“ ধ্রুব নিথর হয়ে বসে রইল কিছুক্ষন । কান্না এলো না,তেমন কষ্ট হল না । শুধু বুকের ভিতরটা মথিত হয়ে একটা ডাক উঠে আসতে চাইছিল – বাবা ! ”
বহুকাল আগে শীর্ষেন্দুর ‘ দূরবীন ’ বইটায় পড়া লাইনগুলো মনে পড়ে গেল । কি অদ্ভুত! তাই না । আজ ধ্রুবর মতো আমারও বুকের ভিতরটা মথিত হয় । চিৎকার করে বাবাকে ডাকতে ইচ্ছা করে । কিন্তু যাকে ডাকতে চাই সেই মানুষটাই আজ বহুদুরে চলে গেছেন । কতবছর পার হয়েছে কিন্তু আমার আর্তনাদের তীব্রতা আজও অমলিন । যখন সময় ছিল তখন এই শব্দটাকেই বড্ড ভয় পেতাম । আর এখন মানুষটির অভাব বড় বেশি অনুভব করি ।
৫ ভাইবোন আর মা-বাবা আর জগলু কাকা এই নিয়েই আমাদের বৃহৎ পরিবার ছিল । পরিবারে সুখ-শান্তির অভাব হোক আর না হোক একটা জিনিসের অভাব কখনই ছিল না । আর তা হল ভয় । আমরা ৫ ভাইবোন চরম ভয় পেতাম বাবাকে । আমাদের ভাইবোনগুলোর একটা বৈশিষ্ট্য ছিল ; সবগুলাই ছিলাম পিঠাপিঠি । আর তাই মারামারি , ঝগড়াঝাঁটি এমনকি চুল টানাটানিও অহরহ ব্যাপার হওয়ার কথাই ছিল । কিন্তু যার জন্য হল না , তিনি হলেন আমাদের বাবা । বাবা ছিলেন খুব রাগী একজন মানুষ । তিনি কখনই আমাদের সাথে নরম সুরে কথা বলতেন না । সবসময় গম্ভীর হয়ে থাকতেন । তাকে দেখলে মনে যেন একটা আগ্নেয়গিরি জ্বলছে , যখন তখন লাভা উদ্গিরন শুরু করবে । তাই পারতপক্ষে আমরা কেউ তার সামনে যাওয়ার সাহস পেতাম না ।
আমরা ৪ টা বোন আর এক ভাই ছিলাম । ভাই ছিল মাঝামাঝি পজিসনে , মানে থার্ডে । যখন বুঝবার মতো বয়স হল তখন দেখলাম আমরা সবাই স্কুল নামক একটা জেলখানায় ভর্তি হয়ে গেছি । কিন্তু এটাকে জেলখানা বললেও এই একটাই জায়গা ছিল , যেখানে আমরা ৫ জনই আমাদের সকল বাঁদরামি প্রতিভার উন্মেষ ঘটাতে পারতাম । এমন কোন কাজ নাই যা আমরা করিনাই ; আর অন্যরা বিরক্ত হয়নাই । যাই করি না কেন আমাদের পড়াশোনা ভালই হতো , কেননা বাবা আমাদেরকে সন্ধ্যার সময় পড়াতে বসতেন । এমনি সময় যেভাবে পারি লুকিয়ে থাকতাম, কিন্তু এই সময়টায় যদি হাজির না হতাম তাহলে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা থাকতো ।
একটা ঘটনা বলি । আমাদের ভাইটা(অপু) আমাদের চেয়েও বান্দর ছিল । ও একদিন জগলু কাকার চোখ এড়িয়ে এই সময়টাতেই বাইরে লুকিয়ে ছিল । বাবা সাধারণত আমাদের ৩ ঘণ্টা পড়াতেন । এর মধ্যে যদি পড়া শেষ না হতো, তাহলে বাবা আমাদের ফজরের ওয়াক্তে আবার পড়াতে বসতেন । আমরা ২ বার রিস্ক নিতে চাইতাম না , একবারের ডোজই যথেষ্ট । বাবা পড়াতে বসে দেখলেন ও নেই । বাবার মুখ দেখেই বুঝলাম যে বাবা খুব খেপেছেন ।
“ যাও, আজ তোমাদের পড়তে হবে না । ”- গম্ভীর মুখে বাবা বলে উঠলেন । আমরা ৪ জনই অবাক হয়ে বাবাকে দেখতে লাগলাম । আমাদের তখনও বসে থাকতে দেখে বাবা এবার ধমক লাগালেন । আমরা পড়িমরি করে উঠে পড়লাম ।
তো ৩ ঘণ্টা পার হবার পর অপু বাড়ি ফিরল । আর ফিরেই বাবার সামনে পড়ে গেল । বাবা ওকে দেখেই জগলু কাকাকে ডাক দিলেন । কাকাকে বললেন কিছুদিন আগে যে কঞ্চিটা বানিয়েছেন সেটা নিয়ে আসতে । কাকা কঞ্চি আনতেই ওর উপর যে জিনিস নামলো তা দেখে আমরাই কাঁদতে লাগলাম । ওই সময় মা যদি ওকে বাবার কাছ থেকে ছাড়িয়ে না আনতেন তাহলে কি হতো বলা যায় না ।
বাবা এরপর মাকে বললেন আজ যেন রাতে ওকে খেতে দেওয়া না হয় । এমনকি আমাদেরকেও বাবার সামনে বসেই খেতে হল যাতে আমরা অপুর জন্য খাবার না নিয়ে যেতে পারি । ওই রাতে অপুর ফোঁপানিতে আমাদের আর ঘুম হল না । অনেক রাতে শুনি বাবা আমাদের ঘরে এসেছেন । এসে অপুকে ডাকছেন । আমাদের ছোট বোন টুনিটা আবার অপুর ন্যাওটা ছিল খুব । ও হঠাৎ বলে উঠলো , “ বাবা , আপনি আবার ভাইয়াকে মারতে এসেছেন ? ” কিন্তু কি অদ্ভুত ব্যাপার , বাবাকে আমরা কাঁদতে দেখলাম এই প্রথমবারের মতো ;হয়তো শেষবারের মতোও । বাবা অপুকে অনেক আদর করে খাওয়াতে নিয়ে গেলেন, এমনকি টুনিকেও নিজ হাতেই খাইয়ে দিলেন । বুঝলাম আমাদের বাবাটা খুব একটা খারাপ না ।
আমরা ৫ ভাইবোন বাবাকে সে অর্থে খুব একটা কাছে পাইনি । কিন্তু যতটুকু পেয়েছিলাম সেইটুকুই অম্লান ছিল । বাবা কখনও আমাদেরকে কাছে ডেকে ভুতের গল্প শোনাতেন না । কখনও পাশে বসে একটু আদরও করতেন না । কখনও দেখিনি বাবা, আমাদের কারো হাতে একটা চকলেট ধরিয়ে দিয়ে বলছেন নে খা । তবুও বাবার ওই সামান্য উপস্থিতি আমাদেরকে বলত, “ তোদের কোন ভয় নেই । আমি আছি না । ”
স্কুলে অনেক বন্ধু-বান্ধবির একটা সার্কেল গড়ে উঠেছিল । ওদের কাছে ওদের বাবাদের মজার মজার গল্প শুনতাম , দেখতাম ছুটি হলে বাবার হাত ধরে ওদের বাড়ি যাওয়ার হুটোপুটি । দেখে কখনও হিংসা হতো , আবার কখনোবা মনে হতো নাহ এই তো বেশ আছি । টুনির বয়স যখন ১০ হল তখন আমাদের সবচেয়ে প্রিয় আশ্রয়স্থল আমাদের মা চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে । এজন্য মার উপর অভিমান হতো । আমাদেরকে এভাবে বাবার মতো কঠোর একজন মানুষের কাছে কেন ফেলে গেলেন এই ভেবে । মা মারা যাবার পর বাবা কেমন জানি হয়ে গেলেন । হয়তো অনেক কঠোর ; হয়তো অনেক নরম । কিন্তু আমাদের বকতেন না আর । তবু তার রাগী লাল চোখের রঙটা আরও একপোঁচ গাড় হয়েছিল এটা টের পেয়েছিলাম ।
কিন্তু বাস্তবতা কি জিনিস তখনও পুরোপুরি বুঝিনি । তার ২ বছর পর যখন টুনিটা মারা গেল তখন বুঝলাম আসল জিনিস । বাবাকে একফোঁটা চোখের পানি ফেলতে দেখিনি । কিন্তু তার চোখের কোণে অশ্রু খেলা করতো এটা দেখতে পেতাম । টুনির মৃত্যুর পর জগা কাকাও কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিলো । ও মারা যাবার পর আমার রাতে ঘুম হতো না । কেন জানি আমি ভাবতাম আমার লক্ষ্মী বোনটা হয়তো রাতে ভয় পাবে , দরজা খুলতে বলবে , আমাকে ডেকে বলবে “ বুবুনি, ভয় লাগছে । একটা গল্প শোনাও না । ” আমি যদি ঘুমিয়ে পড়ি তাহলে আমার বোনটাকে কে দেখবে? কে ওকে গল্প শোনাবে ? কে ওর ভয় তাড়াবে ? ও যে বড্ড ভীতু । আমি জেগে থাকতাম বলে টের পেতাম বাবা মাঝে মাঝে আমাদের ঘরে আসতেন , আমাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে চাইতেন । কিন্তু কি এক সঙ্কোচে তার হাত আর নামত না , থেমে যেত আমাদের মাথা স্পর্শ করার আগেই ।
প্রতিদিনই দেখতাম বাবা কোথায় যেন চলে যান রাতের আঁধারে । একদিন সাহস করে তার পিছন পিছন গিয়েছিলাম । বাবাকে খুঁজে পেয়েছিলাম টুনির কবরের পাশে । দেখেছিলাম কি অব্যক্ত কষ্টে বাবার মুখ বিকৃত হয়ে যাচ্ছে , কিন্তু চোখ তখনও শুকনো । সেদিন বাবাই আমাকে শেখালেন কিভাবে কষ্টকে বুকে চেপে রাখতে হয় । বাবাকে দেখেই আমিও যেন ওইদিন থেকেই কাঁদতে ভুলে গিয়েছিলাম ।
একসময় আমরা এক এক করে বড় হয়ে উঠলাম । বড় ২ বোনের বিয়ে হয়ে গিয়েছিলো ইন্টার এর পরপরই । আর ভাইটা ভার্সিটিতে গিয়ে আর ফেরেনি । আমি একাই বাবার কাছেই রয়ে গেলাম । এতদিনেও বাবার একটা অভ্যাস ঠিকই ছিল । তা হল প্রতিদিন টুনির কবরে গিয়ে রাত কাটান আর সকালে ফিরে আসেন । এভাবে একদিন দেখি বাবা আর ফিরলেন না । হঠাৎ করেই বুঝলাম তিনি না ফেরার দেশেই চলে গেছেন । গ্রামের কিছু মানুষ বাবাকে নিয়ে এসেছিল বাড়িতে । তারা নাকি টুনির কবরের পাশে বাবাকে পড়ে থাকতে দেখেছিল ।
বাবাকে টুনির পাশেই শায়িত করা হয় । বাবার মৃত্যুতে আমার কেন জানি খারাপ লাগেনি । মনে হচ্ছিল এই তো ভালো হল, এতদিনে মানুষটা একটু শান্তি পেলেন । কতরাত তিনি পড়ে থেকেছেন টুনির পাশে । আজ তো তিনি টুনির কাছেই চলে গেলেন চিরদিনের মতো । এটা ভেবে আমার সুখ হচ্ছিল । একফোঁটা চোখের পানিও আমি ফেলিনি । বাবার কাছ থেকেই তো শিখেছিলাম কিভাবে কান্নাকে চাপা দিতে হয় ।
আজ খুব কাঁদতে ইচ্ছা করে । বাবার চোখ রাঙ্গানি দেখতে ইচ্ছা করে । বাবার কাছে বায়না ধরতে ইচ্ছা করে । বাবাকে ওই রাতে সাহস করে বলতে পারিনি “বাবা , তোমার হাতটা একটু মাথায় রাখবে । একটিবারের জন্য আমি তোমার হাতের স্পর্শ পেতে চাই । আমার খুব একা লাগছে বাবা, খুব ভয় করছে । তুমি একবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে আমার ভয় একদম কেটে যাবে ।” “আমাকে একটা গল্প শোনাও না বাবা ।” “ কতদিন তোমার বকা শুনিনি বাবা , কতদিন আমাদেরকে তুমি পড়াতে বসাও নি । আজ খুব পড়তে বসতে ইচ্ছা করছে ।” “কখনও তোমায় বাবা বলে ডাকাও হয়নি, শুধু টুনি একবার তোমায় বাবা বলে ডেকেছিল । সে জন্যই কি তুমি টুনির কাছেই থাকতে বেশি বেশি ??? ”
জানো বাবা , আজ তোমায় বড্ড দেখতে ইচ্ছা করে । যখন তুমি আমাদের মাঝে ছিলে তখন তোমার অস্তিত্ব ছিল অশরীরীর মতই । আজ তুমি কত দূরে, কিন্তু এখন তোমাকেই অনেক আপন মনে হয় । তখন তোমার অবস্থা দেখে মানুষ বলত তুমি নাকি পাগল হয়ে গেছ । কিন্তু আমি জানি আমার বাবা পাগল ছিলেন না , বাবা তার কষ্টকে প্রকাশ করতে পারতেন না । বাবারে যে তা পারেন না । বাবা ছিলেন আমাদের শরীরের একটা হাত বা পায়ের মতো ... যখন একটা হাত বা পায়ের কোনটা কোনকারনে নষ্ট হয়ে যায় তখন আমরা হয়তো আর একটাকে ব্যবহার করতে পারি । কিন্তু যেটা নেই সেটার অভাব প্রতিনিয়ত অনুভব করি । আমাদের পথ চলা হয়তো থেমে থাকে না ,কিন্তু খুব ধীর হয়ে যায় ।
অথবা বাবা হল একটা গাছের মতো , যে গাছের গোঁড়া কেটে দিলে তার ডালপালার কোন অস্তিত্বই আর থাকে না । একটা ছায়ার মতো , যে ছায়ার নিচে আমরা আমাদের স্বপ্নগুলোর ডানা মেলতে পারি । আজ আমি আমার সেই হাত-পা , সেই গাছ , সেই ছায়ার সন্ধান করি । আজ আমি সারা বিশ্বকে নয় , সারাদেশকে নয় , শুধু আমার বাবাকেই শুনাতে চাই “ বাবা , তোমায় খুব ভালোবাসি , তোমায় খুব মিস করি । যখন তুমি ছিলে তখন তোমায় বুঝতে না পারার জন্য তোমার কাছে অসংখ্যবার ক্ষমা চাই । তোমার হাতটা কিছুসময়ের জন্য আমার মাথায় অনুভব করতে চাই । তুমি কি দেবে না বাবা ??? ”