বের অন্ধকারে নিক্ষেপ করা কোনো নির্বাচিত ও গণতান্ত্রিক সরকারের ভাবমূর্তির পক্ষে অনুকূল নয়।’ ১৯৭২-৭৫ সালে মিডিয়া বলতে কেবল সংবাদপত্রই বোঝাত।তাও আবার হাতেগনা, ইলেকট্রনিক মিডিয়া বলতে ছিল শুধুই বিটিভি আর বাংলাদেশ বেতার। যুগ, সময় ও প্রযুক্তিব্যাপক পাল্টিয়েছে। শুধু বদলায়নি আওয়ামী অপশাসকদের মনোবৃত্তি। উল্লিখিত সময়ে মিডিয়া তথা সব সংবাদপত্র আওয়ামী কীর্তন গাইত। শুধু গণকণ্ঠ, হককথা, স্পোকসম্যান, মুখপত্র এমন কয়েকটি সংবাদপত্র ছিল, যারা সরকারের ত্রুটিবিচ্যুতিগুলো ধরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করত। সরকারের ত্রুটিবিচ্যুতি ধরিয়ে দেয়া সরকারের পতন ঘটানোর ‘অপপ্রয়াস’ এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। ত্রুটিবিচ্যুতি ধরিয়ে দেয়ার লক্ষ্য হচ্ছে সরকার যাতে নিজেকে সংশোধন করে জনকল্যাণের পথে অগ্রসর হতে পারে। ১৯৭২-৭৫ সালে শেখ মুজিব সরকার এবং ২০০৯ সালের আওয়ামী ক্ষমতাসীন শেখ হাসিনা সরকারের সেটি উপলব্ধি করার কোনো ক্ষমতা নেই। শেখ মুজিবুর রহমানের ছিল না এখনও শেখ হাসিনারও নেই। সেই যে আওয়ামী লীগের মিডিয়াবিরোধী ভূমিকা শুরু হয়েছিল, তা এই সরকারের আমলেও অব্যাহত আছে। যত খুশি অন্যায় করো। আমরা তার বৈধতা দেবো। সংবিধান সংশোধন করে হলেও দেবো। সেই সরকার এই সমাজের শ্রদ্ধাভাজন রাজনৈতিক নেতাদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালিয়েছে। তারা থাকার চেষ্টা করেছিল বটে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের সেই চেষ্টা সফল হয়নি। মইনুউদ্দিন-ফখরুদ্দিনের যে সরকার চিরস্থায়ীভাবে ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছিল, জনবিচ্ছিন্নতার কারণে তাদের বিদায় নিতে হয়েছে।
একটা টেলিভিশন চ্যানেল চালু করতে প্রায় শত কোটি টাকা খরচ হয়। এখানে শত শত সাংবাদিক, টেকনিশিয়ান ও কর্মী নিয়োগ পান। কিন্তু কথা নেই, বার্তা নেই, সরকার মুহূর্তের মধ্যে যখন তখন বন্ধ করে দিতে পারছে, দিচ্ছে। এর জন্য কোনো আইনের ধার ধারছে না। ইচ্ছা, অতএব বন্ধ করে দিলাম। ভালো লাগছে না, অতএব বন্ধ করে দিলাম। বাংলাদেশে তা হামেশাই হচ্ছে। এখন মিডিয়া অবরুদ্ধ। বেশির ভাগ মিডিয়া সরকারের সেবাদাস। দু-একটা যা আছে, তারা আতঙ্কিত। কখন যে কী হয়!
এই পরিস্থিতি জোরদার হয়েছে গত ৫ মের পর থেকে। তার আগেও মিডিয়ার পরিস্থিতি তেমন স্বাভাবিক ছিল না। কিন্তু ৫ মে রাতে হেফাজতে ইসলামের অবরোধ কর্মসূচিতে যে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়, তার বিবরণী প্রচার করছিল দিগন্ত টিভি ও ইসলামিক টিভি। সত্য প্রকাশে ক্ষুব্ধ সরকার ওই রাতেই এ দু’টি টেলিভিশন কেন্দ্র বন্ধ করে দেয়,ও যন্ত্রপাতি নিয়ে আসে। টেলিভিশন কেন্দ্র দু’টির হাজার হাজার কর্মী মুহূর্তেই বেকার হয়ে পড়েন। কিন্তু বিচার চাওয়ার কোনো জায়গা নেই। প্রতিকারের কোনো পথ নেই।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই মে, ২০১৬ দুপুর ১:৪৯