জন্মঃ
------
শহীদ মাগফার আহমেদ চৌধুরী আজাদ (শহীদ আজাদ নামে যিনি পরিচিত) এর জন্ম ১৯৪৬ সালের ১১ জুলাই ভারতের কানপুরে। আজাদের বাবা ইঞ্জিনিয়ার ইউনুস চৌধুরী তখন চাকুরিসূত্রে কানপুরে বসবাস করছিলেন। ঢাকার প্রথম সারির অভিজাত এবং ধনাঢ্য পরিবারের মধ্যে একটি ছিলো আজাদদের পরিবার। তার মায়ের নাম সাফিয়া বেগম। আজাদ ছিলেন ইউনুস এবং সাফিয়া দম্পতির একমাত্র সন্তান।
শিক্ষাজীবন ও বেড়ে ওঠাঃ
---------------------------------
আজাদের শিক্ষাজীবন শুরু হয় সেন্ট গ্রেগরি স্কুলে। স্কুল ও কলেজের গন্ডি পার হয়ে উচ্চশিক্ষার্থে পশ্চিম পাকিস্তানের করাচি তে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। কিন্তু সেখানকার ভিন্ন সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে তিনি নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেননি। তাই তিনি এক পর্যায়ে তাঁর নিজ দেশ পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে ভর্তি হন। এখান থেকেই পরবর্তীতে তিনি ১৯৭১ সালে স্নাতকোত্তর (মাস্টার্স) ডিগ্রী লাভ করেন। আজাদ যখন ষষ্ঠ শ্রেনীর ছাত্র তখন তাঁর বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন এবং তাঁর মা অভিমান করে ছেলেকে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যান। তখন থেকে আজাদ তাঁর মায়ের কাছেই বড় হোন।
মুক্তিযুদ্ধে যোগদানঃ
-------------------------------------
শহীদ আজাদ ক্র্যাক প্লাটুন এর একজন সদস্য হিসেবে ২ং সেক্টরের অধীনে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ক্র্যাক প্লাটুন ছিলো স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময় পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ও তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে ঢাকা শহরে গেরিলা আক্রমণ পরিচালনাকারী একদল তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত দল। এই গেরিলা দলটি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে "হিট এন্ড রান" পদ্ধতিতে অসংখ্য আক্রমণ পরিচালনা করে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর মধ্যে ব্যাপক ত্রাসের সঞ্চার করেন। আজাদ ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য হিসেবে ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্টে সফল গেরিলা অভিযান পরিচালনা করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলো হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল, সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন, রাজারবাগ অপারেশন ইত্যাদি।
যেভাবে শহীদ হলেনঃ
---------------------------------
১৯৭১ সালের ৩০শে আগস্ট আজাদের বাড়িতে অভিযান চালায় পাকিস্তানী সেনারা। তাদের হাতে ধরা পড়েন এই অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা। নাখালপাড়া এমপি হোস্টেলের টর্চার সেলে অমানুষিক অত্যাচারের শিকার হন আজাদ। কিন্তু প্রবল অত্যাচারের মুখেও তিনি তাঁর সহযোদ্ধাদের পরিচয় ও অবস্থান পাকিস্তানীদের কাছে প্রকাশ করেননি। পাকিস্তানীদের নির্মম অত্যাচার সহ্য করে একসময় এই সূর্যসন্তান স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য শাহাদাত বরণ করেন। শহীদ আজাদের মৃত্যুর তারিখ নিশ্চিতভাবে জানা সম্ভব হয় নি।
পরিশিষ্ট ও আজাদের মায়ের গল্পঃ
-----------------------------------------
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে শহীদ আজাদ ও তাঁর মায়ের অবদানের গল্প কিংবদন্তীতূল্য। গ্রেপ্তার হওয়ার পর রমনা থানায় আজাদ ও তাঁর মায়ের শেষ কথোপকথন সাহিত্যিক আনিসুল হকের বয়ান থেকে নিচে সরাসরি তুলে দেওয়া হলো -
"আজাদ বলে, মা কি করবো? এরা তো খুব মারে, স্বীকার করতে বলে। সবার নাম বলতে বলে।
'বাবা, তুমি কারো নাম বলনি তো!'
না, মা বলিনাই। কিন্তু ভয় লাগে, যদি আরো মারে, যদি বলে ফেলি।
'বাবারে, যখন মারবে তুমি শক্ত হয়ে থেকো। সহ্য করো, কারো নাম যেন বলে দিও না।'
আচ্ছা। মা, ভাত খেতে ইচ্ছা করে। দুইদিন হয়ে গেলো ভাত খাই না। কালকে ভাত দিয়েছিলো, আমি ভাগ পাই নাই।
'আচ্ছা কালকে যখন আসবো, তোমার জন্য ভাত নিয়ে আসবো।'
সেন্ট্রি এসে বলে, সময় শেষ, যান গা।
মা হাঁটতে হাঁটতে কান্না চেপে ঘরে ফিরে আসেন।"
মা ভাত নিয়ে এসে ছেলেকে আর পাননি। আর কোনোদিনও মায়ের বুকে ফিরে আসেনি মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আজাদ। ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন আজাদের মা। ঠিক ৩০ আগস্টেই মারা যান তিনি। পুরো ১৪টি বছর ভাত মুখে তোলেননি। কেবল একবেলা রুটি খেয়ে থেকেছেন। কারণ তার একমাত্র ছেলে আজাদ ভাত চেয়েও খেতে পারেনি সেদিন। অপেক্ষা করেছেন ১৪টি বছর ছেলেকে ভাত খাওয়াবেন বলে। ১৪ বছর তিনি কোনো বিছানায় শোননি। মেঝেতে শুয়েছেন। শীত-গ্রীষ্ম কোনো সময়ই তিনি পাল্টাননি তার এই পাষাণশয্যা। কারণ তার ছেলে নাখালপাড়া ড্রাম ফ্যাক্টরিসংলগ্ন এমপি হোস্টেলের মিলিটারি টর্চার সেলে বিছানা পায়নি।
পরিশেষে, করাচিতে থাকা কালীন মাকে লেখা আজাদের একটা চিঠি নিচে তুলে ধরতে চাই।
মা,
কেমন আছো? আমি ভালোভাবেই পৌছেছি এবং ভালো আছি।
হরতাল বন্ধ হয়ে গেছে। রীতিমত ক্লাস চলছে। পরীক্ষা শীঘ্রই শুরু হবে, দোয়া কর। তোমার দোয়া ছাড়া কোন উপায় নাই। আমি নিজে কি ধরনের মানুষ, আমি নিজেই বুঝতে পারি না। আচ্ছা তুমি বলো তো সবদিক দিয়ে আমি কি ধরনের মানুষ? আমি তোমাকে আঘাত না দেওয়ার অনেক চেষ্টা করি। তুমি আমার মা বলে বলছি না; তোমার মত মা পাওয়া দুর্লভ। এই বিংশ শতাব্দীতে তোমার মতো মা যে আছে কেউ বিশ্বাসই করবে না। এগুলো আমি হৃদয় থেকে বলছি, তোমার কাছে ভালো ছেলে সাজবার জন্য নয়। যদি আমি পৃথিবীতে তোমার দোয়ায় বড় বা নামকরা হতে পারি, তবে পৃথিবীকে সবাইকে জানাবো তোমার জীবনি, তোমার কথা।
আমি ভালো পড়াশুনা করার চেষ্টা করছি।
এবং অনেক দোয়া দিয়ে চিঠির উত্তর দিও।
ইতি,
তোমার অবাধ্য ছেলে
আজাদ
রেফারেন্সঃ
--------------------
আনিসুল হক রচিত মা উপন্যাস এবং ইন্টারনেট
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জুলাই, ২০১৬ বিকাল ৫:৫২