একটা বিশাল পুকুরে সাঁতার কাটছিলাম।আর দীপ্ত ভাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার সাতার দেখছেন।হঠাৎ আমি ডুবে যেতে শুরু করলাম।অনেক চেষ্টা করেও উঠতে পারছি না।আমি খুব চেষ্টা করছি ভেসে ওঠার।তবুও পারছি না।পুকুর ঘাটে দাঁড়ানো দীপ্ত ভাইকে দেখলাম আমাকে বাচানোর বদলে খুশিতে হাত তালি দিয়ে বলছে, “হ্যা এভাবেই সাতার শিখতে হয়!এভাবেই সাতার শিখতে হয়!” আমি একসময় পানিতে ডুবে যেতে শুরু করলাম।স্বপ্নের এই পর্যায়ে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল।এই অদ্ভুত স্বপ্ন দেখে আমি অবাক হইনি।কারণ আমি এই স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানি।
দীপ্ত ভাই আমার ভাইয়ের বন্ধু।এই মানুষটাকে আমি ভয়াবহ রকম ভালবাসি।একটা মেয়ের স্বপ্নের পুরুষ হতে যত রকম যোগ্যতা লাগে সব এই মানুষটার আছে।আমাদের বাড়িতে তার অবাধ বিচরণ।ভাইয়ার আর কোনো বন্ধু আমাদের বাড়িতে এতটা প্রশ্রয় পায়নি।যতটা দীপ্ত ভাইয়া পেয়েছে।আমার মা সম্ভবত দীপ্ত ভাইয়ের প্রতি আমার উচাটন ভাবটা বুঝতে পেরে তার হাতে আমাকে গছিয়ে দিতে চান।সব মায়েরই স্বপ্ন থাকে মেয়ের ভাল কোথাও বিয়ে হবে।দীপ্ত ভাইয়ের মত ছেলেকে মেয়ে জামাই বানানোর লোভ কম মা-ই ছাড়তে পারবেন।
দীপ্ত ভাইয়া আমাকে মোটেই পাত্তা দেয় না।দুই-তিন দিন পরপরই আমাদের বাড়িতে আসে।কিন্তু প্রয়োজন ছাড়া আমার সাথে কথাও বলে না।বাসায় এসেই সরাসরি ভাইয়ার রুমে ঢুকে পড়ে।দরজা আটকে সিগারেট খায়,তাস খেলে!হয়তো এসবের বাইরে আরো কিছু করে।খানিকটা লাল পানি খায়,হয়তো তার সাথে ব্লু-ফিল্মও দেখে।তারা যে মদ খায় এ ব্যাপারে আমি একদম নিশ্চিত।রুমে বোতল পেয়েছি।তবে ব্লু-ফিল্মের ব্যাপারটা নিশ্চিত না।তবুও বলছি দেখে।কারণ মদ খাওয়ার সময় ব্লু-ফিল্ম না দেখলে সম্ভবত অন্যায়টা ১০০তে ১০০ হতে পারেনা।
আমার মায়ের গর্ভে দুটো বিপরীত মানুষের জন্ম হয়েছে।আমি যতটা সৎ,আমার ভাই ঠিক ততটা দুশ্চরিত্র।গতবছর আমার ভাই আইবিএ থেকে পাশ করে বিশাল বেতনের একটা চাকরী পেয়েছিল।১বছর সেই চাকরী করার পর সেটা ছেড়ে দিয়ে এখন সারাদিন বাসায় বসে থাকে।মাঝে মাঝে সেজেগুজে বেড়িয়ে যায়।যাওয়ার আগে বলে যায়, “তনু ডেটিং-এ যাচ্ছি।দোয়া করিস।”
ভাইয়ার মদ খাওয়া,মেয়ে পটানো স্বভাব কিছুই আমার মনে দুশ্চিন্তার জন্ম দেয় না।আমার চিন্তা হয় দীপ্ত ভাইয়ের জন্য।সেও কি ভাইয়ার মত নানা ঘাটের জল খেয়ে বেড়াচ্ছে?
আজ বিকালেও দীপ্ত ভাইয়া এসেছে।ভাইয়া বাসায় নেই দেখে ঝুল বারান্দায় বসে মোবাইল গুতাছে।আমি দীপ্ত ভাইয়ার সামনে গিয়ে বললাম-ভাইয়া চা খাবে?
-দাও।
আগেই চা বানিয়ে রেখেছিলাম।বলার সাথে সাথে দুই কাপ চা নিয়ে দীপ্ত ভাইয়ার সামনের চেয়ারে গিয়ে বসলাম।দীপ্ত ভাই আমার হাত থেকে চা নিয়ে আবারো মোবাইল চাপতে লাগল।
-দীপ্ত ভাইয়া,তুমি আসার আগে ভাইয়াকে একটা ফোন দিয়ে আসলে এখন আর তোমাকে একা একা বসে থাকতে হত না।
-সৌরভ এখনই চলে আসবে।আমি আসার আগে ওকে ফোন করেই এসেছে।
-ওহ তাই বল!
আমি আর কোনো কথা খুজে পাই না।দীপ্ত ভাইয়া আমার সাথে কথা বলায় তেমন আগ্রহীও না।সে আপন মনে মোবাইল চাপছে।কি দেখছে এত মনোযোগ দিয়ে?এমন কি হতে পারেনা এখন সে আমারই পাঠানো খুদেবার্তাগুলো পড়ছে?একটা অজানা নম্বর থেকে রোমান্টিক খুদেবার্তা আসছে-এটা খুবই ভাল লাগার একটা ব্যাপার!দীপ্ত ভাই কি জানে যে এসব আমারই পাঠানো?
আমি দীপ্ত ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে দেখি সে পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করেছে।ইতস্তত করছে আমার সামনে টান মারবে কিনা।আমার হঠাৎ দীপ্ত ভাইকে চমকে দিতে ইচ্ছে হল।
আমি তার সামনে থাকা সিগারেটের প্যাকেটটা থেকে সিগারেট বের করে আগুন জ্বালিয়ে একটা টান দিলাম।দীপ্ত ভাইয়ার অবাক মুখের দিকে তাকিয়ে একটা হাসি হেসে সিগারেটটা হাতে নিয়ে ঘরের ভিতর চলে গেলাম।আমার খুব কাশি আসছে।কিন্তু কাশি দিলে দীপ্ত ভাইয়ার চমক কেটে যাবে।একারণেই ঘরের ভেতর চলে আসলাম।কোনো ভাবে সিগারেটটা নিভিয়ে ফেলে দিলাম।হঠাৎ মেঝের উপর পরে থাকা সিগারেটটার দিকে তাকিয়ে আমার ভীষন রকম কান্না আসল।আমি কেন কাদছি জানিনা!
প্রতিরাতে ঠিক সাড়ে এগারটার সময় সুজন আমাকে ফোন দেয়।সুজন আমার ক্লাসমেট।এই ছেলেটা কিভাবে যেন আমার প্রেমে পড়ে গিয়েছে কিন্তু সেটা বলার সাহস তার নাই।আমিও সব বুঝে না বোঝার ভান করে আছি।কারণ আমি ভালবাসার ব্যাকুলতা বুঝি।আমিও তো দীপ্ত ভাইয়াকেও একই ভাবে ভালবাসি!
সুজনের সাথে বেশ কিছু ব্যাপারে আমার মিল আছে।মজার ব্যাপার হল-আমি যেমন দীপ্ত ভাইয়াকে আমি যেমন অচেনা নম্বর থেকে ম্যাসেজ পাঠাই,সুজনও আমাকে অপরিচিত নম্বর থেকে ম্যাসেজ পাঠায়।তবে সুজন এখনও জানেনা যে আমি এই ব্যাপারটা ধরে ফেলেছি।
একদিন কথায় কথায় সুজনকে বললাম, “সুজন,আমাকে একটা আননোন নম্বর থেকে কে যেন বেশ রোমান্টিক ম্যাসেজ পাঠায়।তুই একটু ঐ ব্যাটাকে গালি দিতে পারবি?”
-ওকে।তুই নম্বরটা দে।
সুজন ভেবেছিল আমি ওকে ওর নম্বরটাই দেব।কিন্তু সেটা না দিয়ে আমি যে নম্বর দিয়ে দীপ্ত ভাইকে ম্যাসেজ পাঠাই সেই নম্বরটা দিলাম।নম্বরটা দেখে সুজন ভ্রু কুচকে বলল, “শুধু এই নম্বরটা থেকেই তোর কাছে ম্যাসেজ আসে?”
-না,শুধু এটা না।আরো কয়েকটা নম্বর থেকেই ম্যাসেজ আসে।তবে ওসব ফালতু।তবে এটা থেকে কি যে রোমান্টিক মেসেজ আসে,কি বলব!
-আচ্ছা,তুই ভাবিস না।আমি শালারে প্যাদায়ে দিব।
সেদিন রাতে সুজন আমার ফাদে পা দিল।সে আমাকে আমার নম্বরেই মেসেজ পাঠালো।তাতে লেখা,
“ঐ শালা,তুই আমার প্রেমিকার কাছে আর কোনোদিন যদি এসএমএস করিস
তাইলে তোর খবর আছে।”
সুজনের মেসেজ পড়ে আমি হাসিতে ভেঙ্গে পড়লাম।বোকা ছেলেটা যদি জানত সে তার প্রেমিকার কাছেই মেসেজ পাঠেয়েছে!
আমার মা-বাবা শপিং-এ গিয়েছেন।আমার বাবার শপিং-এ যাওয়া না যাওয়া সমান কথা।মা এই দোকান থেকে অন্য দোকানে যান।আর বাবা তার পেছন পেছন পোষ্য কুকুরের মত ঘোরেন।বাবা কোনো একটা জিনিস পছন্দ করলে মা সেই জিনিসটা তার হাত দিয়ে কেড়ে নিয়ে বলবে, “এই তুমি জিনিসপত্রের কিছু বোঝো নাকি?আমাকে দেও আমি দেখি!”
আমার মায়ের এই এক সমস্যা।নিজেকে বড় বেশী জ্ঞানী ভাবেন।আমার বাবা ঝানু ব্যবসায়ী।বাবার বঙ্গবাজারে বেশ কয়েকটা কাপড়ের দোকান আছে,কাওরান বাজারে বিশাল চালের আড়ত আছে,ফার্মগেটে দুটো ঔষধের দোকান আছে,নীলক্ষেতে বইয়ের দোকান আছে,বেশ কয়েকটা চেইন শপ আছে।আমার সেই বাবা যদি ভাল জিনিস না চেনেন তাহলে এজগতের কেউ জিনিস চিনবে না।কিন্তু আমার বোকা মা তা বোঝে না।বাবাকে সব সময় ছোটো করার কেমন একটা প্রবণতা মায়ের ভিতর।এই মহিলা একদিন ভয়াবহ রকম প্রতারিত হবে।সবার কাছে প্রতারিত হবে!
-আপু দীপ্ত ভাইয়া আসছে।দরজা খুলমু?
-না।আমি নিজেই খুলব।তুমি যাও।
-বড় ভাইয়া তো ঘুমায়,হেরে জাগায়ে দেই?
-না।আর একটা কথা শোনো।তুমি একা কখনও ভাইয়ার ঘরে যাবেনা।
জুলেখা আমার কথা শুনে চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।জুলেখা আমাদের কাজের মেয়ে।এই মেয়েটার ভিতর একটা আহবান করার ব্যাপার আছে।অনেকটা “ইউসুফ-জুলেখা”র সেই জুলেখার মত স্বভাব।আমি একাধিক দিন তাকে জানালা দিয়ে আসেপাশের বাসার ড্রাইভারদের সাথে ইশারায় কথা বলতে দেখেছি।
দরজা খুলে দেখি দীপ্ত ভাই দাঁড়িয়ে আছে।
-দীপ্ত ভাই,ভাইয়া তো বাসায় নেই।
-তাই নাকি?কিন্তু সৌরভ যে বলল ও বাসায় থাকবে এখন।
-একটু আগে বেড়িয়ে গেল।যাওয়ার আগে তোমাকে দেয়ার জন্য একটা খাম দিয়ে গিয়েছে।তুমি ভিতরে এসে বস।
দীপ্ত ভাই বসতেই আমি ভিতর থেকে দুটো আইস্ক্রিম এনে একটা দীপ্ত ভাইয়ার হাতের সামনে ধরলাম।দীপ্ত ভাই বিরক্ত হয়ে বললেন-এটা কেন?
-আগে খাও।তারপর বলছি।
খাওয়া শেষ করে দীপ্ত ভাইয়াকে বললাম-এখন যাও।ভাইয়া ওর রুমেই আছে।নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে।
আমার কথা শুনে দীপ্ত ভাই অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।আমি শিষ বাজাতে বাজাতে তার সামনে দিয়ে চলে গেলাম।আগে আমি শীষ বাজাতে পারতাম না।কিন্তু এখন দীপ্ত ভাইয়াকে চমকে দেবার জন্য তাও শিখেছি।দীপ্ত ভাইয়া চমকে যেতে ভালবাসে।আমি নাহয় তাকে চমকে দিয়ে একদিন তার আর ভাইয়ার সাথে বসে লাল পানিও খাব।
আমি আর সুজন এখন বেইলি রোডের একটা রেস্তোরায়।আজ সুজনের জন্মদিন।আমি আগে সেটা জানতাম না।তাই কোনো উপহার আনতে পারিনি।পরে একটা উপহার দিলেও চলবে।আমি যদি আমি ওকে একটা ঝাড়ুও উপহার দেই,তবে সেটাও সে সারাজীবন যত্ন করে রেখে দেবে।
আমি কেকের উপর মোমবাতি লাগাচ্ছি,আর সুজন খাবার আনতে গিয়েছে।হঠাৎ দেখি কয়েক টেবিল পরেই দীপ্ত ভাই বসে আছে।সাথে সাথেই আমি প্লান করে ফেলি আজকে আমি সুজনের সাথে অনেক ন্যাকামী করব।সুজন খাবার নিয়ে টেবিলে বসতেই আমি ওকে বললাম, “সুজন,কয়েক টেবিল পরে আমার বড় ভাইয়ের এক বন্ধু বসা।আমি একটু তার সাথে কথা বলে আসি।”
দীপ্ত ভাইয়া এক দৃষ্টিতে আমাকে দেখছিল।আমি তার সামনে গিয়ে বললাম, “ভাইয়া,আমার বন্ধুর জন্মদিন।তুমি আমাদের সাথে এসে কেক কাটবে?
দীপ্ত ভাইয়া গম্ভীর হয়ে বললেন, “নাহ।তোমরা নিজেরাই উপভোগ কর।”
আমি আর সাধলাম না।এমন ভাব করলাম যেন আমি কেবল ভদ্রতা করেই বলেছি।
সেদিন আমি সুজনকে অবাক করে সুজনকে কেক খাইয়ে দিলাম।গালে কেক লাগিয়ে দিলাম।সুজনও সেই সুযোগে আমার নাকে কেক লাগিয়ে দিল।
আর দূর থেকে আমাদের রংঢং দীপ্ত ভাই দেখল।
আমি ভেবেছিলাম,এই ঘটনার পর দীপ্ত ভাইয়া আমার প্রতি আকৃষ্ট হবে।কিন্তু তেমন কিছুই হল না।
এর ভিতরে হঠাৎ একদিন দীপ্ত ভাই আমাকে ফোন দিলেন।
-তনু তোমাকে একটা কথা বলতে ফোন দিলাম।আমি মাস দুইয়ের জন্য দেশের বাইরে ট্যুরে যাচ্ছি।তুমি একটু সৌরভের দিকে খেয়াল রেখো।ওর মানসিক অবস্থাটা ভাল নেই।
-কেন?ভাইয়ার আবার কি হয়েছে?
-ওর ব্রেক আপ হয়েছে কিছুদিন আগে।ওর ভিতরে একটা সুইসাইড করার টেন্ডেন্সি এসেছে।
আমার এবার হাসি আসল।ভাইয়া ব্রেকআপের পর সুইসাইড করবে-এটা খুবই রিডিকুলাস!
-দীপ্ত ভাইয়া,তুমি এখনো ভাইয়াকে ভাল করে চিনতে পারোনি।ও কখনই ছ্যাকা খেয়ে আত্মহত্যা করার মত কাজ করবে না।
-তনু,তোমাদের পরিবারের সবার একটা সমস্যা কি জানো?তোমরা এত বেশী আত্মকেন্দ্রিক যে কেউই কাউকে চেন না!
কথাটা বলেই দীপ্তভাইয়া ফোন রেখে দিল।আমি কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলাম।কি ভীষন সত্যি কথা!যেটা নীরবে এতদিন চলে আসছিল,আজ তা প্রকাশ হয়ে আসল।
অনেক দিন পর আমি শপিং-এ গেলাম।ভাইয়ার জন্য একটা গিটার কিনতে এসেছি।এককালে ও গিটার বাজাত।এখন ছেড়ে দিয়েছে।সুজনের জন্য একটা হাত ঘড়ি কিনলাম।আর কিনলাম একটা ছোট্ট বাক্স।বাক্সের ভিতরে একটা ছোট কাল পাথর তাতে ছোটো ছোটো নীল পাথর জ্বলজ্বল করে।এটা কোনোদিন যদি সুযোগ হয় দীপ্ত ভাইয়াকে দেব।
রাতের বেলা গিটারটা ভাইয়ার হাতে দিয়ে বললাম-ভাইয়া,প্রতি রাতে আবার আগের মত গিটার বাজাতে পারবি না?
ভাইয়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “পারব”
কথাটা শুনে আমার মনে হল,ভাইয়া আর যাই করুক আত্মহত্যা করবে না।
এর ভিতরে বাবা মা তাদের ছাব্বিশ তম বিবাহ বার্ষিকী উদযাপন করল।প্রতি বছরই ভীষন নাটকীয়তার ভিতর দিয়ে দিনটি পালিত হয়।মা-বাবার আদিখ্যেতা সীমা ছাড়িয়ে যায়।তবে বেশীদিন বোধহয় আর এই নাটক চলবে না।কারণ ভিতরে ভিতরে ভয়াবহ একটা কাণ্ড ঘটা শুরু হয়েছে।
সুজনকে ঘড়িটা উপহার দিয়েছিলাম।উপহার পাওয়ার পর দেখলাম তার দুই চোখ ছলছল করছে।আমি কিছুটা বিরক্ত হয়ে সুজনকে ধমক দিতে যাব তখন ওর দিকে তাকিয়ে আমার বুকটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠল।এই সরল সহজ ছেলেটার জন্য আমার হৃদয়ের কোথাও কি কোনো জায়গা সৃষ্টি হয়েছে?যদি না হয়ে থাকে তাহলে আমার হঠাৎ এমন লাগল কেন?
দীপ্ত ভাই দুই মাস পর দেশে ফিরে আবার আমাদের বাসায় আসলেন।ভাইয়া বাসায় ছিল না।আমাকে দেখে নিজে থেকেই জিজ্ঞাসা করলেন-কি ব্যাপার তনু?কেমন আছো?
-এই তো ভাল।তোমার খবর কি?কখন এসেছো?
-এই তো ঘন্টাখানেক।একা একা ভাল লাগছে না।তুমি বস।তোমার সাথে গল্প করি।
আমি এমন একটা ভাব নিয়ে বসলাম যেন নিতান্ত অনিচ্ছা সত্বেও বসেছি।
-তারপর তোমার ইউরোপ সফর কেমন গেল।
-এবারের ট্যুর আসলেই আলাদা ছিল।আচ্ছা ঐদিন রেস্টুরেণ্টে যে ছেলেটার সাথে তোমাকে দেখলাম ওর নাম কি?
-সুজনের কথা বলছো?ও আমার ভীষন ভাল বন্ধু।কি যে ভাল একটা ছেলে বলে বোঝাতে পারব না।
-ওহ আচ্ছা!
দীপ্ত ভাইয়া হঠাত চুপ মেরে গিয়েছে।আমি ঠিক বুঝতে পারি,সে নিজের অজান্তেই আমাকে ভালবাসতে শুরু করেছে।হয়তো দীপ্ত ভাইয়ার মনে ভীষন তোলপাড় শুরু হয়েছে।আমার তার জন্য খারাপ লাগছে।ইচ্ছে করছে তার হাত দুটো ধরে বলি, “তুমি শুধু কষ্ট পেয়োনা।আমি তোমাকে ছাড়া আর কাউকে ভালবাসিনা।”
আমি কিংবা দীপ্ত ভাইয়া কেউই কোনো কথা খুজে পাচ্ছিনা।হঠাৎ দীপ্ত ভাই বলল, “তনু,আমার সাথে এক জায়গায় ঘুরতে যাবে?”
-কোথায়?
-জানিনা।অনেক দিন তোমাকে নিয়ে কোথাও যেতে ইচ্ছা করে।কেন যেন বলতে পারছিলাম না।
-দীপ্ত ভাই,তুমি বস।আমি রেডি হয়ে আসছি।
দীপ্ত ভাইয়ের পরিবর্তনে আমি বেশ অবাক।দুই মাসে মানুষ এতটা বদলে যায়?
জামাটা পালটে একটা নীল শাড়ি পরলাম।
ড্রাইভিং সিটে দীপ্ত ভাই বসা।আর আমি তার পাশে।কেউ কোনো কথা বলছিনা।আমি নিজেই মুখ খুললাম।
-দীপ্ত ভাই,একটা ব্যাপার খেয়াল করেছো?
-কি?
-আমি কিন্তু মেয়ে হিসাবে যথেষ্ট হালকা চরিত্রের।
-মানে?
-এই যে তুমি বললে আর আমি একটা শাড়ি পরে তোমার সাথে বের হয়ে আসলাম-এটাতো একটা হালকা চরিত্রের মেয়েদের লক্ষণ।তাইনা?
-তোমার এরকম মনে হল কেন?
-দীপ্ত ভাই,তুমি আমাকে এত হালকা চরিত্রের ভাব কেনো বলবে?তোমার কেন মনে হল,তুমি বলবে আর আমি তোমার সাথে বের হয়ে আসব?তুমি নিজেকে কি ভাব বলতো?
-আমি তোমাকে কিছুই ভাবিনি তনু।তুমি কেন শুধু শুধু এরকম করছো?
-দীপ্ত ভাই তুমি একটা কাজ করতে পারবে?আমাকে তুমি মালিবাগ মোড়ে নামিয়ে দাও।ওখানে সুজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে বলেছি।
দীপ্ত ভাই অবাক হয়ে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আমাকে মালিবাগ মোড়ে নামিয়ে দিল।
আমি গাড়ি থেকে নেমে একটা রিক্সা নিয়ে বাসায় ফিরে আসলাম।মগবাজার মোড়ে সুজন ছিল না।ওর থাকার কথাও ছিল না।গাড়ি থেকে নেমে যাওয়ার জন্যই এইসব কান্ড করেছিলাম।গাড়ি থেকে নামার আগে সিটের উপর দীপ্ত ভাইয়ের অজান্তে একটা উপহার রেখে এসেছি।সেই কালো পাথরটা।আর রেখে এসেছি একটা চিরকুট।তাতে লেখা-
উপহারটা অনেক দিন ধরে দিতে চাইছিলাম।কিন্তু
পারিনি।সামনা সামনি দিতে লজ্জা লাগে।তাই এই
নাটক করে গেলাম।কষ্ট পেয়োনা।
বিঃদ্রঃতোমার সাথে খুব জ্যোৎস্না দেখতে ইচ্ছে হয়।
দুইদিন পর পূর্ণিমা হবে। তোমার সময় থাকলে এসো।
আমি অপেক্ষা করব।
বাসায় ফিরতেই মা-কে দেখলাম বেশ উত্তেজিত।আমাকে দেখে মা হরহর করে বলতে লাগল, “জানিস কি হয়েছে?আজকে জুলেখাকে বের করে দিলাম।হারামজাদি আসলে একটা বেশ্যা।আজকে দেখলাম বমি করছে।আমি কি হয়েছে জিজ্ঞাসা করতেই বলল ওর পেটে নাকি বাচ্চা এসেছে।বাচ্চার বাবা কে এই কথা যেই জানতে চাইলাম ওমনি শয়তানটা বলে যে তোর বাবার সাথে নাকি ওর লটরপটর হয়েছে।কত বড় শয়তান দেখলি?তোর বাবার নামে মিথ্যা একটা অপবাদ দিল।
-মা,তোমার মনে হয় কার সাথে জুলেখার শারীরিক সম্পর্ক হতে পারে যে কারণে ও গর্ভ ধারন করেছে?ভাইয়ার সাথে?
-ধুর তুই কি পাগল হয়ে গেলি?আসেপাশের কোনো ড্রাইভারের সাথে হয়তো হয়েছিল।
-মা,তোমার মাথা ঠান্ডা কর।তারপর একটা কথা বলি।মনোযোগ দিয়ে শোনো।জুলেখার পেটে যে বাচ্চাটা এসেছে তার বাবা আর আমার বাবা একই ব্যক্তি।আমি নিজে দেখেছি।আমি কি বলছি বুঝতে পেরেছো?
আমার মা হতবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন।আমি কখনও মায়ের বোকা-বোকা চেহারা দেখিনি।আমার কেন যেন মায়ের চেহারাটা দেখে বেশ হাসি আসছে।এই সময়ে আমার হাসি আসছে কেন?আশ্চর্য আমি কি পাগল হয়ে গেলাম?
বছর দুই পরের কথাঃ
সেদিন আমি পাগল হইনি।পাগল হয়ে গেল আমার মা।মজার ব্যাপার হল,মা বাবাকে সহ্য করতে পারেন।কিন্তু আমাকে দেখলেই রেগে ওঠেন।হয়তো বাবার প্রতি বিশ্বাসটা আলগা করার পিছনে আমার কথাটার প্রভাব ছিল।একারণেই হয়তো আমার প্রতি মায়ের এত ক্ষোভ।
বাবা,এখন ঘরের একজন অনাহূত মানুষ।আমরা কেউ তাকে চাইনা।তবু আমাদের সাথেই তাকে থাকতে হয়।
ভাইয়া,এসবের পর আর এই ঘরে বসবাস করতে পারেনি।আলাদা হয়ে গিয়েছিল।এর কিছুদিন পরেই ও দেশের বাইরে চলে গেল।
আর আমি?আমি আমার ভাইয়ের মত স্বার্থপর হয়ে সব ছেড়ে চলে যেতে পারিনি।এই বাড়িতেই থেকে গিয়েছি।আমি এখন বাবার ব্যবসার হাল ধরেছি।বছর দুই আগের সেই ভালবাসার জন্য ব্যাকুল মেয়েটি নই।ঐসব আবেগ গুলো কই যেন হারিয়ে গিয়েছে।দীপ্ত ভাই শেষ পর্যন্ত আমার সাথে জ্যোৎস্না দেখতে এসেছিল।কিন্তু আমার বাবার কীর্তি শুনে আমাকে বিয়ে করার সাহস করেনি।তবে সুজন ছিল।ও অনেকদিন পর্যন্ত আমার পাশে থাকার চেষ্টা করেছে।কিন্তু আমি আমাকে ওর কাছে সমর্পণ করতে পারিনি।
এখন আমি একদম একা।আমার পাশে কেউ নেই।মাঝে মাঝে জ্যোৎস্না দেখার জন্য ঝুল বারান্দাটায় গিয়ে দাড়াই।চাঁদটাও আমার এখন বিভৎস লাগে।চাঁদটা এত নিঃসঙ্গ কেন?আমি চাইলেও কেন জ্যোৎস্নায় গা ভাসাতে পারিনা?
.