রোদটা বড্ড বেশি চোখে লাগছে । মুখভরতি দাঁড়ির জঙ্গল । এই অবস্থায় বড়ফুপুর বাড়ি গেলে কেমন হয় । এমনিতেই বড়ফুপা আর বড়ফুপু ২ জনেই আমার উপর ১৪৪ ধারা জারি করেছে । তাদের বাড়ির চৌদ্দ-সীমানা যেন না পাড়াই । তার উপর আজকের এই বেহাল দশায় উপস্থিত হলে খারাবি তো আছেই । এসব ভেবে কি আর মনের ইচ্ছা দমানো যায় । বাবার কত চেষ্টার ফলাফল শুন্য । একেবারে শুন্য যে হয়নি তা আমিও জানি । কিছু কিছু ক্ষমতা আমার মধ্যে তিনি তৈরি করে যেতে পেরেছেন ।
বাবা তার খাতায় লিখেছেন -
“ মহাপুরুষদের কোন দুঃখ, কষ্ট ,আনন্দ,ভয়,ইচ্ছা থাকা উচিত না । এগুলো তোমাকে মায়ার বন্ধনে যুক্ত করে দিতে পারে । তুমি এগুলোকে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করবে । ছোটবেলায় এই সব তুচ্ছ অনুভুতি নিয়ে তোমাকে আমি অনেক পরীক্ষাও করেছি । ”
বাবা খুব যত্নে এসব ছোট ছোট ঘটনা অবলীলায় পাতার পর পাতা লিখে গেছেন । কিন্তু অনেক বড় বড় ঘটনা তিনি সযতনে এড়িয়ে গেছেন । বাবার এই উক্তি এখন আমার কোনই কাজে আসছে না । এই কাঠ-ফাটা রোদের ভিতরে খালি পায়ে হাঁটার যে কষ্টটা হচ্ছে তা মোটেও এড়ানো যাচ্ছে না । মন চাইছে কোন সিএনজি বা রিকশায় উঠে পড়তে । আবার বাসেও ওঠা যায় । এসব ভাবতে ভাবতেই হাঁটছি । হঠাৎ বলা-কওয়া নেই একটা পাজেরো গাড়ি ঠিক আমার পাশে এসে থামল ।
“আরে হিমু ভাই না ?? ”- কণ্ঠ শুনেই মুগ্ধ হয়ে পাশ ফিরলাম । আরেকবার মুগ্ধ হতে হল গাড়িতে বসা মেয়েটিকে দেখে । শার্ট প্যান্ট পড়া , উগ্র মেকআপ দেওয়া কাউকেই আশা করেছিলাম , কিন্তু তার বদলে দেখি সুতির শাড়ি পড়া, হাত ভর্তি কাঁচের চুড়ি , আর চোখে বড় করে টানা কাজল । এই মেয়ের প্রসাধন ব্যবহার করার দরকার নেই , এমনিতেই সে স্বসৌন্দর্যে জ্বলছে । হঠাৎ মনে প্রশ্ন জাগল, শাড়ি পড়ে এই মেয়ে কিভাবে এই দামি গাড়ি চালাচ্ছে ?
মেয়েটি হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে হাসল । আমি চিনতে পারার ভঙ্গি করে বললাম , “কে , তামান্না না ?? ”
“ আপনি আমায় চিনতে পারেননি, তাই না হিমু ভাই ?? ”
এমন সুন্দরী মেয়ের কাছে ভুল স্বীকার করলে কিছু দোষের নেই । আমিও স্বীকার করলাম , “ হুম, আসলেই চিনি নাই । ”
“চিনতে পারেননি তাই বলে অন্য কারোর নাম বলবেন ?? এটা ঠিক না । যাই হোক , আমি ইরা । বাদলের কাকাতো বোন । এবার মনে পরেছে ?? ”
আমি মনে মনে বড়সড় একটা টাস্কি খেলাম । এই সেই মেয়ে । দারুন ব্রিলিয়ান্ট কিন্তু মনটা পাথরের মতো । অথচ এই অল্পকয়দিনে এরুপ পরিবর্তন , ব্যাপারটা কি । আমি এবার উচ্ছ্বসিত হয়ে বললাম “ ও তুই ইরা । ”
এবার ইরা সত্যি সত্যি তার সেই পাথর কঠিন দৃষ্টি দিয়ে আমার দিকে তাকাল । “আপনি বললেই পারতেন আপনি আমাকে চেনেন নি , কিন্তু তুই বলছেন কেন?? আপনি তো আমাকে আপনি করেই বলতেন । ”
“আসলে অনেকদিন পর দেখা তো তাই ভেবেছিলাম আপনাকে হয়তো বাদলের মতো তুই করেই বলি । ”
“কোথায় যাচ্ছিলেন আপনি ?? আপনার তো আবার নির্দিষ্ট কোন যাওয়ার জায়গা নেই । ”
“গুলশানে, বাদলদের বাসায় । ”
“আপনাকে না কাকা তার বাসায় যেতে নিষেধ করেছেন , তাও যাবেন ?? ”
“হুম, যাব। কারণ আজ একটা বিশেষ দিন । আজ ফুপা-ফুপুর বিবাহ বার্ষিকী । ”
তামান্না একটু অবাক হয়েই বলল , “ সত্যি নাকি বাগড়া দিচ্ছেন ?? ”
আমি বললাম , “সত্যি কিনা জানার একটাই উপায় আপনিও আমার সাথে চলুন । ”
“না, আমার অন্য কাজ আছে । আচ্ছা, আপনি যান যেখানে খুশি । ” – এই বলেই ভুশ করে গাড়ি চালিয়ে চলে গেল ।
ইরা চলে যাওয়ার পর মনে পড়লো ওকে তো প্রশ্নটা করা হল না , কিভাবে শাড়ি পড়ে গাড়ি চালাচ্ছে ।
তরঙ্গিণী স্টোরের সামনে যেতেই বদরুল সাহেব টেলিফোনের তালাটা খুলে দিলেন । আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “কি খবর বদরুল সাহেব ?? ”
“খবর বিশেষ ভালো না হিমু ভাই । গতকাল বউয়ের চিঠি পেয়েছি । বড় মেয়েটার অসুখ । কিন্তু হাতে একদম টাকা পয়সা নাই । ”
“ কেন, আপনার দোকান কি ভালো চলছে না ? ”
“নারে ভাইজান, কোন কাস্টমারই আসে না । যদি মশা-মাছি আসতো তাও শান্তি পেতাম । কিন্তু এরাও এই দোকানের দিকে ফিরে তাকায় না । ”
“আপনি তো আসলেই বিশেষ কষ্টে আছেন । ”
বলে আমি টেলিফোনের ডায়াল ঘুরাতে লাগলাম । আমাকে ডায়াল ঘুরাতে দেখে বদরুল সাহেব বিরস মুখে অন্যপাশে সরে গেলেন ।
অনেকদিন রুপার সাথে কথা হয় না । রুপাকেই ফোন করলাম । রুপা ধরল, জানতাম ওই ধরবে ।
“হ্যালো, কে ? ”
“রুপা আমি, হিমু । ”
ওপাশে একটা দীর্ঘশ্বাস টানার শব্দ পেলাম । তারপরই রুপা বলল ,
“কেমন আছো তুমি ?? ”
“আমি তো ভালই আছি । কিন্তু তোমার কণ্ঠটা একটু অন্যরকম লাগছে কেন ? ”
“কিছু হয়নি । এমনি , অনেকদিন পর কথা বলছ তো তাই এমন লাগছে । তা হঠাৎ কি মনে করে স্মরণ করলে ? ”
“তোমায় খুব দেখতে ইচ্ছা করছে । তোমার সেই নীল শাড়িটা পড়ে বারান্দায় দাঁড়াবে একটু । ”
“ মিথ্যে কথা । তুমি আসবে না । আসবে আসবে বলেও কখনই আসনি । ” রুপার কণ্ঠটা কাঁদকাঁদ হয়ে গেল ।
আমি আর কিছু না বলে ফোন রেখে দিলাম । ফোন কাটার পরই মনে পড়লো যে কারণে রুপাকে ফোন দিলাম সেইটাই বলা হয়নি । আজ রুপার জন্মদিন । ওকে উইশ করতেই ভুলে গেছি । ইদানিং কি জানি হয়েছে । যা করব বলে ভাবছি তা অসমাপ্ত রয়ে যাচ্ছে ।
রুপার প্রতি জন্মদিনেই আমি ওকে বলি যে আজ ওকে দেখতে আসব । কিন্তু কোনদিনই আসি না । রুপাও জানে আমি আসব না । তারপরও রুপা শাড়ি পড়ে, সুন্দর করে চোখে কাজল দেয় , কপালে দেয় ছোট একটা টিপ । পাউডারের হাল্কা পাফও বুলায় দু গালে । এরপর ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে আমার জন্য । আমি না গেলে কাঁদে বালিশে মুখ লুকিয়ে । অভিমান করে আমার উপর । মান-অভিমানের এই পর্বটা শেষ হতে বেশিক্ষণ লাগে না । কেননা ও জানে ওর এই পাগলামি আমার অন্তর স্পর্শ করে না ক্ষণিকের জন্যও । কিন্তু আজ আমি এর ব্যতিক্রম ঘটাব । আজ সত্যি রুপাকে দেখতে যাব ।
আমি চাইনা কেউ আমার জন্য অপেক্ষা করুক । তবুও রুপা নামের কেউ আমার জন্য অপেক্ষা করছে ভাবতেই কেন জানি ভালো লাগে । তখন মনে হয় , এভাবেই চলুক না জীবন । এভাবেই কেউ আমার জন্য না হয় অপেক্ষা করুক ।
রুপার জন্য কিছু টাটকা গোলাপ কিনতে হবে । টাটকা গোলাপের খোঁজে আবারও সামনের দিকে পা বাড়াই । বড়ফুপার বাসায় যাওয়ার প্লানটা আপাতত বন্ধই থাক ।