বাংলাদেশ সরকার প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য নানাবিধ পরিকল্পনা নিয়েছে। ইতিমধ্যে প্রাথমিক শিক্ষায় স্কুলগামী ১০০% ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি করা হয়েছে। পিইডিপি-৩ এর মাধ্যমে বিভিন্ন বিষয় ভিত্তিক প্রশিক্ষণ হয়েছে এবং হচ্ছে। এছাড়া প্রধান শিক্ষকদের লিডারশিপ প্রশিক্ষণ চলছে। সকল প্রশিক্ষণের মূল উদ্দেশ্য মান সম্মত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন করা। প্রাথমিক শিক্ষায় পরিদর্শনকারী কর্মকর্তা এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সাক্ষাৎকার এবং নিজের ৮ বছরের পিটিআই সুপারিনটেনডেন্ট এর অভিজ্ঞতায় দেখেছি বিদ্যালয় পরিদর্শনে গেলে কোন শিক্ষক নিজে বলে না স্যার আমার শ্রেণিকার্যক্রম টা পর্যবেক্ষণ করেন। মডেল সরকারি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পরিদর্শনে অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় ১ জন শিক্ষক আছেন তিনিই শুধু পাঠ পর্যবেক্ষনের জন্য পাঠ দিয়ে থাকেন। এছাড়া অন্যান্য শিক্ষকরা পাঠ দেখাতে চায় না। যদি কোন কর্মকর্তা কোন শিক্ষকের শ্রেণিতে চলেই যান ; তাহলে বাধ্য হয়ে যা পাঠ দেন তাই দেখতে হয়।
পরিদর্শনকারী কর্মকর্তাদের প্রত্যাশা বিদ্যালয় পরিদর্শনে গেলে যেন প্রতিযোগিতা হয় কে কার আগে তাঁর শ্রেণিকার্যক্রম দেখাতে পারে। শিক্ষকদের মধ্যে শ্রেণিকার্যক্রম দেখানোর প্রতিযোগিতার পর্যায়ে আসতে সময় লাগবে । এখন প্রশ্ন হলো কিভাবে তাদের কে এই প্রতিযোগিতার মানসিকতা আনা যায় ? শিক্ষকদের মধ্যে পাঠ দেখানোর ভীতি কাজ করে। এজন্য অনেক ভালো শিক্ষক ও পাঠ দিতে চায় না। তারা মনে করে পাঠদানের পর কর্মকর্তা অনেক ভুল ধরবে। এখান থেকে পরিত্রানের একটি উপায় হচ্ছে Lesson Study ।
Lesson Study হলো পাঠ সমীক্ষা হলো পেশাগত দক্ষতা উন্নয়নের একটি প্রক্রিয়া
যেখানে শিখন শেখানো কার্যক্রমের মান যাচাই ও উন্নয়নের লক্ষ্যে শিক্ষকগণ তাঁদের সহকর্মীদের সাথে সুশৃংখলভাবে কাজ করেন। শিক্ষকগণ তাঁদের সহকর্মীদের সাথে একযোগে কাজ করে শিখন শেখানো কার্যক্রমের উন্নয়ন ঘটাতে পারেন। পাঠ সমীক্ষা হলো ‘Plan-Do-See cycle’ কাঠামোয় পাঠের ধারাবাহিক মান উন্নয়ন। পাঠ সমীক্ষাকে পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন এবং মূল্যায়ন এই তিনটি ধাপে ভাগ করা যায়।
ধাপ-১: পরিকল্পনা
পাঠ পরিকল্পনা প্রণয়নে কয়েক সপ্তাহব্যাপী কতকগুলো কাজ করতে হয়। যেমন ঃ
শিক্ষণের বিষয়বস্তু পর্যালোচনা
পাঠ পরিকল্পনা ও পাঠ পরিচালনা সূচি প্রস্তুতকরণ
সহকর্মীদের সাথে প্রণীত পাঠ পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা
পরীক্ষামূলকভাবে শিখন শেখানো কার্যক্রম পরিচালনা
পাঠ পরিকল্পনা পরিমার্জন, ইত্যাদি।
ধাপ-২: বাস্তবায়ন
শিখন শেখানো কার্যক্রম বাস্তবায়ন ও পর্যবেক্ষণ
পাঠ পরিকল্পনা প্রণয়নকারী শিক্ষক শ্রেণিতে শিখন শেখানো কার্যক্রম পরিচালনা করবেন।
সহকর্মীরা শিখন শেখানো কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করবেন।
সহকর্মীরা পর্যবেক্ষণের সময় শিক্ষার্থীরা কী এবং কীভাবে শিখছে তার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দিবেন।
ধাপ-৩: মূল্যায়ন
পাঠের ওপর মূল্যায়ন ও প্রতিফলনমূলক আলোচনা
পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে অংশগ্রহণকারী শিক্ষকগণ পাঠটি পূনরায় পর্যালোচনা করবেন এবং
কীভাবে শিখন শেখানো কার্যক্রমের মান উন্নয়ন করা যায় তা নিয়ে আলোচনা করবেন।
কীভাবে পাঠ পর্যবেক্ষণ করবেন ও কী কী দেখবেন?
পাঠ পরিকল্পনার চূড়ান্ত করার পর পাঠ সমীক্ষা দলের সদস্যগণ নিম্নের বিষয়গুলোর প্রতি দৃষ্টি রেখে শ্রেণিকক্ষে পাঠ পর্যবেক্ষণের জন্য একত্রিত হবেন।
- পাঠের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনের মাত্রা
- পর্যবেক্ষণ কার্যক্রমের যথার্থতা ও গুণগতমান
- শিক্ষার্থীদের চিন্তার গভীরতা এবং পদ্ধতি
পর্যবেক্ষকের জন্য নির্দেশনা
নিম্নের নির্দেশনাসমূহ পাঠ পর্যবেক্ষককে সহায়তা করতে পারে।
শিখন শেখানো কার্যক্রম চলাকালে পাঠ পরিকল্পনা কতটুকু অনুসরণ করা হচ্ছে তার থেকে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে শিখন শেখানো কার্যক্রম মানসম্মত হচ্ছে কিনা সেদিকে মনোযোগ দেওয়া।
শিক্ষার্থীদের নিবিড় পর্যবেক্ষণের জন্য চেয়ার অথবা বেঞ্চে সারাক্ষণ বসা পরিহার করা। এ সময়ে শিক্ষার্থীদের সাথে বেশি কথা না বলা এবং অন্য পর্যবেক্ষকের সাথে গল্প না করা এবং নীরবে পাঠ পর্যবেক্ষণ করা।
পর্যবেক্ষণ শেষে অর্থপূর্ণ মতামত দেওয়ার জন্য পর্যবেক্ষণের সময়ে শিক্ষার্থীদের উক্তি, মিথষ্ক্রিয়া এবং শিক্ষার্থীরা কীভাবে ভুল করে ও সংশোধন করে ইত্যাদি বিস্তারিতভাবে লিখতে হবে।
পাঠ শেষ হওয়ার পর কীভাবে আলোচনা করবেন ?
সাধারণ নিয়মাবলী
পাঠ পর্যবেক্ষণের পর বাস্তব উদাহরণের ভিত্তিতে মন্তব্য করতে হবে।
উন্নয়নের ক্ষেত্র সুনির্দিষ্ট করে প্রস্তাবনাসমূহ প্রণীত হবে। যেমন, আমি যদি শিখন শেখানো কার্যক্রম পরিচালনা করতাম তাহলে আমি ..................... করতাম।
আলোচনা হবে অবশ্যই শিখন শেখানো কার্যক্রমের ওপর, শিক্ষকের কোন সমালোচনা হবে না।
আলোচনার বিষয়াদি/তথ্যাদি অবশ্যই পাঠ সমীক্ষা অফিসে সংরক্ষণ করতে হবে। পাঠ সমীক্ষা দলের নেতা সেই তথ্যাদি দলের অন্যান্য সদস্যদের মাঝে বিতরণ করবেন।
মূলবার্তা
পাঠের মানোন্নয়ন একটি চলমান প্রক্রিয়া। এটিকে অব্যাহত রাখতে হবে। এটি বন্ধ হলে পেশাগত উন্নয়নও ব্যহত হবে।
এখন প্রশ্ন হলো কিভাবে আমরা এই Lesson Study আমাদের বিদ্যালয়ের দৈনন্দিন কাজ স্বাভাবিক রেখেই করতে পারি, এই Lesson Study কার্যক্রম কে কে পরিদর্শন করবে ?
ধরুন একটি বিদ্যলয়ে ৮ জন শিক্ষক আছে। প্রত্যেক মাসে একজন শিক্ষককে Lesson Study কার্যক্রম করতে হবে। প্রধান শিক্ষক একটি বাৎসরিক রুটিন তৈরি করবেন । বাৎসরিক রুটিনে প্রত্যেক শিক্ষকের নাম এবং Lesson Study ও সম্ভাব্য তারিখ উল্লেখ করবেন। প্রত্যেক মাসের শুরুতে নির্ধারিত শিক্ষক Lesson Plan তৈরি করবেন এবং সহকর্মীদের টিফিনের ফাঁকে দেখাবেন। সহকর্মীদের দেখানোর পর নিধারিত শিক্ষক যে কোন বৃহস্পতিবারে স্টাফ মিটিং এ Lesson Plan নিয়ে আলোচনা করতে পারেন। এর পর নির্ধারিত শিক্ষক Lesson Plan টি চূড়ান্ত করবেন।
সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার প্রত্যেক মাসে ১০ টি , ইউআরসি ইন্সট্রাক্টর ৫ টি এবং সহকারী ইউআরসি ইন্সট্রাক্টর ৭ টি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শন করে থাকেন। প্রত্যেকে স্ব স্ব নিয়ন্ত্রণকারী কর্মকর্তার নিকট হতে বিদ্যালয় পরিদর্শনের অগ্রিম সময়সূচী অনুমোদন করে নেন। পরিদর্শনকারী কর্মকর্তারা এই অগ্রিম সময়সূচী বিদ্যালয়ে জানিয়ে দিবেন। তিনি যে দিন উপস্থিত হবেন ঐ দিনে ঐ পাঠটি নির্ধারিত শিক্ষক উপস্থাপন করবেন। নির্ধারিত শিক্ষক এই পাঠটি শেষের আগের পিরিয়ডে নিতে পারেন। এ সময় তিনি অন্যান্য শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ছুটি বা অন্য কোন কাজ দিয়ে ধরে রাখতে পারেন। এই পাঠটি উপস্থাপনের সময় সকল শিক্ষক এবং পরিদর্শনকারী কর্মকর্তা উপস্থিত থাকবেন। পাঠ উপস্থাপনের পর উপরে উল্লেখিত নিয়মানুসারে পাঠ পর্যালোচনা করবেন। এর ফলে ঐ বিদ্যালয়ের সকল শিক্ষক এবং পরিদর্শনকারী কর্মকর্তার ও পেশাগত উন্নয়ন হবে।
আর যদি ঐ মাসে কোন পরিদর্শনকারী কোন কর্মকর্তার পরিদর্শনসূচী না থাকে তাহলে নির্ধারিত শিক্ষক পাঠটি উপস্থাপন করবেন এবং অন্যান্য শিক্ষক পর্যবেক্ষণ করবেন। এভাবে প্রত্যেক মাসে বাধ্যতামূলক ভাবে পাঠ উপস্থাপন করলে শিক্ষকদের মধ্যে পাঠ উপস্থাপন ভীতি দূর হবে এবং সকল শিক্ষক ও পরিদর্শনকারী কর্মকর্তার পেশাগত মান উন্নয়ন হবে আমি মনে করি।