সেটি ছিল একটা ভয়ানক রকমের সাহসী কথা! “কেউ যদি এবার সারা বাংলাদেশে স্ট্যান্ড করা ছাত্রদের মধ্যে প্রথম হতে চাও, তাহলে তার পরিশ্রমটাই শুধু বৃথা যাবে। এবার আমিই প্রথম হব সমগ্র দেশের মধ্যে। তোমাদের কারো যদি একান্ত ইচ্ছা থাকে তাহলে দ্বিতীয় হওয়ার জন্য চেষ্টা করতে পারো!” আশ্চর্যের কথা হল ছেলেটি তাই হয়েছিল! এ কেমন আত্মবিশ্বাস! অবশ্যই সেটা অনেক শক্তিশালী! এ ঘটনা আশির দশকের একটি ঘটনা – যা আমার স্যারের মুখে শুনেছিলাম সেই ছোট্টবেলায়। আত্মবিশ্বাসের জোরেই কেউ দড়ির উপর সাইকেল চালাতে পারে, কেউ মহাকাশ ঘুরে আসে। একটা বইয়ে পড়েছিলাম, একবার এক ফুটবল খেলায় এক খেলোয়ার গোলবারে শর্ট করার পরে বলটি গোলবারের উপরের বারে লেগে ফিরে আসে। মুহূর্তেই সে রেফারিকে চ্যালেঞ্জ করে বসে যে গোলবারের উপরের বারটি সঠিক জায়গার চেয়ে এক ইঞ্চি নিচু আছে। ফলে রেফারি তার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে সঙ্গে সঙ্গেই মাপতে নির্দেশ দেয়। মাপার পর দেখা যায় সেটি সত্যি সতি এক ইঞ্চি নিচু! বিশ্বাসের জোর দেখেছেন! রাজশাহী বিশ্ববিদায়লয়ের এক ফ্যাকাল্টি ফার্স্ট বড় ভাই বলেছিলেন- আমি আমার জীবনে সবসময় একটা কথা মনে রেখেছি। সেটা হল – আই অ্যাম অলঅয়েজ ফার্স্ট, বাই চান্স সেকেন্ড, বাট নেভার থার্ড!উনি এখন ওখানকারই শিক্ষক!
শুধু লেখার খাতিরেই বলছি এরকম দুটি ঘটনা, এ ধরণের অনেক ঘটনা আপনাদের জীবনেও থাকতে পারে। শহরের স্কুলগুলোর মত গ্রামের স্কুলগুলোতে আসলে অতটা হাড্ডাহাড্ডি প্রতিযোগিতা হয়না। এই ধরূণ এক বা দুই, অথবা পয়েণ্ট দশমিক নম্বরের জন্য এক রোল বা দুই রোল হয়ে যাওয়া। আমি তখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি। আমাদের ক্লাসে তখন ফার্স্ট ছিল এক মেয়ে আর আমি সেকেন্ড। ম্যাথ টিচার বছরের শুরুতেই চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলল, এখন তুমি আর এক রোলে কখনোই যেতে পারবে না, কেননা ও যেভাবে পড়াশুনা করে তা তুমি কোনদিনই করতে পারবে না। আমি স্যারকে বললাম, স্যার দোয়া করবেন! বার্ষিক পরীক্ষার রেজাল্ট যেদিন দিবে সেদিন আমার বুক ঢিব ঢিব করছে! অন্য এক স্যার এসে বলল, ফেরদৌস, তোমাকে নিয়ে যেরকম রেজাল্ট আশা করেছিলাম সেরকম হয়নি। আমি তোমার রেজাল্টে হতাশ!আমি লজ্জায় মাথা অবনত করলাম। মনে মাটির ভেতরে ঢুকে যাই! অপমানের কান্না চোখে জোর করে নামতে চাইল! লাইনে দাঁড়িয়ে রেজাল্ট ঘোষণা যখন শুনছি, মনে মনে ভাবছি, শুনে আর কী হবে, ছেড়ে দিলেই তো বাঁচি। হঠাৎ দেখি তৃতীয় স্থানে আমার বন্ধুর নাম বলার পরে দ্বিতীয় স্থানে আমার সেই বান্ধবীর নাম ঘোষণা হচ্ছে। তার মানে আমিই প্রথম! বিশ্বাসই হচ্ছিল না! মনে হয় কেঁদেই ফেলেছিলাম আমার নামটি প্রথম স্থানে শোনার পর। কিন্তু পার্থক্য ছিল মাত্র এক নম্বরের!
আপনি কীভাবে আপনাকে দেখাবেন পুরো দুনিয়ার সামনে, সেটা আপনারই বিষয়। আপনি যদি চিতাবাঘ হিসেবে নিজেকে দেখান তাহলে আপনাকে সেরকম শক্তি আর ক্ষিপ্রতার গুণ অর্জন করতে হবে। আর বিড়াল হিসেবে দেখাতে চাইলে লেজ নাড়িয়ে মিউ মিউ করলেই চলবে! সামান্য কিছু দুঃখ দুর্দশায় যদি আপনি কাদিয়ে বিছানা ভাসাবেন, মনে করবেন আপনার মত বিরহী কেউ নেই, কাছের মানুষগুলো কেউ আপনাকে বোঝে না এবং আত্মহত্যায় আপনার জীবনের শেষ চিকিৎসা – তাহলে আপনাকে বলার কিছুই নেই। আফ্রিকা আর মধ্যপ্রাচ্যে মানুষ চোখের সামনে নিজের কাছের সকল মানুষকে বোমার আগুনে ঝলসে যেতে দেখেও, বাসস্থান গুড়িয়ে যেতে দেখেও, বেঁচে থাকার জন্য পরের বেলা কী খাবে তা না জেনেও নিজে বাচার স্বপ্ন দেখে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে! সাহস অন্য জিনিস, সবার সব কাজের সাহস থাকে না, আবার সবসময় সব কাজে সাহস দেখানোও ঠিক না। কিন্তু সময়মতো পুরোটাই দেখাতেও আবার হবে। মাহাথির মোহাম্মদ যে রাস্তা দিয়ে প্রতিদিন স্কুলে যেতেন সে রাস্তায় একটা কুকুর তাকে প্রতিদিনই তাড়া করতো। একদিন উনি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলেন উনি আর কুকুরকে ভয় পাবেন না বরং উল্টো কুকুরকেই চোখ রাঙ্গানি দিবেন। ব্যস, যেই কথা সেই কাজ। এরপর কুকুরই উনাকে ভয় পেয়ে লেজ গুটিয়ে চলে গেল। উনি বলেছেন, “এরপরে জীবনে কোন বড় সমস্যা সামনে আসলেই এরকম চোখ পাকিয়ে তাকাই তার দিকে। তখন সে আপনিই আমার কাছে হার স্বীকার করে! সাহস আত্মবিশ্বাসের জোর এমনই! আমাদেরকে আত্মবিশ্বাস রাখতে হবে হিমালয়ের মত উঁচু আর দৃঢ়, আর চিতাবাঘের মতই ক্ষিপ্র! এ পি জে আব্দুল কালাম আজাদ বলেছিলেন – জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানরা ক্লাসের পেছনের বেঞ্চিতেই বসে থাকে!
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা মার্চ, ২০১৬ রাত ২:৩৬