আল্লাহর শাস্তিঃ
---------------------------
মুসলিম জাতির দায়িত্ব ও ফরিযা হল ‘দাওয়াত’। অর্থাৎ আল্লাহর হুকুমে আল্লাহর বান্দাদের নিকট আল্লাহর পয়গাম পৌঁছিয়ে দেয়া। মুসলমানগণ যদি এই গুরু দায়িত্ব আদায় না করে, তাহলে তার অবস্থা কি হতেপারে? এ বিষয়ে কিছু আলোচনা পেশ করছি।
কুরআনে হাকীমে আল্লাহ তা‘আলা মুসলিম জাতির দুটি অবস্থা আলোচনা করেছেন।(১) সম্মানের অবস্থা।(২) লাঞ্চনার অবস্থা। প্রথম অবস্থা সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন।
يَقُولُونَ لَئِنْ رَجَعْنَا إِلَى الْمَدِينَةِ لَيُخْرِجَنَّ الْأَعَزُّ مِنْهَا الْأَذَلَّ وَلِلَّهِ الْعِزَّةُ وَلِرَسُولِهِ وَلِلْمُؤْمِنِينَ وَلَكِنَّ الْمُنَافِقِينَ لَا يَعْلَمُونَ.
——–অর্থাৎ ইজ্জত সম্মান তো শুধু আল্লাহর ও তাঁর রাসুল এবং মু‘মিনদের জন্য। কিন্তু মুনাফিকরা জানেনা।
দ্বিতীয় অবস্থা সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে হাকীমে বলেন।
وَضُرِبَتْ عَلَيْهِمُ الذِّلَّةُ وَالْمَسْكَنَةُ وَبَاءُوا بِغَضَبٍ مِنَ اللَّهِ.
যদিও এই আয়াতটি ইয়াহুদীদের ব্যপারে অবতির্ণ, কিন্তু যাদের আমল ঐ ইয়াহুদীদের মতো তারাও এই হুকুমের অন্তর্ভুক্ত।
এখন এই আয়াত গুলোর আলোকে আমাদের পর্যালোচনা করা উচিৎ বর্তমান মুসলমানদের কি অবস্থা? অবশ্যই বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা একথা বলতে বাধ্যহবে যে, মুসলমানরা লাঞ্চিত অবস্থায় জীবন যাপন করছে। এই লাঞ্চনা আল্লাহর পক্ষথেকে কোনো নেয়ামত নয় বরং শাস্তি। আল্লাহ তা‘আলা কুরানে হাকীমে শাস্তির কথা আলোচনা করতে গিয়ে বলেন।
قُلْ هُوَ الْقَادِرُ عَلَى أَنْ يَبْعَثَ عَلَيْكُمْ عَذَابًا مِنْ فَوْقِكُمْ أَوْ مِنْ تَحْتِ أَرْجُلِكُمْ أَوْ يَلْبِسَكُمْ شِيَعًا وَيُذِيقَ بَعْضَكُمْ بَأْسَ بَعْضٍ انْظُرْ كَيْفَ نُصَرِّفُ الْآَيَاتِ لَعَلَّهُمْ يَفْقَهُونَ.
আপনি বলুন তিনিই শক্তিমান যে, তোমাদের উপর কোনো শাস্তি উপর দিক থেকে অথাবা তোমাদের পদতল থেকে প্রেরণ করবেন। অথবা তোমাদেরকে দলে-উপদলে বিভক্ত করে সবাইকে মুখোমুখি করে দিবেন এবং একজনকে অন্যের উপর আক্রমনের স্বাদ আস্বাদন করাবেন। দেখ আমি কেমনে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিদর্শনাবলী বর্ণনা করি যাতে তারা বুঝে নেয়।
এই আয়াতের মধ্যে তিনটি শাস্তির কথা আলোচনা করা হয়েছে। (১) আসমানি শাস্তি।(২) যমিনী শাস্তি।(৩)পরস্পর ঝগড়া-বিবাদ। কিন্তু প্রথম দুটি শাস্তি রাসুলুল্লাহর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দু‘আর বরকতে উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। হাদিস শরীফে বর্ণিত আছে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন-
سألت ربى ثلاثا فأعطانى اثنتين ومنعنى واحدا سألت ربى ان لايهلك امتي بالسنة فأعطانيها وسألت ان لايهلك أمتي بالغرق .فأعطانيهاوسألت ان لا يجعل بأسهم بينهم فمنعنيها.
আমি আল্লাহর কাছে তিনটি দু‘আ করেছি। দুটি কবুল হয়েছে এবং একটি ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। আমি আল্লাহর কাছে দু‘আ করলাম তিনি যেন আমার উম্মতকে দুর্ভিক্ষ দ্বারা ধ্বংস না করেন। আমার এই দু‘আটি কবুল হয়ছে। এর পর দু‘আ করলাম আমার উম্মতকে যেন ঝরে তুফানে ডুবিয়ে ধ্বংস না করেন। আমার এই দু‘আও কবুল করলেন। দু‘আ করলাম আল্লাহ যেন আমার উম্মতকে পরস্পর ঝগড়া-ফাসাদে নেস্ত না করেন। আমার এই দু‘আটি ফিরিয়ে দেয়া হল।
উল্লেখিত হাদিস দ্বারা জানা জায় যে, শেষ প্রকারের শাস্তি এই উম্মতের মধ্যে থেকে যাবে।
অর্থাৎ নিজেদের মধ্যে ফেৎনা ফাসাদ এবং মতানৈক্য আদাওয়াত বা দুশমনি ইত্যাদি । একদা রাসুলুল্লাল্লাহ সাল্লল্লাহু আলাইহিওয় সাল্লাম বলেছেন।
والذى نفسى بيده لتأمرن بالمعروف ولتنهون عن المنكر اوليسلطن الله عليكم شراركم ثم يدعو خياركم فلايستجاب لهم
ঐ সত্তার কসম যার হাতে আমার জান, তোমরা অবশ্যই সৎকাজের আদেশ করবে এবং অবশ্যই অসৎ কাজ থেকে বাধা প্রদান করবে, যদি এমন না করতে থাক তাহলে আল্লাহ সুব্হানাহু ওয়া তা‘আলা তোমাদের উপর #জালিম_শাসক চাপিয়ে দেয়া হবে। তখন তোমাদের মধ্যে ভাল লোকেরা দু‘আ করবেন কিন্তু তা কবুল করা হবে না।
আমরা একটু চিন্তা করে দেখি যে, আজ আমাদের উপর কি ধরনের ব্যক্তির শাসন চলছে। আল্লাহ তা‘আলাকি খারাপ লোকদেরকে আমাদের উপর চাপিয়ে দেন নি? এটা আল্লাহ তা‘আলার অটল ও অনড় বিধান। যদি আমরা আমাদের দ্বায়িত্বের অবহেলা করি, তাহলে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বিধান আমাদের উপর প্রয়োগ করবেন।
আজকে আমরা দাওয়াতের অনিবার্য দায়িত্বটি ছেড়ে দিয়েছি আর দুনিয়ার সবচাইতে খারাব জাতিকে আমাদের উপর চাপিয়ে দিয়েছেন। ভারতে ৬ডিসিম্মর ১৯৯২সনে বাবরী মসজিদ শাহাদাতের এবং ২০০২সালে গুজরাটে সামপ্রদায়িক ফাসাদের কথা হয়তো আপনাদের স্বরণ আছে। ঐ সময় বিশ্বের সকল মুসলমানদের মাঝে কম্পন সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল। ঐ সময় এমন কোন্ ব্যক্তি ছিল যিনি দু‘আ করতে গিয়ে চোখের অশ্রু ঝরায়নি। দুনিয়ার এমন কোন্ স্থান ছিল যেখানে দু‘আ না করা হয়েছে।
হেরেমে মক্কা এবং হেরেমে মদিনায় দু‘আ করা হয়ে ছিল। পবিত্র রমযান মাসে স্থানে স্থানে দু‘আ করা হয়েছে কুনুতে নাযেলা পড়া হয়েছে। কিন্তু কোন দু‘আ আল্লাহর রহমত ও দয়াকে মুতাওয়াজ্জুহ করতে পারেনি। সম্ভবত এর কারণ এ্টাই ছিল যে, আমাদের অপরাধের কারণে আল্লাহর অটল বিধান ও নিয়মের বাস্তবাতা দেখিয়েছেন।
এক হাদিসে আছে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম বলেছেন,
عَنْ عَائِشَةَ ، قَالَتْ : سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى الله عَليْهِ وسَلَّمَ ، يَقُولُ : مُرُوا بِالْمَعْرُوفِ ، وَانْهَوْا عَنِ الْمُنْكَرِ ، قَبْلَ أَنْ تَدْعُوا فَلاَ يُسْتَجَابَ لَكُمْ.
তোমরা সৎকাজের আদেশ কর এবং অসৎ কাজ থেকে বাধা প্রদান কর। ঐ সময়ের পূর্বে যখন তোমরা দু‘আ করবে কিন্তু তা গ্রহণ কবুল হবে না। কুরআনে হাকীমে এই জন্যই বনি ইসরাইলের উপর লানত করা হয়েছে। কুরআনে হাকীমে আল্লাহ তা‘আলা বলেন।
إِنَّ الَّذِينَ يَكْتُمُونَ مَا أَنْزَلْنَا مِنَ الْبَيِّنَاتِ وَالْهُدَى مِنْ بَعْدِ مَا بَيَّنَّاهُ لِلنَّاسِ فِي الْكِتَابِ أُولَئِكَ يَلْعَنُهُمُ اللَّهُ وَيَلْعَنُهُمُ اللَّاعِنُونَ .
নিশ্চই ঐসমস্ত ব্যক্তি আমার অবতির্ণ করা হেদায়াত এবং আকহকামকে যে গোপন করে যা আমি মানুষের হেদায়াতের জন্য কিতাবের মধ্যে বর্ণনা করে দিয়েছি। তাদের উপর আল্লাহ তা‘আলার অভিসাপ এবং সমস্ত অভিসাপ দান কারীর প্রতি লানত।
সুরা মায়েদার মধ্যে এরুপ বর্ণনা করা হয়েছে।
لُعِنَ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْ بَنِي إِسْرَائِيلَ عَلَى لِسَانِ دَاوُودَ وَعِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ ذَلِكَ بِمَا عَصَوْا وَكَانُوا يَعْتَدُونَ (৭৮) كَانُوا لَا يَتَنَاهَوْنَ عَنْ مُنْكَرٍ فَعَلُوهُ لَبِئْسَ مَا كَانُوا يَفْعَلُونَ
বনী-ইসরাঈলের মধ্যে যারা কাফের, তাদেরকে দাঊদ ও মরিয়ম-তনয় ঈসার মুখে অভিসম্পাত করা হয়েছে। এটা এ কারণে যে, তারা অবাধ্যতা করত এবং সীমা লংঘন করত। তারা পরস্পরকে মন্দ কাজে নিষেধ করত না, যা তারা করত। তারা যা করত তা অবশ্যই মন্দ ছিল।
উপরোক্ত আয়াত দুটিতে বনী ইসরাইলের উপর এই জন্য লানত দেয়া হয়েছে যে, তারা আল্লাহর আহকামকে গোপন করেছে এবং আমর বিল মারুফ এবং নাহি আনিল মুনকার ছেড়ে দিয়েছিল। আজ আমাদের অবস্থাও তাই। কুরআনকে শুধু ঘরের অলংকার- যিনাত বানিয়ে রেখেছি। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিক্ষাকে গোপন করে রাখছি। এমন কতো অমুসলিম আছে যাদের সাথে প্রতিদিন এক সাথে উঠা-বসা,খাওয়া-দাওয়া,ব্যবসা-বাণিজ্য মোট কথা সব কিছুই হয়। কিন্তু হয়না শুধু দাওয়াতের ব্যবসা-বণিজ্য।
এখনোও যদি আমরা আল্লাহর শাস্তি হোতে বাচতে চাই, তাহলে আমাদেরকেও ঐ পদ্ধতিই অবলম্বন করতে হবে। যা ইউনুস (আঃ) এর কওম গ্রহণ করেছিল। তারাতো ঐ জাতিই যারা নিজ নবীকে মানতে অস্বীকার করে ছিল। তবে আল্লাহর শাস্তি আসতে দেখে তৌবা করল এবং তাদের নবীর উপর ঈমান আনলো, ফলে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে ক্ষমা করে দিলেন এবং শাস্তিকে ফিরিয়ে নিলেন। বললেন..
فَلَوْلَا كَانَتْ قَرْيَةٌ آَمَنَتْ فَنَفَعَهَا إِيمَانُهَا إِلَّا قَوْمَ يُونُسَ لَمَّا آَمَنُوا كَشَفْنَا عَنْهُمْ عَذَابَ الْخِزْيِ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَمَتَّعْنَاهُمْ إِلَى حِينٍ
সুতরাং কোনো জনপদ কেন এমন হল না যা ঈমান এনেছে অতঃপর তার সে ঈমান গ্রহণ হয়েছে কল্যাণকর? অবশ্য ইউনুসের সম্প্রদায়ের কথা আলাদা। তারা যখন ঈমান আনে, তখন আমি তুলে নেই তাদের ওপর থেকে অপমানজনক আযাব- পার্থিব জীবনে এবং তাদেরকে কল্যাণ পৌছাই এক নির্ধারিত সময় পর্যন্ত।
কুরআনে হাকীমে আল্লাহ তা‘আলা বনী ইসরাইলের একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন যে, আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে শনিবারে মাছ ধরতে নিষেধ করে ছিলেন। ঐ সম্প্রদায়ের মানুষ তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। (১) শিকার কারী (জালিমিন) (২) মুত্তাকী অর্থাত যারা বিরত ছিল।(৩) বাধা প্রদান কারী। আল্লাহ তা‘আলা
শিকার কারী (জালিমিন) এবং মুত্তাকী অর্থাত যারা বিরত ছিল তাদেরকে ধ্বংস করে দিয়েছেন বরং তাদের আকৃতিকে বিকৃত করে দিয়েছেন এবং বাধা প্রদান কারীদের পরিত্রান দিয়েছেন। এই ঘটনাটি (সুরা আরাফের ১৬৩-১৬৬) আয়াতে বিস্তারিত দেখতে পারেন।
একই অর্থে একটি হাদিস আছে যা বুখারী-তিরমিজীতে বর্ণিত হয়েছে। যার সার সংক্ষেপ হলো এই তিন তলা বিশিষ্ট এক জাহাজে মানুষ আরোহন করেছে। পানির ব্যবস্থা ছিল তৃতিয় তলায়। নিচের লোকেরা পানি আনার জন্য উপরে যেত আর সেখানকার লোকদের কষ্ট হতো এ কথা চিন্তা করে তারা এ সিদ্ধান্ত নিল যে, আমরা যদি আমাদের তলার নিচ থেকে একটি ছিদ্র করে দেই, তাহলে আমাদের জন্য সহজ হবে এবং উপর ওয়ালাদেরও কষ্ট হবেনা। এবার যদি উপর ওয়ালারা এ কথা বলে বসে থাবে যে, তারা তাদের তরা ছিদ্র করবে তাতে আমাদের কি যায় আর আসে, তাহলে সকলেই ডুবে যাবে। এই মুুসিবত থেকে বাঁচতে হলে নিচের তলার লোকদেরকে বাধাপ্রদান করতে হবে।
আজ আমাদের অবস্থাও এর থেকে ভিন্ন নয়। আমরা শিরক করতে দেখেও মুখ খুলছিনা, কিছু বলিনা। এমত অবস্থায় আমাদের উপরও কি আল্লাহর শাস্তি আসতে পারেনা ? এই জাতিকে খুবই সুক্ষ ভাবে চিন্তা করা উচিৎ।
মোট কথা কুরআনে হাকীম এই শাস্তি থেকে বাঁচার একটিই উপায় বর্ণনা করেছে।
إِلَّا الَّذِينَ تَابُوا وَأَصْلَحُوا وَبَيَّنُوا فَأُولَئِكَ أَتُوبُ عَلَيْهِمْ وَأَنَا التَّوَّابُ الرَّحِيمُ .
অর্থাৎ লানত ও শাস্তি হতে ঐ সমস্ত লোকেরাই বাঁচবে যারা তিনটি কাজ সম্পাদন করবে। (১) তৌবা করবে (২) এসলাহ করবে (শুধরে নিবে)। (৩) যেই সমস্ত আহকাম গোপন করেছে তা মানুষের মাঝে বর্ণনা করবে।
স্পষ্ট থাকে যে, প্রথমে তৌবা ঐ অপরাদের কারণে বলা হয়েছে, যা উপরে আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে। অর্থাৎ সত্যকে গোপন করা। উদ্দেশ্য হল যে, সামনে থেকে আমাদের ইলমকে গোপন করবোনা এবং অন্যকে হক কথা বলবো। দ্বিতিয় নাম্বারে নিজের এবং অন্যের এসলাহ করবো এবং আমাদের কাছে যা কিছু আছে তা অন্যের কাছে বর্ণনা করবো।
আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সকলকে এর তৌফিক দান করেন। আমিন!