-তুই এরকম করলি কেন শান্ত?
-প্রতিদিন একই কথা জিজ্ঞাসা করবি না।তোর সাথে রাতে ছাদে কিছুটা সময় কাটাতে আসি মনে শান্তি পাওয়ার জন্য।এই সময়ে এইসব হাবিজাবি কথা জিজ্ঞাসা করে মেজাজ খারাপ করবি না।
আমি আর কথা না বাড়িয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম।শান্ত আমার হাতটা ধরে আমার বিয়ের আংটিটা দেখতে থাকল।
-তোর বরের অনেক টাকা তাইনা সুস্মি?
আমি ওর কথার কোনো জবাব দেই না।ও আবার বলতে থাকেঃআচ্ছা সুস্মি তুই যদি আমাকে বিয়ে করতি তাহলে হয়তো আমি তোকে এরকম হীরের আংটি দিতে পারতাম না।এজন্য তুই আমাকে বিয়ে করলি না।তাইতো?
আমি আবারো চুপ করে রইলাম।
-কিরে সুস্মি কথার জবাব দিস না কেনো?একসময় তো কত কথা বলতি।এখন কথা বলিস না কেনো?
-কি জবাব দেব?তুই তো এখন প্রমাণ করতে চাইবি একটা ব্যাপারই।সেটা হল-আমি স্বার্থপর।
-অবশ্যই তুই স্বার্থপর!তুই সব সময় সব কিছু বুঝেও না বোঝার ভান করেছিস।তোর কারণে আজকে আমার এই পরিনতি!
-শোন শান্ত,তোর কৃতকর্মের জন্য তুই নিজে দায়ী।আমাকে এড় ভিতর জড়াবি না।
আমি আর কোনো কথা না বাড়িয়ে বাসায় চলে আসি।তারপর আমার ঘরের দরজা চাপিয়ে প্রবলভাবে কাদতে শুরু করি।আমি কেন কাদছি জানিনা।আমার ভয়াবহ কান্না আসছে।শান্ত সবসময় আমাকে দোষারোপ করে।আমি নাকি ওর জীবন নষ্ট করে দিয়েছি।আমার এই দায় কাধে চাপাতে ইচ্ছা হয় না।
শান্ত ছিল আমাদের পাশের বাড়ির ছেলে।আমরা এক সাথেই বড় হয়েছি।ও আমার থেকে কয়েকমাসের ছোটো ছিল।ছোট বেলায় যে সম্পর্কটা বন্ধুর মত ছিল,বড় হওয়ার সাথে সাথে কেমন একটা অদৃশ্য দেয়াল তৈরী হয়ে গেল।এক্ষেত্রে আমার মায়ের একটা বড় ভূমিকা ছিল।আমার একটু একটু করে বেড়ে ওঠা দেহটাকে ঢেকে রাখার জন্য কিংবা সবার থেকে আড়াল করার জন্য আমার মায়ের সেকি চেষ্টা!আমার বয়স যখন ১২ কি ১৩ তখন তখন মা আইন জাড়ি করলেন আমাকে মাথায় ওড়না দিয়ে চলতে হবে।তবে তখনও মা শান্তর সাথে মেলা মেশা নিয়ে কোনো অমত করেনি।একদিন শান্তর সাথে কি নিয়ে যেন ঝগড়ার এক পর্যায়ে শান্ত আমার ওড়নাটা এক ঝটকা দিয়ে খুলে রাস্তায় ফেলে দিয়ে চলে গেল।আমি বাসায় এসে মাকে সেই নালিশ জানাতেই মা আমাকে এক বাক্যে নিষেধ করে দিলেন যেন আমি আজ থেকে প্রয়োজন ছাড়া আর শান্তর সাথে মেলা মেশা না করি।আমি মা-বাবার একান্ত বাধ্য মেয়ে।আমিও আর শান্তর সাথে কথা বলতাম না।
আর শান্ত?সেও কি আমার সাথে খাতির করার চেষ্টা করেনি?কেন করবেন?অবশ্যই করেছিল।শান্ত তো সেই ছোটবেলা থেকেই আমাকে ভালবাসতো।নাহ আমি এসব কি বলছি?শান্ত কেন আমাকে ভালবাসতে যাবে?ও তো নিছকই আমার বন্ধু।এতক্ষণ যা বলেছি,ভুল বলেছি!শান্ত আমাকে ভালবাস তো না।কখনই ও আমাকে ভালবাসত না।কেবল বন্ধু হিসাবেই ও আমাকে হয়তো চাইত!
আমি মায়ের কথার অবাধ্য হইনি।আমি দেখতাম,আমি যখন স্কুলে যেতাম তখন ও সাইকেলে করে আমার রিক্সার পাশ দিয়ে যেত।আমার চোখে চোখ রাখার চেষ্টা করত।আমি ওর দিকে তাকাতাম না।মাঝে মাঝে স্কুলের সামনে ও সাইকেলটা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত।শান্তর যেমন সবসময় প্রচেষ্টা থাওকত আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করা,তেমনি আমার প্রচেষ্টা থাকত ওকে না দেখার ভান করা।স্কুলের পর্বটা এরকমই ছিল।
আমি আর ও একই কলেজে পড়তাম।সেখানেও ও স্কুলে পড়ার সময় যা করত,তাই করত।আর আমি?আমিও কি তখন মায়ের বাধ্য মেয়ে ছিলাম?নাহ!আমার চোখে তখন রঙ্গিন চশমা।আমি শান্তকে তখন কোনোভাবেই উপেক্ষা করতে পারিনি।
আমি বুঝতাম,আমার মায়ের কাছে আমি অপরাধী।কিন্তু নিজের কাছে নিজেকে নির্দোষ প্রমান করতাম এটা ভেবে যে-শান্ত আমার কেবলই বন্ধু।আর কিচ্ছু নয়!
শান্তকে নিয়ে ভাবনায় ছেদ পড়ল ফোনের শব্দে।বেশ কিছুক্ষণ ধরে আমার ফোনটা বাজছে।আমি জানি কে এই সময়ে ফোন দিতে পারে।আমার হবু বড় ফোন করেছে।তিনি দেশের বাইরে থাকেন।শুনেছি পিএইচডি করছেন।আমি তার সম্পর্কে আমি তেমন জানার আগ্রহ বোধ করি না।কিন্তু এই মানুষটাও আমাকে মায়ায় বাধার প্রবল চেষ্টা করছে।তার সাথে ফোনে কথা বলতে বলতে মাঝে মাঝে আমার নিজেকে দ্বিচারিনী মনে হয়।ভাল মেয়ে নামক খোলসের নিচে আমার একটা দ্বিচারিনী সত্তা আছে সেটা তো আমিই জানি।আমার নিষ্পাপ মুখচ্ছবির নিচে একটা প্রতারক লুকিয়ে আছে তাতো আমার চেয়ে ভাল কেউ জানে না।আমি শান্তকে প্রতারিত করেছি,আমার হবু বড়কে প্রতারিত করছি,আর কার সাথে প্রতারণা করছি জানেন?আমি প্রতারণা করেছি আমার নিজের সাথে।আমি কখনই এটা নিজের কাছে স্বীকার করতে চাইনি যে শান্তর প্রতি আমার কখনও কোনো আবেগ জন্ম নিয়েছিল।তবে বাস্তব তো এটাই ছিল যে শান্তর প্রতি আবেগগুলো আমার মনের ভিতরে কোথাও না কোথাও জন্ম হয়েছিল।আমি সেই আবেগের ভ্রুনটাকে সেইভাবেই গোপন করেছিলাম।না সেই আবেগগুলোকে লালন করে বাড়িয়ে তুলেছি,না তাদের বিন্দুমাত্র মর্যাদা দিয়েছি।আর আজকে সেই অবহেলিত আবেগগুলো আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়।আমাকে প্রতারক বলে অবিহিত করে!
আমি তো আমার শিক্ষিত উদার হবু বরকে নিয়েই সুখের স্বপ্নে বিভোর থাকতে পারতাম।কিন্তু কেন পারছিনা?কেন আজকে শান্ত আমার আর আমার হবু বরের মাঝে দেয়াল হয়ে দাড়াচ্ছে?কারণ আমিই শান্তকে সেই প্রশ্রয় দিয়েছিলাম।কলে১জে পড়ার সময় সবাই ভাবত আমি আর শান্ত প্রেম করি।আর আমি বড় মুখ করে সবাইকে বলে বেড়াতাম-“আমরা কেবলই বন্ধু।আমাদের মধ্যে কোনো প্রেম নেই”।অনেকেই আমার কথা বিশ্বাস করতে চাইতো না।আর শান্ত এসব ব্যাপারে একদম চুপ থাকত।হয়তো ওযে কিছুটা সময় আমার সাথে কাটাতে পারছে সেটাই ওর কাছে অনেক বেশী মূল্যবান ছিল বলেই ও মুখ ফুটে কিছু বলত না।ও হয়তো জানত,ওর প্রস্তাবে আমি কিছুতেই সারা দেব না।আচ্ছা,ও কি তখন বুঝতে পেরেছিল যে আমি ভয়াবহ স্বার্থপর।আমি বেস্ট অপশনটাকেই বেছে নেব?বুঝতেই যদি পারে তাহলে কেন আজকে ওর জীবন নষ্ট করে দেয়ার জন্য আমাকে দোষারোপ করছে?কেন ও প্রতি সন্ধ্যায় ছাদে ডেকে আমাকে যাচ্ছেতাই বলছে?ও তো আগেই জানত আমি কখনও ওকে বিয়ে করব না!
আমি আর ও প্রায়ই কলেজ ফাকি দিয়ে রিক্সার হুট তুলে শরের এ মাথা ওমাথা ঘুরে বেড়াতাম,কত হাসাহাসি,খুনসুটি ছিল!কতবার এটা সেটা দেয়া নেয়ার ছলে একটু হাতের স্পর্শ নিতে চাইত শান্তটা!আমি কখনই আমার হাত ধরতে দিতাম না।মাঝে মাঝে মনে হত,বেচারা হাতই তো ধরতে চাইছে।একটু ধরলে তো সমস্যা নাই।এতটা প্রশ্রয় তখন আমি কেন দিয়েছিলাম শান্তকে সেটাই আমি ভেবে পাইনা।আমি সত্যিই প্রতারক।আমার কারণে শান্ত নিজের জীবনটা এভাবে নষ্ট করে দিয়েছে!
আমি আবার দৌড়ে ছাদে যাই।হয়তো এখনও শান্তকে ছাদে পাওয়া জযেতে পারে।ওর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে।
হ্যা,এখনও শান্ত ছাদে দাড়িয়ে আছে।আমি আস্তে করে শান্তর পিঠে টোকা দিলাম।ও খুব আমার দিকে না তাকিয়েই বললঃমাফ চাইতে এসেছিস?
-শান্ত আমার ভীষন ভুল হয়েছেরে ।প্লিজ আমাকে মাফ কর!
-তুই মাফ বিষয়টাকে এত তুচ্ছ ভাবছিস কেনো।আমাকে শেষ করে মাফ চাইতে এসেছিস?
-শান্ত তুই যা বলবি আমি তাই করব।
-তাই করবি?
-হ্যা।
-আমি যেভাবে আত্মহত্যা করেছিলাম সেভাবে তুই আত্মহত্যা কর।
-মানে?
-মানে তুই আত্মহত্যা করবি।
-শান্ত তুই এতটা স্বার্থপর কিভাবে হচ্ছিস?
-কেন স্বার্থপরতা কি কেবল তোর একারই সম্পত্তি?
-শান্ত তুই আর কোনো দিন আমার সামনে আসবিনা।
-শোন সুস্মি,আমি কখনও তোর কাছে আসিনি।তুই বারবার আমাকে ডেকে এনেছিলি।আমি তখনই আসব না যখন তুই আর আমাকে ডাকবিনা।আর শোন,এটা কখনই ভুলে যাবিনা যে তোর স্বার্থপরতাই আমাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিল।
শান্তর ছায়াটা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়।আমি আমার সামনে আর শান্তকে দেখতে পাইনা।
শান্ত চলে যাওয়ার আগে আমাকে স্বার্থপরের তকমা দিয়ে গিয়েছে।ব্যাপারটা মেনে নিতে আমার কষ্ট হচ্ছে।আমি ছাদের রেলিংয়ের উপর উঠে দাড়ালাম।আমি প্রমাণ করে দেব আমি স্বার্থপর না।আমার হাত-পা প্রচন্ড ভাবে কাপছে।আমার ভীষন ভয় করছে।না ভয় পেলে চলবে না।আমাকে প্রমান করতে হবে আমি স্বার্থপর না।আমি চোখ বন্ধ করলাম।হঠাৎ আমার চোখের সামনে একটা ছবি ফুটে উঠল।আমার ভবিষতের ছবি।সুখের ছবি!নাহ আমি কোনোভাবেই এমন সুখ থেকে বঞ্চিত হব না।শান্তর জন্য আত্মহত্যা করার মানেই হয়না।আমি আবার নিচে নেমে গেলাম।
আমার ঘরে ঢুকে আমি একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।যাক এবারও আমি আবেগের কাছে বশীভূত হইনি।হঠাৎ আমার মনে হল শান্ত আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বলছে
আমি কেবল বন্ধু কি তোর;
আর কিছু কি নই?
আমার আবার কেমন যেন হাহাকার লাগতে শুরু করল।শান্ত আত্মহত্যার আগে কোনো সুইসাইড নোট রেখে যাইনি।ওর টেবিলের উপর একটা কাগজে কেবল ঐ কথাগুলো লেখা পাওয়া গিয়েছিল।এই কথা কাকে উদ্দেশ্য করে লেখা কেউ বুঝতে পারেনি।কিন্তু আমি তো জানি কাকে উদ্দেশ্য করে লেখা!
আমার দুকূল ছাপিয়ে কান্না আসছে।আমি জানি,আমি স্বার্থপর।ভয়াবহ রকম স্বার্থপর!