সাহিত্যের বিশেষ ধারা ‘জাদু বাস্তবতা’ জনপ্রিয়তার জনক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ বিংশ শতাব্দীর অন্যতম মর্যাদাবান লেখক যিনি একাধারে একজন উপন্যাসিক, ছোট গল্পকার, চিত্রনাট্যকার এবং সাংবাদিক ছিলেন। তাঁর লেখায় উঠে আসা ল্যাটিন আমেরিকা, বিপ্লব, নিঃসঙ্গতা আর জাদু বাস্তবতার প্রাণবন্ত চিত্র তাকে এনে দিয়েছে সমালোচকদের উল্লেখযোগ্য প্রশংসা এবং ব্যাপক বাণিজ্যিক সফলতা।
নো ওয়ান রাইটস টু দ্য কর্নেল উপন্যাসিকাটি প্রথমপ্রকাশিত হয় ১৯৬১ সালে যার মূল স্প্যানিশ টাইটেল ছিল ‘Elcoronel no tiene quién le escriba’ যেটি জে এস বার্নস্টাইন ‘নো ওয়ান রাইটস টু দ্যকর্নেল’ নামে ১৯৬৮ সালে ইংরেজীতে অনুবাদ করেন। বাংলায় বইটির একাধিক অনুবাদক থাকলেও মানবেন্দ্র বন্দোপাধ্যায় এবং অশোক দাশগুপ্তের অনুবাদ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। উপন্যাসিকাটির কাহিনী নিয়ে ১৯৯৯ সালে স্প্যানিশভাষায় ‘নো ওয়ান রাইটস টু দ্য কর্নেল’ (স্প্যানিশঃ El coronel no tiene quien le escriba) নামে একটি সিনেমাও তৈরি করা হয়।
উপন্যাসিকাটির কেন্দ্রীয় চরিত্রে দারিদ্রে জর্জরিত একজন বৃদ্ধ যোদ্ধা, যার নাম গল্পে উল্লেখ করা হয়নি, যিনি হাজার দিন যুদ্ধে কাটানো একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল এবং রাজনৈতিক নিপীড়নে যিনি তাঁর ছেলেকে হারিয়েছেন। যুদ্ধের বিষাদক্লিষ্ট এই কর্নেল দীর্ঘ পনেরো বছর ধরে অপেক্ষা করেছেন তাঁর পেনশনের টাকা পাবার আশায়। মূলত তাঁর মাধ্যমে ঐ সময়ের একজন কলম্বিয়ান নাগরিকের জীবনাভূতি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এই উপন্যাসিকাটিতে। গল্পটির ঘটনাপ্রবাহ শুরু হয় বৃদ্ধ কর্ণেলের তাঁর শহরে দীর্ঘদিন পর স্বাভাবিকভাবে মারা যাওয়া একজন সঙ্গীতজ্ঞের শেষকৃত্যে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে। এটা দ্বারা বোঝা যায় জীবন কতটা দুর্বিষহ ছিল তখন- স্বাভাবিক মৃত্যুও যেখানে বিরল। ল্যাটিন আমেরিকায় ‘গ্যাবো’ নামে পরিচিত মার্কেজ এই উপন্যাসিকাটির পটভূমি হিসেবে ব্যবহার করেছেন কলম্বিয়ার গৃহযুদ্ধের (যা লা ভায়োলেন্সিয়া নামে পরিচিত) দিনগুলিকে যখন সেনা শাসনের অধীনে সমাজের সর্বত্র নানা ধরণের সেন্সরশিপ আরোপ করা হয়ছিল। এই গৃহযুদ্ধটি ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। এতে আনুমানিক দুই লক্ষ মানুষ প্রাণ হারায়। কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না উপন্যাসিকাটি মার্কেজের সচারচার জাদু বাস্তবতার উপাদানে লেখা না হলেও এটাকে ঐন্দ্রজালিক গল্প বলা যেতে পারে যেখানে ফুটে উঠেছে ইতিহাস আশ্রিত ঘটনাপ্রবাহের সাথে নিঃসঙ্গতার মনস্তাত্ত্বিক আবহ।
গল্পের কাহিনী এগিয়ে চলে রাজনৈতিক নিপীড়নে ছেলে হারানো বৃদ্ধ কর্নেল, তাঁর হাঁপানি আক্রান্ত স্ত্রী এবং তাদের দারিদ্রক্লিষ্ট জীবনের নানা ঘটনা নিয়ে। কর্নেল পনেরো বছর ধরে অপেক্ষায় আছেন প্রতিশ্র“ত পেনশন পাবার আশায়। প্রতি শুক্রবারই তিনি লঞ্চঘাটে এসে দাঁড়িয়ে থাকেন পেনশনের চিঠির অপেক্ষায়। একদিকে স্বামী-স্ত্রীর কোনোরকম বেঁচে থাকার অদম্য চেষ্টা আর অন্যদিকে সদ্যপ্রয়াত ছেলের রেখে যাওয়া মোরগটিকে লালন-পালন করা- উপন্যাসিকাটিতে এই দুইয়ের বাইরে সমাজের অর্থনৈতিক দুর্দশা, স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে কর্মকর্তাদের দূর্নীতি এবং তাঁর ফলাফল স্থান পেয়েছে সমান গুরুত্বসহকারে। সদ্যপ্রয়াত ছেলের রেখে যাওয়া মোরগটিকে তিনি সযতেœ লালনপালন করছেন মোরগ লড়াইয়ের যুদ্ধে অংশগ্রহন করানোর জন্য। নিজে অভুক্ত থাকেন শুধুমাত্র মোরগটিকে এক বেলা খাওয়ানোর জন্য। দারিদ্রের কষাঘাতে ধিরে ধিরে তাঁরা তাদের সবকিছু বেঁচে দিতে দিতে একপর্যায়ে তাদের মৃত ছেলের স্মৃতিবিজড়িত মোরগটিকেও বেঁচে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন। কিন্তু মোরগ যুদ্ধের মহড়ায় মোরগটির জেতার সংগ্রাম কর্নেলকে নতুন করে জীবন সংগ্রামে উদ্দীপ্ত করে। তিনি সিদ্ধান্ত নেন, যে করেই হোক মোরগটিকে লালনপালন করাবেন মোরগ লড়াইয়ের রিঙে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত।
বহুমাত্রিক টানাপোড়েনের মধ্যে অতিবাহিত জীবনের করুন চিত্র লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন ব্যক্তি কর্ণেলের নিঃসঙ্গতা, একাকীত্ব এবং বেঁচে থাকার লড়াইয়ের মাধ্যমে। গল্পের শুরুতেই দারিদ্রতার সজীব চিত্র ফুটে ওঠে যখন লেখক বলেন,
‘...একটা চাকুর সরু মাথা দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে কফির সর্বশেষ দানাটা পর্যন্ত কেতলির পানিতে মেশালেন। কফি টিনের কিছু মরচের গুড়াও হয়তো তাতে মিশে গেল।’
এতো অভাব অনটনের মাঝেও কর্নেল তাঁর রোগাক্রান্ত স্ত্রীকে ভালবেসেছেন, পাশে থকেছেন, সাহায্য করেছেন উদায়স্তভাবে-
(স্ত্রী) জিজ্ঞেস করলেনঃ
‘তোমার মগ কোথায়?’
‘আমি আগেই খেয়েছি। তখনো বড় চামচের এক চামচ ছিল।’ কর্নেল মিথ্যা উত্তর দিলেন। দারিদ্রের মাঝে বিষফোঁড়া ছিল তাদের সদ্যপ্রয়াত পুত্রশোক। প্রায় এক বছর হতে চলেছে তাদের পুত্রকে তাঁরা হারিয়েছে। অথচ,যতই দিন যাচ্ছে যেন মনে হচ্ছে তাঁরা আরো বেদনা ও হতাশার মধ্যে নিমজ্জিত হচ্ছে। দারিদ্র এবং পুত্রশোক তাদের চিন্তাচেতনাকে এমনভাবে গিলে ফেলেছিল যেন তাঁরা মৃত্যুর খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছে বলে মনে করত। যুদ্ধফেরত কর্ণেলের দীর্ঘ বছরের কাজ ছিল কেবলমাত্র তাঁর প্রতিশ্র“ত পেনশনের অপেক্ষা করা। জীবন যুদ্ধে ক্লান্ত কর্নেল হতাশার সাগরে ভেসে বেড়াতে থাকেন প্রতিনিয়ত। জীবনযুদ্ধে লড়েছেন মর্যাদার সঙ্গে, একপেট আগুন নিয়ে! যুদ্ধফেরত এই সৈনিক অপেক্ষায় আছেন সরকারের পক্ষ থেকে তার প্রাপ্য পেনশনের চিঠিটার জন্য। চিঠির জন্য অপেক্ষা কিন্তু কেউ কর্নেলকে লেখে না! এ এক অনিশ্চিত অপেক্ষা! তাঁর হাহাকার করা কথাগুলো এমন-
‘আমার সব সহযোদ্ধারাই চিঠির জন্য অপেক্ষা করতে করতে মারা গেছে।’
মাঝে মাঝে অদৃষ্ট বাস্তবতা এসে তাঁর হতাশার প্রলাপ থামিয়ে দিতে হাজির হয় আরো নির্মমভাবে, যখন কর্নেলের স্বপ্নের দরজা চুরমার করে পোস্টমাস্টার বলেন, ‘কর্নেল, নিশ্চিত করে মানুষের জীবনে যা আসে তাঁর নাম মৃত্যু।’
এতকিছুর পরও তাঁরা তাদের মর্যাদা কখনও হারাতে দেননি, কর্ণেলের স্ত্রীর ভাষায়-
‘...আমরা অনেকদিন চুলোয় হাড়ি উঠাইনি। এটা প্রতিবেশীরা যাতে বুঝতে না পারে সেজন্য কতদিন আমি পাথর কুড়িয়ে হাঁড়িতে সিদ্ধ করেছি..’
গল্পে দেখা যায়, কিভাবে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা আর দুর্নীতির দরুন তাঁর প্রতিশ্র“ত পেনশন আটকে থাকে বছরের পর বছর ধরে। কর্ণেলের উকিলের উক্তিতে পাওয়া যায় রাষ্ট্র কাঠামোর করুন অবস্থার চিত্র-
‘...সে দলিল এতদিনে অসংখ্য হাত ঘুরে যুদ্ধমন্ত্রনালয়ের কোন বিভাগে পৌঁছেছে তা শুধু ঈশ্বরই বলতে পারবেন।’
অনিয়ম দূর্নীতির সাথে ছিল সামন্ততন্ত্র। অযোগ্য- দুষ্ট প্রকৃতির লোকের হাতে ছিল অগাদ স¤পদ। শাবাস চরিত্রের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে সুবিধাবাদী গোষ্ঠির চিত্র যে একদিন এই শহরে গলায় সাপ জড়িয়ে ঔষধ বিক্রি করতে এসেছিল আর সে-ই এখন নানা কারসাজিতে শহরের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধনীতে পরিণত হয়েছে। এই শাবাসের ফাঁদে পরে কর্নেল যক্ষের ধনের মত আগলে রাখা মোরগটিকে বেচতে বসেছিলেন পেটের দায় মেটাতে। কিন্তু না, শেষ পর্যন্ত তিনি দৃঢ় সংকল্প নিয়ে পুত্রের স্বপ্নকে সাথে নিয়ে বাঁচতে চাইলেন। লেখকের ভাষায়-
‘এ মুহূর্তটায় পৌঁছাতে কর্ণেলের পঁচাত্তর বছর লাগলো। জীবনের প্রতিটা মুহূর্তের দায় কড়ায়গণ্ডায় চুকিয়ে দিয়ে এ অবস্থায় নিজেকে তিনি আবিষ্কার করলেন। নি®পাপ, স্বাভাবিক এবং অপরাজেয় একজন মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করলেন নিজেকে।’
মার্কেজ তাঁর আত্মজীবনী গ্রন্থ লিবিং টু দ্য টেল-এ এই উপন্যাসিকাটি সম্পর্কে বলেন, এটি তিনি তাঁর দাদার জীবনী থেকে উৎসাহিত হয়ে লিখেছেন যিনি নিজেও একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল ছিলেন এবং তিনি দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেও তাঁর পেনশন পাননি। তবে এটাও ধারণা করা হয় যে মার্কেজ যখন ১৯৫৮ সালে সংবাদপত্র বন্ধ করে দেয়ার কারনে সাংবাদিকতার চাকরী হারিয়েছিলেন তা থেকেও হয়ত তিনি এই উপন্যাসিকাটির অনুপ্রেরণা পেয়ে থাকতে পারেন। সেই সময়ের জীবনযাত্রা যা তিনি দেখেছিলেন সেটাও তাঁর এই উপন্যাসিকাটি লেখার অনুপ্রেরণা হতে পারে। ফ্রান্সে থাকাকালীন অবস্থায় লেখা এই উপন্যাসিকাটি তাঁর অন্যতম সেরা সৃষ্টিকর্ম।
তথ্যসূত্রঃ লিবিং টু দ্য টেল, উইকিপিডিয়া, দ্য গার্ডিয়ান।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জুন, ২০১৪ রাত ১১:৩৯