আস্সালামু-আলাইকুম.......। হে মুসলিম ভাই! ইদানীং আমাদের দেশে কয়েকটি বিদেশী কোম্পানী ‘নেটওয়ার্ক ব্যবসা’ নামে এক বিশেষ পদ্ধতিতে নতুন ব্যবসা চালু করেছে। তন্মধ্যে ডেসটিনি-২০০০ এবং চীনকেন্দ্রিক টিসি (টেংসেং) বা ইন্টারন্যাশনাল ক্যারিয়ার প্লান এবং কানাডা কেন্দ্রিক জিজিএন বা গ্লোবাল গার্ডিয়াল নেটওয়ার্ক এবং ডি, এক্স, এন লিঃ অন্যতম। তাদের উদ্ভাবিত পদ্ধতির নাম হলঃ- মাল্টিলেভেল মার্কেটিং সিস্টেম বা নেটওয়ার্ক বিজনেস ইত্যাদি। সেই পদ্ধতির সার সংক্ষেপ হলঃ- তারা বিশেষ কিছু পণ্য এভাবে সরবরাহ করে থাকে যে, যে কেউ এ পণ্য তাদের দেয়া শর্ত মাফিক ক্রয় করবে, সে কোম্পানীর একজন ডিলার-সদস্য (member) তথা প্রতিনিধি হয়ে যাবে। এর ডকুমেন্স (ID card) তাকে দেয়া হবে। আর সাথে সাথে তার মাধ্যমে কোম্পানীর একটি গ্রাহক প্লাস ডিলারের জালচক্র সূচিত হবে। সে জালচক্রে মূল ডিলারের প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ প্রচেষ্টায় একের পর এক গ্রাহক-সদস্য জালচক্রে জড়াতে থাকবে- যাদের থেকে নির্দিষ্ট হারে ক্রমধারায় উপরস্থ ডিলারগণ নির্ধারিত পয়েন্টের মাধ্যমে ক্রমবর্ধমান হারে কমিশন পেতে থাকবে।
প্রশ্ন হল, ইসলামী শরীয়ত এ ধরনের ব্যবসা সম্পর্কে কী বলে? এ ব্যবসা করে কমিশন ভোগ করা শরীয়তসম্মত হবে কি? বর্ণিত পদ্ধতিতে ব্যবসা শরয়ী হুকুম সম্পর্কে বেশ কিছুদিন যাবত মুফতীয়ানে কিরামের নিকট প্রশ্ন করা হচ্ছিল, যার প্রেক্ষিতে তারা বর্ণিত ব্যবসাটি সম্পর্কে প্রথমত ভালভাবে জেনে নেন। অতঃপর এ ব্যাপারে ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার বসুন্ধরায় দেশের বিভিন্ন স্থানের শীর্ষস্থানীয় মুফতীগণের সমন্বয়ে একটি বৈঠক হয়। সে বৈঠকে বিস্তারিত পর্যালোচনার পর উক্ত ব্যবসা পদ্ধতি অবৈধ ঘোষণা করা হয়। অনুরুপভাবে জাতীয় মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড বেফাকের অধীনে এ বিষয়ে মুফতি বোর্ডেও পর্যায়ক্রমে বহুবার মজলিস হয়। সেখানে এ সম্পর্কে দীর্ঘ পর্যালোচনা ও গবেষণা করা হয়। সেই সুদীর্ঘ গবেষণার এ ফলাফল বেরিয়েছে যে, এ ব্যবসাটি বহু দিক দিয়ে ইসলামি নীতিমালার পরিপন্থী। ইসলামি দৃষ্টিতে উল্লেখিত মাল্টিলেভেল মার্কেটিং সিস্টেম বা নেটওয়ার্ক বিজনেস পদ্ধতি নাজায়িয (হারাম) প্রমাণিত হয়। কারণ, ইসলামের হুকুমমতে, উল্লিখিত পদ্ধতি তথা নেটওয়ার্ক বিজনেস বা মাল্টিলেভেল মার্কেটিং সিস্টেমকে দু’ ভাবেই বিশ্লেষণ করা যেতে পারে:
১, এটা মূলত আকদে বাই তথা বেচাকেনার লেনদেন, যার সাথে সম্পৃক্ত আছে আকদে ইজারা তথা ব্রোকার নিয়োগ চুক্তি। উল্লেখ্য যে, এখানে কোম্পনীর মূল উদ্দেশ্য পন্য বিক্রি করা হলেও গ্রাহকের মূল উদ্দেশ্য ডিলারশীপ। কোম্পনীর ম্যানুফেক্টও ডিলারশীপকে লক্ষ্য করেই তৈরী করা হয়েছে। তাহলে এ কথা সুস্পষ্ট যে, একজন ক্রেতার নির্দিষ্ট পণ্যটিকে কেনার অর্থ এটাই যে, পণ্য কেনার সাথে সাথে,কোম্পনীর নীতি অনুযায়ী আমি ডিলারশীপও চাই। সুতরাং ডিলারশীপটি উক্ত বেচাকেনায় ক্রেতার পক্ষ থেকে একটি মুখ্য চাহিদা বা শর্ত বলে বিবেচিত হবে।
২, এটাকে মূলত আকদে ইজারা তথা ব্রোকার চুক্তিও বলা যায়-যার সাথে শর্ত করা আছে আকদে বাই’ তথা বেচা-কেনার মু‘আমালা।
এভাবে উক্ত ব্যবসাটির উল্লিখিত বিশ্লেষণদ্বয়ের যে বিশ্লেষণই করা হোক না কেন, সর্বাবস্থায় উক্ত ব্যবসা সম্পূর্ণরুপে নাজায়িয ও হারাম প্রমানিত হয়।
কারণ একঃ- যেহেতু এখানে নির্দিষ্ট টাকার বিনিময়ে নির্ধারিত পণ্য কেনার সাথে সাথেই ডিলারশীপের চুক্তিটিও (আকদ) হয়ে যায়-যার জন্য আগে বা পরে পৃথক আকদ বা চুক্তি করতে হয় না। সুতরাং শরীয়তের পরিভাষা অনুযায়ী, এখানে (صَفقَتَانِ فِى صَفقََةٍ) এক আকদের মধ্যে দুই আকদের সন্নিবেশন পাওয়া যাচ্ছে। অথচ হাদীস শরীফে এটা স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাযিআল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেনঃ- نَهٰي رَسُولُ اللّٰهِ صَلَّي اللَّهُ عَلَيهِ وسَلَّمَ عَن صَفقَتَانِ فِى صَفَقَةٍ ))
‘রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এক লেনদেনর মধ্যে দুই লেনদেন একত্রিত করতে নিষেধ করেছেন।(দেখুন-হাদীসে তিরমিযী শরিফ, ২য় খণ্ড, ২৩৩ পৃষ্ঠা)
কারণ দুইঃ- আরেক বিশ্লেষণে দেখা যায় এখানে ক্রেতার সাথে ডিলারশীপও শর্ত করা হয়েছে। আর শরীয়তের দৃষ্টিতে লেনদেনর ক্ষেত্রে এ ধরনের শর্ত আরোপ করা সম্পূর্ন নাজাযিয়, হারাম।
এ সম্বন্ধে আমর বিন শু‘আইব তার পিতা এবং তিনি তার দাদা (রাযিআল্লাহু আনহু) সূত্রে রিওয়ায়াত করেছেন, তিনি বলেনঃ- (نَهٰي رَسُولُ اللّٰهِ صَلَّي اللَّهُ عَلَيهِ وسَلَّمَ عَن بَيعٍ وَ شَرطٍ)
‘রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) শর্তের সাথে বেচা-কেনাকে নিষিদ্ধ করেছেন।’ (দেখুন- কিতাব তাবরানী, মাজমাউল বাহরাইন, ৩য় খণ্ড, ২৬৭ পৃষ্ঠা)
বস্তুতঃ এ জাতীয় শর্ত দ্বারা আকদ সম্পূর্ণ ফাসিদ বা বাতিল হয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে হিদায়া কিতাবে বলা হয়েছে- ( كُلُّ شَرطٍ لاَّ يَقتفِيهِ العَقدُ وَ فِيهِ مَنفَعَةٌ ِّلاَ حَدِ الّعَاقِدَينِ اَو لِلمَعقُودِعَلَيهِ يُفسِدُ)
এমন সব শর্ত যাকে আকদ তাকাজা করে না আর এর মধ্যে ক্রেতা-বিক্রেতার কোনএকজনের অথবা আকদকৃতের কোনরূপ লাভ রয়েছে-এ শর্ত বেচাকেনাকে বাতিল করে দেয়।” (দলীলঃ হিদায়া, ৩য় খণ্ড, বাই’য়ে ফাসিদ অধ্যায়, ৫৯ পৃষ্ঠা)
কারণ তিনঃ- এ ধরনের লেনদেন প্রকারান্তরে সূদী কারবারের অন্তর্ভূক্ত। কেননা, এখানে বেচাকেনার স্বাভাবিক লেনদেনের পাশাপাশি অতিরিক্ত এমন কিছু লাভ পাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে, যে লাভ বিনিময়হীন। আর এ ধরনের বিনিময়হীন অতিরিক্ত লাভ শরীয়তের বিধান মতে সূদের অন্তর্ভূক্ত।
কারণ চাঁরঃ- উক্ত বিজনেস পদ্ধতিতে ক্রেতা নির্দিষ্ট অংকের দ্রব্য ক্রয় করার মাধ্যমে কোম্পানীর সদস্যপদ লাভ করে এবং পয়েন্ট চক্রের অধিকারী হয়। অতঃপর সে যাকে ক্রেতা-সদস্য বানাবে, তার থেকেও নির্ধারিত হারে সে পয়েন্টের অধিকারী হবে এবং এমনিভাবে এই দ্বিতীয় ব্যক্তি যাকে ক্রেতা সদস্য বানাবে, তার থেকেও নির্ধারিত হারে সে নিজে পয়েন্ট পাবে, আবার প্রথম ব্যক্তিও তার দ্বারা পয়েন্ট লাভ করবে। এরপর এ ৩য় ব্যক্তি যাকে ক্রেতা-সদস্য বানাবে, এর পয়েন্ট ৩য় ব্যক্তি নিজে যেমন পাবে, তেমনি নির্ধারিত হারে সেই প্রথম ও দ্বিতীয় ব্যক্তিও এর দ্বারা বিনা প্রয়াসে নির্ধারিত পয়েন্ট লাভ করবে। এভাবেই পর্যায়ক্রমে এ পয়েন্টচক্র চলতে থাকবে লভিষ্ট গন্তব্যের দিকে। অথচ এক্ষেত্রে ২য়, ৩য়, ৪র্থ বা এর পরের কোন ক্রেতা-সদস্যের লেনদেনে ১ম ব্যক্তির কোনরূপ প্রত্যক্ষ ভূমিকা বা দায়-দায়িত্বের বালাই নেই। তথাপি সে তাদের দ্বারা নির্ধারিত পয়েন্ট লাভ করে লাভবান হচ্ছে-যা প্রকারান্তরে ‘দায়হীন লাভ’ হিসেবে গণ্য। তেমনিভাবে ২য় সদস্য ৩য় ও ৪র্থ সদস্যের দ্বারা, ৩য় সদস্য ৪র্থ সদস্যের দ্বারা এবং এমনিকরে সকল উপরস্থ সদস্য নিম্নস্থ সদস্যগণ দ্বারা সেরূপ দায়বিহীন লাভের অধিকারী হয়ে থাকে। ইসলামিক দৃষ্টিতে এ ধরনের দায়বিহীন লাভ গ্রহণ করা হারাম। হে মুসলিম ভাই আপনি একটু চিন্তা করুন, সে সব কোম্পানীগুলো আপনাকে যে টাকা দিচ্ছে, সে টাকা আপনার কোন এক ভাই যিনি আপনার নিম্ন স্তরের সদস্য, হতে পারে পঞ্চাশ জন, একশ জন তাদের পকেট থেকে নিয়ে আপনাকে কিছু দিচ্ছে, বাকি কোম্পানী বক্ষণ করছে। সম্পূর্ণ সূদী ব্যবসার মত। দনিরা এক হাজার টাকা ঋণ দেয় গরিবদেরকে, এক হাজার একশ টাকার বিনিময়ে। এতে দনিরা আরো দনবান হচ্ছে, গরিবদের টাকা শোসন করে। তেমনি আপনি কিছু লোক ভূলিয়ে ভালিয়ে পয়েন্ট চক্রের জালে ফাশিয়ে দিলেন, তারপর সে লোকগুলি আরো অনেককে পয়েন্ট চক্রের জালে ফাশাতে লাগল, তারপরের লোকগুলি আরো অনেককে..... এভাবে চলতে থাকল। লাভবান হচ্ছে সে লোকগুলো যারা প্রথমে শুরু করেছে। অথচ তারা বিনা পরিশ্রমে লাভবান হচ্ছে। যা আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা হারাম করেছে। আবু হুরাইরা (রাযিআল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইরশাদ করেনঃ- ( لاَ يَحِلُّ رِبحُ مَا لَم يَضمَن)
সে সবের লাভ হালাল হবে না, যার দায় সে বহন করে না। (আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসায়ী)
সুতরাং নেটওয়ার্ক বিজনেসে উল্লিখিত নিষিদ্ধতার কারণসমূহ বিদ্যমান থাকায় উক্ত ব্যবসা কোনক্রমেই জায়িয হবে না। বরং তা সম্পূর্ন নাজায়িয ও হারাম। তাই সকলের এ থেকে দূরে থাকা কর্তব্য। আর কেউ এতে জড়িত হয়ে থাকলে, তা ত্যাগ করা ওয়াজিব। কেননা আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা মানুষকে আদেশ করেছেনঃ-
(مُّسْلِمُونَ وَأَنْتُمْ إِلاَّ تَمُوتُنَّ وَلاَ تُقَاتِهِ حَقَّ اللَّهَ اتَّقُواْ آمَنُواْ الَّذِينَ يأَيُّهَا)
হে ইমানদার বিশ্বাসীগণ! আল্লাহকে ভয় কর যেমনভাবে তাকে ভয় করা উচিত। তোমরা প্রকৃত মুসলিম না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না। (আল-কোরআন, সূরা-ইমরান, আয়াত-১০২)
গবেষণা পরিষদ, আল-হিদায়াত ফাউন্ডেশন
ঢাকা,