আমার এটোর্নি আমাকে নির্দোষ প্রমান করার জন্য সবটুকু চেষ্টা করছেন। তিনি বারবার আমাকে শিখিয়ে পড়িয়ে নিচ্ছেন যে আমি আদালতে গিয়ে কোনো ভাবেই স্বীকার না করি যে আমিই জেনকে খুন করেছি। অস্বীকার নাহয় আমি করলাম,কিন্তু সত্যি তো এটাই যে আমার নিজ হাত দিয়েই আমি জেনকে হত্যা করেছিলাম।
জেনের সাথে প্রথম আমার দেখা হয় একটা বারে। এর আগেও ওকে বারে বেশ কয়েকবার দেখেছিলাম। সোনালী চুল আর নীল চোখের চৌকস জেনকে চোখে না পরার তো কোনো কারণ নেই। ওর বয়সী একটা তরুনী যখন সংক্ষিপ্ত পোষাকে এসে নেচে গেয়ে বার মাতিয়ে সবার দৃষ্টি লুফে নিতে চায়,তখন অপরূপা জেন এক কোনায় একটা গ্লাসে বিয়ার নিয়ে চুপচাপ বসে থাকত। ওর এই নীরব ব্যাপারটা আমাকে আকৃষ্ট করত। আমি সবসময় চেষ্টা করতাম ওর কাছাকাছি কোনো একটা টেবিলে বসার। কথা বলে খাতির করার চেয়ে ওকে দেখতেই আমার ভাল লাগত।
একদিন হঠাৎ শুনলাম জেন একা একা টিম আরথারের কয়েকটা লাইন আবৃত্তি করছে। টিম আরথার হলেন এসময়ের সব থেকে জনপ্রিয় কবি। অদ্ভুত এক রহস্য বজায় রেখে চলেছেন এই কবি। মাত্র ৯টি কবিতার জন্ম দেয়া এই কবি কোনো দিন লোকচক্ষুর সামনে আসেননি। কবিতায়গুলোও যেন ভয়াবহ রকম দূর্বোধ্য! আমি টিম আরথারের কবিতা নিয়ে গবেষনা করছি। আর এই সময় জেনের মুখে আরথারের কবিতা শুনে আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম- “এটা টিম আরথারের রক্তের স্বর্গ কবিতার লাইন।ঠিক না?”
ও আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে মিষ্টি করে হাসল।সেই থেকে আমাদের শুরু। প্রথম দিকে টিম আরথারকে নিয়ে গল্প করেই আমাদের সময় কেটে যেত। আরথারের যে কবিতাগুলোর রহস্য বের করার জন্য আমি গলদঘর্ম হয়ে যেতাম, জেন কিভাবে যেন খুব সহজেই সেসবের অর্থ পেয়ে যেত। ওর প্রজ্ঞা আমাকে দিনকে দিন মুগ্ধ করছিল। আমি চিরটা কাল তো এমন কাউকেই চেয়েছিলাম যে কেবল বিছানার সঙ্গী হবে না,বরং হয়ে মনের সঙ্গী। একটা সময় যে জেন আমার কাছে সোনালী চুল আর নীল চোখের অধিকারী কেবল এক সুন্দরী মানবী ব্যতীত আর কিছুই ছিল না,সেই হয়ে উঠল আমার ছায়াসঙ্গিনী। আমার মনে হতে লাগল-আমি সমগ্র জীবনে এই মানুষটাকেই খুজে ফিরেছি।
আমার গবেষণা কাজ বেশ দ্রুত এগোচ্ছিল।সারাদিন আমি টিম আরথারকে নিয়ে পড়ে থাকতাম। বিকালবেলা জেনের সাথে দেখা করতে বারে যেতাম। সেখানেও টিম আরথার থাকতেন আমাদের গল্পের বিরাট অংশ জুড়ে।মাঝে মাঝে মনে হত-টিম আরথার আসলে আমাদের প্রেমেরই একটা অংশ। কোনো কোনো বিকালে আমি আর জেন হ্রদের কাছে বেড়াতে যেতাম। কোনো কথা না বলে চুপচাপ ঘন্টার পর ঘন্টা পাশাপাশি বসে থাকতাম। নীরবতারও যে একটা ভাষা আছে তা জেন না থাকলে কার আছ থেকে শিখতাম?
এক সময় আবিষ্কার করলাম,আমাদের পক্ষে আর আলাদা থাকা সম্ভব নয়। আমি মাঝে মাঝে জেনের বাড়িতে গিয়ে থাকতাম। জেনের বাড়িতে জেন একাই থাকত। ওর মা-বাবা-ভাই কেউই বেচে নেই। আমার মাঝে মাঝে অবাক লাগত,কি করে এত বড় বাড়িতে এরকম একটা মেয়ে একা থাকে? যা হোক,সময়টা কতটা মধুময় ছিল তা বলে বোঝানো যাবেনা।
জেনের বাড়িটা বেশ সেকেলে। তবে তাতে আভিজাত্যের কমতি নেই। জেনের দাদার একটা বিশাল লাইব্রেরি আছে। সেই লাইব্রেরিতে কত যে বই তা গুনে শেষ করা যাবে না।কম করে হলে তাতে লাখের উপর বই আছে! কিন্তু জেন আমাকে সেই লাইব্রেরীতে ঘেষার সময়ই দিত না। জেনের প্রেমের ধরনটা অনেকটা কিশোরী প্রেমের মত। যতক্ষন তার পাশে থাকব,ততক্ষণ তাকেই আগ্রহের কেন্দ্র-বিন্দু করে রাখতে হবে।আমার তাতে আপত্তি নেই। আমি তো জেনকেই ভালবাসি।আমার আপত্তি থাকবে কেন।
কিন্তু সময় সব সময় সুন্দর থাকে না।যে জেন একটা সময় প্রতিটা মুহূর্তে আমাকেই প্রার্থণা করত,সেই জেন কেমন জানি বদলে যেতে শুরু করল। না সে অন্য কোনো পুরুষে মোহগ্রস্থ হয়নি। কিন্তু কি কারণে যেন ভীষণ অস্থির হয়ে থাকত সব সময়! আমি ওর পাশে এসে বসলে ও সেই জায়গা ছেড়ে উঠে যেত।মাঝে মাঝে অপরাধীর মত হাউমাউ করে কাদত আর মাফ চাইত। আমি বারবার জানতে চাইতাম-“সে কিসের জন্য মাফ চাইছে?”
ও আমার প্রশ্নের কোনো জবাব দিত না,বরং আমাকে জাপটে ধরে আরো ভীষন ভাবে কাদতে থাকত?
সেদিন আমি ওর বাড়িতে ছিলাম।সকালবেলা ঘুম থেকে জেগে দেখি বিছানায় ও নেই। সব জায়গায় খুজলাম দেখি কোথাও নেই জেন। বাড়ির বাইরে থেকে লক করে রেখে গিয়েছে। কোথাও যে বের হব সেই উপায়ও নেই। এই সু্যোগে আমি ওর লাইব্রেরীতে ঢুকে বইপত্র নাড়াচাড়া শুরু করে দিলাম। লাইব্রেরীতে শুধু বই আছে বললে ভুল হবে,বেশ কিছু পান্ডুলিপিও আছে। কিছু পান্ডুলিপি নাড়াচড়া করে আমি ধাক্কা খেলাম। আলেকজান্ডার টমসনের পাণ্ডুলিপি এখানে কি করে আসল? কিছুক্ষণ পড়েই বুঝলাম- জেন উনিশ শতকের অন্যতম মহান কবি আলেকজাণ্ডার টমসনের উত্তরসূরী! এবার আমি বুঝতে পারলাম কি কারণে সাহিত্যে জেনের এমন প্রজ্ঞা। আমার ভাবতে ভাল লাগল,আমার সঙ্গিনী একজন মহান কবির নাতনী! আমার মত একজন সাহিত্য গবেষকের কাছে এতো অবশ্যই মূল্যহীন কোনো ব্যাপার নয়।
একটার পর একটা পান্ডুলিপি দেখতে দেখতে বেশ ভিতরের দিকে একটা ডায়েরী গোছের কিছু চোখে পড়ল। এটা পান্ডুলিপিগুলোর মত চামড়ায় বাধানো নয়।বরং ডায়েরীটা তুলনামূলক নতুন।বেশ আগ্রহ নিয়েই খুললাম। হাতের লেখা দেখে বুঝলাম এটা জেনের ডায়েরী। প্রথম দিকে মনে হচ্ছিল এটা জেনের লেখা কোনো গল্প হতে পারে।কিন্তু পরে বুঝলাম এটা ওর নিজস্ব ডায়েরী। আমি বিস্মিত হয়ে পড়তে থাকলাম।কি লিখেছে ও এসব।
“আমার বয়স তখন ১৬।আমি আমার জীবনের প্রথম কবিতাটি লিখে ফেলেছি।
কিন্তু লিখতে গিয়ে আমি আমার প্রথম খুনটা করে ফেললাম।নাহ,কোনো মানুষকে
নয়। আমি আমার পোষা বিড়াল টুইকে হত্যা করলাম।এই বিড়ালটাকে আমি
প্রচন্ড ভালবাসতাম। ওকে না খাইয়ে আমি খাবার খেতাম না।ও ছিল আমার
সন্তানের মত! কিন্তু হঠাত গ্রাণ্ডপার কবিতা পড়ার পর আমার খুব কবিতা
লিখতে ইচ্ছা হল।আমি কোনোভাবেই কবিতা মেলাতে পারছিলাম না।নানা
ভাবে চেষ্টা করলাম। দিনের পর দিন স্কুল থেকে আর বাড়ি না ফিরে রাস্তায়
রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছি কেবল কবিতা লেখার জন্য। কিছুতেই কিছু হল না।
সেদিন টুইকে নিয়ে খেলা করতে গিয়ে হঠাত মনে হল-যদি আমি যদি টুইকে
হত্যা করি তাহলে হয়তো আমি কবিতা লিখতে পারব। প্রায় একই সাথে দরজার
কাছে একটা লোহার রড পেয়ে গেলাম।আমি দৌড়ে সেই রডটা চুলায় ঢুকিয়ে
গরম করে আনলাম। আমি যেন তখন একটা ঘোরের ভিতর চলে গিয়েছি।
আমি কি করছি সেই ব্যাপারে আমার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।আমি জলন্ত রডটা
টুইয়ের মাথায় ঢুকিয়ে দিলাম। ও ছটফট করছিল।আমি ওর মৃত্যুটাকে নিশ্চিত
করতে আবারো রডটা ওর মাথায় ঢোকালাম। তারপরেও যেন আমার তৃষ্ণা
মিটছিল না।আমি রড দিয়ে ধুমধুম করে পিটিয়ে ওর মাথাটা থেতলে দিলাম।
কোনো ভাবে ওর লাশটা ডাস্টবিনে ফেলে আমি খাতা কলম নিয়ে বসলাম।
হ্যা,সেদিন আমি লিখতে পারলাম।আমি সত্যিকারের কবিতা লিখতে পারলাম।”
লেখাটা পড়ার পর আমার গা শিউরে উঠল। জেনের মত নিষ্পাপ চেহারার মেয়ে এমন বিভৎষ ভাবে একটা বিড়ালকে মারতে পারে তা আমার চিন্তার অতীতে ছিল।আমি আবার পড়তে শুরু করলাম।
ঐ কবিতা লেখার পরের এক বছর আমি কোনো কবিতা লিখতে পারিনি।
টুইকে হত্যা করার পর আমাকে একটা দুঃখ গ্রাস করেছিল।কিন্তু যখনই
মনে হত, টুইকে হত্যা করার পর আমি কবিতা লিখতে পেরেছি,এমনটা
ভাবলেই আমার দুঃখ স্তিমিত হয়ে যেত। কিন্তু এক বছরের মাথায় আমার
ভিতরে আবার কবিতা লেখার জন্য অস্থিরতা তৈরী হয়ে গেল। কিন্তু এখন
আমি কিভাবে কবিতা লিখব? আমি আর কাকে হত্যা করব? এসময়ে আমার
টমসন জুনিওরের কথা মনে হল।ওর বয়স ৯ বছর। আমার আপন ছোটো ভাই।
ওকে আমি প্রচন্ড ভালবাসি। এই মুহূ্র্তে ওকে হত্যা করাই নিরাপদ।আর ইতিমধ্যে
আমি বুঝে ফেলেছি,সব থেকে প্রিয় জিনিসগুলো হত্যা করলেই আমি কবিতা লিখতে
পারব। আমি তক্কে তক্কে রইলাম। সুযোগ পেয়েও গেলাম। আমার চাচা ফ্লেক ছিল
মানসিকভাবে অসুস্থ্য।মা-বাবা মাঝে মাঝেই তাকে দেখতে যেত।আমি সেই সুযোগটা
নিয়ে ফেললাম। একসাথে সেদিন স্কুল থেকে ফিরে ওকে নিয়ে গোসল করতে চলে
গেলাম।বাথটাবে আগেই পানি জমিয়ে রেখেছিলাম। টমসনকে নিয়ে ও কিছু বোঝার
আগেই ওকে শক্ত করে ঘাড় ধরে পানিতে ওর মাথাটা চেপে ধরলাম।ও অনেক সময়
ছটফট করার পর নির্জীব হয়ে গেল।আমি আর দেরী না করে দৌড়ে কবিতা লিখতে বসে
গেলাম।কবিতা লেখা শেষে ওকে বাথটাবে ডুবিয়ে রাখলাম। ডুবানোর আগে দেখে নিলাম
ওর ঘাড়ে আমার হাতের কোনো চিহ্ন আছে কিনা!নাহ কোনো দাগ নেই। তারপর হুলূস্থুল
আর চিৎকার করে প্রতিবেশীদের ডাকলাম।কেউ আমাকে সন্দেহও করল না।
আমি দম আটকে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা পড়ে গেলাম। জেন শুধু তার ভাইকে খুন করেনি।তার মা বাবাকেও খুন করেছে আঠারো বছর বয়সে। ওরা সামার কাটাতে সমুদ্রে গিয়েছিল।সেখানেই হোটেলেরুমে আগুন লাগিয়ে দেয় জেনি।তাতে ওর বাবা-মা সহ আরো তিনজন মারা যায়। ওর নিজেরও হাত-পায়ের অনেক অংশ পুড়ে গিয়েছিল। পাচজন মানুষকে হত্যার প্রাপ্তি হিসাবে ও আরো একটা কবিতা লিখতে পেরেছিল। এরপর একে একে ও আরো ৬টি হত্যাকান্ড চালায়। এক এক জনকে হত্যা করে একেক ভাবে। সবচেয়ে বড় কথা যে নয়জন মানুষকে সে হত্যা করেছে তাদের প্রত্যেকেই তার খুব কাছের কিছু মানুষ।
ওর ডায়েরীটা পড়তে পড়তে কোন মুহূর্তে যে জেন আমার পাশে নিঃশব্দে এসে দাড়িয়েছে আমি খেয়াল করিনি। ওর দিকে তাকাতেই দেখলাম ক্রূরভাবে ও আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। আমি বুঝতে পারছি,এবার আমার পালা। এই ডাইনীটা এবার আমাকে খুন করবে। আমি কোনো ভাবে উঠে দাঁড়িয়ে পালিয়ে যেতে চাইলাম। কিন্তু তার আগেই ও পিছনে গিয়ে আমার গলায় চিকন একটা শিকল দিয়ে পেচিয়ে ধরল। আমি ছটফট করা শুরু করলাম।আমি শুনতে পেলাম জেনি আমাকে বলছে, “তোমাকে আমি ভালবেসে ফেলেছি স্যাম।কিন্তু তোমাকে খুন না করলে যে আমার ১০ নম্বর কবিতাটা লেখা হবে না।মৃত্যুর আগে একটা গোপন তথ্য জেনে যাও।আমিই তোমার সেই প্রিয় রহস্যময় কবি টিম আরথার!”
ও আরো কি কি যেন বলছিল!আমি তখন প্রাণ বাচানোর জন্য ছটফট করছিলাম।হঠাৎ দেখলাম আমার সামনের টেবিলেই একটা এন্টিকাটার পড়ে আছে।আমি ওটা দিয়ে জেনের হাতে পোচ বসাতে লাগলাম। ওর ধরে রাখা শেকলের বাধন খানিকটা আলগা হতেই প্রাণপনে ওটা ছাড়িয়ে দৌড়ে লাইব্রেরী থেকে বের হয়ে গেলাম।জেনও আমার পিছন পিছন ছুটে আসতে লাগল। দরজার কাছে গিয়ে দেখি দরজা লক করা। আমি দরজা খোলার জন্য পাগলের মত চেষ্টা করছি,তখন পিছনে ফিরে দেখি জেন একটা হাতুড়ি নিয়ে আমার মাথায় আঘাত করার জন্য উদ্দত হয়েছে।আমিও তখন জ্ঞানশূন্য! ওর হাতটা কোনোভাবে চেপে ধরে ওর হাত দিয়ে হাতুড়িটা কেড়ে নিয়ে সেটা ওর মাথাতেই বসিয়ে দিলাম। না আমি ওকে খুন করতে চাইনি। কিন্তু আমি লক্ষ্য করলাম জেনের যে দেহটা আমার পায়ের কাছে পরে আছে,তাতে কোনো প্রাণের অস্তিত্ব নেই।
আমিই জেনকে খুন করেছি।খুন করেছি আমার প্রিয় কবি টিম আরথারকে। কবি টিম আরথার নামের ছদ্মবেশী জেন আমাকে হত্যা করলে হয়তো তার দশম কবিতার রশদ জোগাতে পারত। কিন্তু আমি তো তা হতে দেইনি। আমার মত ক্ষুদ্র মানুষের কারণে পৃথিবী বঞ্চিত হয়েছে টিম আরথারের কালজয়ী কবিতা থেকে! আজকাল মনে হয় জেনির আড়ালে যে টিম আরথার লুকিয়েছিল তার হাতে মৃত্যু হলে আমার ক্ষতির পরিমান তেমন কি বেশী হত?