চারদিক অন্ধকারাচ্ছন্ন । মাঝে মাঝে গোলাগুলির শব্দ ভেসে আসছে । কখনও বা একবার দুবার, কখনও একটানা সাইরেনের মতো । মেঝেটা খুব স্যাঁতস্যাঁতে । ঘরটাতে এতই অন্ধকার যে ভিতরে কি আছে বা কারা আছে দেখাই যাচ্ছে না । কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ ভালমতো খেয়াল করলে কয়েকটা মানব মূর্তি দেখা যায় ; ভুল বললাম আসলে মূর্তিগুলো মানবীর । মূর্তি বলছি কারণ ওরা অসাড় হয়ে পরে আছে । কারো গায়েই একটা সুতাও নেই । এটা একটা মিলিটারি ক্যাম্প ।
আমাকে এখানে ফেলে গেছে খুব বেশি হলে ২ ঘণ্টা হয়েছে । আমি যখন এখানে এসেছি তখন আমিও ওদের মতই অসাড় ছিলাম । আমার অসাড়তা ভেঙেছে একরাশ যন্ত্রণা নিয়ে । সারাশরীরের এখানে ওখানে প্রচণ্ড ব্যথা ; ব্যথাটা ক্রমাগত ছড়িয়ে পরছে । মনে হচ্ছে অসাড় জীবনটাই স্বর্গসুখ ছিল । বুকে আর নাভির নিচে কোন অনুভুতি নেই । খুব তেষ্টা পেয়েছে । অনেক কষ্টে মুখ খুললাম পানি খাব বলে । হঠাৎ অসাড় মূর্তিগুলোতে প্রাণের স্পন্দন দেখা গেল । ওদেরই কেউ উঠে এসে পানি খাইয়ে দিলো । আমি আবার স্বর্গসুখে তলিয়ে গেলাম ।
***
হিজলপুর গ্রাম । জীবনানন্দের রূপসী বাংলার সব রূপ গায়ে মেখে আছে গ্রামটি । গ্রামের মেঠোপথ ধরে হেঁটে আসা যুবকটিকে দেখছে গ্রাম্য-বালিকাটি । যুবকটিকে ভালো লাগে ওর; হয়তো ভালও বাসে । কিন্তু গ্রাম-অঞ্চলে কেউ এ কথা মুখে বলে না । চোখের ভাষা একে অপরের পড়া হয়ে যায় । এক সময় একথা পরিবার পর্যন্ত পৌঁছায় । অতঃপর তার সাথেই অথবা অন্য কারো সাথে বিয়ে হয়ে যায় । অন্য কারোর সাথে হলে ভাব আদান প্রদানের ওখানেই সমাপ্তি ঘটে, কিন্তু ভালোবাসাটা মরে না । নিজের মধ্যেই বাড়তে থাকে ; একতাল অকেজো মাংসপিণ্ডের মতো ।
যুবকটির নাম কমল আর বালিকাটি কলি । পাশাপাশি বাড়ি ওদের । ছেলেবেলা থেকেই একসাথে বেড়ে উঠেছে ওরা । সেই ছোট থাকতেই ওদের বিয়ে ঠিক হয়ে আছে ; ২ টি পরিবারের আরও নিবিড় হয়ে আসার প্রথা অনুসারে । এ বছরেই ওদের বিয়েটা হবে ; হয়তো এ মাসেই । দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে । কিন্তু এর কোন টোকাই ওদের উপর এখনও পরেনি ।
কাল কমলের শহরে যাবার কথা । কলির জন্য লাল শাড়ি , লাল চুড়ি , আলতা , চুলে বাঁধার জন্য লাল ফিতা এভাবে লিস্ট করতে লাগল কমল । হঠাৎ জানালা দিয়ে বাইরে চোখ পড়তেই কমল দেখল ওর ঘনিষ্ঠ বন্ধু হাসু ওর বাড়ির দিকেই ছুটতে ছুটতে আসছে । কিছু না ভেবেই হাসুর দিকে ছুটে গেল ও ।
কমল- কি রে হাসু ? কি হইছে ?
হাসু- গ্রামে মিলিটারিরা আইছে কমল । আমাদের স্কুলঘরটারে তাগো ক্যাম্প বানাইছে । শুনছি গ্রামের সব জোয়ান পোলাপাইনরে নাকি কাল ক্যাম্পে লইয়া যাইব ।
কমল- কি করবি বইলা ভাবছিস ?
হাসু- আমি মুক্তিযুদ্ধ করুম । মারে কোনরকমে বুঝাইয়া বাইর হইছি । তোর কাছে আইছি তুই যাবি কিনা জানতে ।
কমল- কিন্তু কলি ..................
হাসু- দেশ স্বাধীন করতে পারলে আমাগো কোন দুঃখ থাকবে না । তুই কলিরে নিয়া চিন্তা করিস না । কলির জন্যি তুই যুদ্ধে যাবি ।
কমল- ঠিকই কইছস । দেশ আগে । তারপরও একবার কলিরে বলা দরকার ।
হাসু- চাচীরে কিছু কইবি না ?
কমল- কলিই মারে বুঝাইবনে ।
হাসু- চল তাইলে । রাত পোহাবার আগেই বর্ডারে পৌঁছাইতে হইব ।
“কলি......... কলি ” ফিসফিস করে ডেকে ওঠে কমল । কলি ভয়ে ভয়ে জানালা খুলে দেখে কমল দাঁড়িয়ে আছে , সাথে হাসু ভাই ।
কলি- কি হইছে কমল ? কই যাও তোমরা ?
কমল- আমরা মুক্তিযুদ্ধে যাইতাছি কলি ।
কলি- কিন্তু তোমার আর আমার ...!
কমল- হুম, আমি তোমার আর আমার জন্যই যুদ্ধে যাইতাছি । মারে কইতে পারিনাই । তোমার উপরেই সব ছাইড়া দিলাম । মারে তুমি সব বুঝাইয়া কইবা ।
কলি কমলের হাত ছাড়তে চায় না ; কিন্তু কিছু কিছু হাত চাইলেও ধরে রাখা যায় না ।
কমলের যুদ্ধে যাওয়ার পর ৩ মাস পার হয়েছে । প্রতিদিন ভয়ে ভয়ে থেকেছে ওরা এই বুঝি কেউ খবর দেয় যে কমল আর নাই । এই বুঝি ওদের বাড়িতে মিলিটারি আসে । বহুবার বহুভাবে বুঝিয়ে কলিকে মামাবাড়ি পাঠানো গেল না । এতদিন যে ভয়ে রাতদিন পার করেছে ওরা সেটাই ঘটে গেল এবার । একদল মিলিটারি গ্রাম ছাড়খার করতে এলো । ধরে নিয়ে গেল কলির মতো আরও অনেককে । অতঃপর ..............................!!!
***
“ দাদীমা, এরপর কি হল ? ”- ছোট্ট পুষ্প জানতে চায় কলির কাছে । তার ছোট্ট হাতটি দিয়ে আঁকড়ে ধরে কলির হাত ।
কলি আবার শুরু করে , “চারদিক অন্ধকারাচ্ছন্ন । মাঝে মাঝে গোলাগুলির শব্দ ভেসে আসছে । কখনও বা একবার দুবার, কখনও একটানা সাইরেনের মতো । মেঝেটা খুব স্যাঁতস্যাঁতে । ঘরটাতে এতই অন্ধকার যে ভিতরে কি .................. ” ।