রেল যাত্রী বনাম রেলগাড়ির সাথে জুড়ে দেয়া খাবার গাড়ির লোকেদের দ্বন্দ্বের সুমহান ঐতিহ্য টি বোধ করি রেল গাড়ি প্রচলনের জন্মলগ্ন থেকেই।যাত্রীকূলের স্থির বিশ্বাস, রেলের ক্যান্টিনের লিজ নেয় তারাই যারা দুর্ভাগ্য বশতঃ ছুরি চাকুর অপ্রতুল সরবরাহের কারনে ডাকাতিকে পেশা হিশেবে নিতে পারেনি।ডাকাতির পৈশাচিক আনন্দটি তাই পুষিয়ে নেয় গলাকাটা দাম হেঁকে।
অপর পক্ষে লিজ নেয়া পার্টির বক্তব্য-নিত্যি নিত্যি তো সস্তায় খাও,আর খানিক পর নেমে যাও,বাড়িতে যেয়ে বিশ্রাম করো আমরা অতো কষ্ট করে সারাদিন গাড়িতে থাকি, এখানেই খাই দাই বিশ্রাম নেই,অতটুকু কষ্টের দাম দিতে অতো আপত্তি কিসের?কিছু ক্যান্টিন ওয়ালা যে দ্বন্দ্ব কমনোর উদ্যোগ নেয়নি এ কথা বললে ভুল হবে।একদা এমনই এক ক্যান্টিন ওয়ালা ক্যান্টিনের প্রবেশ মুখে মুল্য তালিকা টাঙ্গিয়ে দিয়েছে , যেন খটোমটো কমে।আমার এক বন্ধু ঐ তালিকা দেখে দুই পিস পাউরুটি অর্ডার করলো ।প্রতি পিস তিন টাকা।বিল দিতে যেয়ে দেখে বিল হয়েছে ১৮ টাকা। মেজাজ সামলে বাড়তি দামের কারন জানতে চাইলে,বয়ের নির্লিপ্ত জবাব ,”ওতে বাটার দেয়া ছিল। লিস্টি দেখেন, মাখন রুটি প্রতি পিস ৯ টাকা”
খালি পেট বলেই হয়তো আর সব মহৎ চিন্তার বদলে খাবার কথাই ভাবছি।পারাবত ট্রেন এত ভোরে ছাড়ে যে ,শুন্য উদরে উঠতে হলো।ক্লাস শুরু হয়েছে গত সপ্তায়।তাই বন্ধু সব আগেই চলে গেছে।তাই এ দফায় বন্ধু বিবর্জিত একলা ভ্রমন।নি:সংগতা এড়াতে সিলেট পর্যন্ত ভ্রমনের রসদ হিশেবে,”বেনহার(সেবা অনুবাদ) আর thomas hurdy এর “pair of blue eyes(penguin)” নিয়ে নিয়েছি।এমনিতে বেনহার পড়ব, আর সুন্দরি সহযাত্রী পরলে pair of blue eyes-ইংরেজি ক্লাসিক পড়া যুবক যদি কোন সুন্দরির হৃদয়ে মুগ্ধতার জন্ম দেয়!আমার বেনহার পড়তে হচ্ছে।
“সিলেটে লেখা পড়া করো?” সামনের মহিলা সহযাত্রীর স্নেহ মাখা প্রশ্নটাতে সম্বিত ফিরল। মাথা উপর নিচ করে বিনয়াবত হয়ে জানালাম “জ্বি”।
সামনের অতি মিশুক হাসিখুশি নব দম্পতি আর পাশে বসা ভদ্রলোকের ভাগ্নের সাথে পরিচয় হতে সময় লাগলো না।ভদ্রলোক সাইক্রিয়াটিস্ট,ভদ্রমহিলা সাইকলজিস্ট।উনারা দুজনেই আমাকে দেখে আমার আচরণ বিশ্লেষণ করে একের পর এক চমক দিতে লাগল। আর ভাগ্নে ক্লাস এইট সেকেন্ড ইয়ার-মানে ফেল করে ২য়বারের মতো ৮ এ। মহিলার হাতে মেহেদি দেখে নব বিবাহিত দম্পতি টা বুঝতে শারলক হওয়া লাগে না। সাথে আনা খাবার সাধল,আমি বিনয়ের সাথে অভুক্ত পেট নিয়ে প্রত্যাখ্যান করলাম- পাছে ছুঁচো বেড়াল ভেবে বসে!
অতি ভোরে জাগরন আর রেলের ছন্দের কারণে চারজনই তন্দ্রায় আর ঘুমের মাঝামাঝিতে। প্যাসেজে হেটে হেটে বলতে থাকা ক্যান্টিন বয়ের“অয়া নাস্তা আসে কাটলেট দিমুনি” ডাকে ঘুম ভাংল।সামেনের আরাফাত দম্পতি আর ভাগ্নের ঘুম সহসা ভাংবে বলে মনে হচ্ছে না।এমনিতে উনাদের নাস্তার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছি।এ ঘুমের সুযোগে নাস্তার কাজটা সেরে নেই, নাহলে কষ্ট পাবেন উনারা।পকেটে মাস চলার ৩০০০ টাকা। দাম বেশী রাখে ,তাই বলে তো আর ৩০০০ টাকা রাখবে না!আমি এর আগে(এবং পরেও) কখন কাটলেট খাইনি,ওপার বাংলার নভেল, সিনেমা, কবিতায় কেবল নাম ই শুনেছি।বহুবার প্লান এটেছি ,কিন্তু খাবার সৌভাগ্য হয়নি। বই থেকে মুখ তুলে ছেলেটাকে বললাম”কাটলেট ”।
ছেলেটা কি বুঝলো জানিনা। খানিক পর একটা প্লেটে এক জোড়া, ব্লাড ব্যাঙ্ক“সন্ধানির” লোগোর রক্তের ফোটার ডিজাইনের ইঞ্চি পাঁচেক সাইজের কালচে বাদামি রঙের একজোড়া চাক্তি হাজির করলো।ছেলেটার সাথে আলাপ চলাকালে ক্ষণিকের উৎসাহে একপর্যায়ে ও দুটোকে কাটলেট বলে জানালো।আমার চোখে তখন অজানাকে জানার নেশা! অতশত না ভেবে দ্রুততার সাথে খেয়ে নিলাম।খাবার পর সম্রাট সাজাহানের কথা মনে হল।ভদ্রলোকের তাজমহলের নন্দন দেখারও সৌভাগ্য হয়েছে সেই সাথে তাজমহলের খর্চা যোগাতে মাত্রারিক্ত করের বোঝার কারনে ভারতজুড়ে দূরভিক্ষও দেখতে হয়েছে। আমার অবস্থাও তদ্বৎ। কাটলেটের প্রতি মমতা প্রকাশের সাস্তি হিশেবে খামকা পিত্তিতাকে চটকালাম। কৌতূহল মেটাতে বিস্বাদ চিত্ত বিষাদ করা এক বস্তু আস্বাদন করতে হচ্ছে।
খাবার হজম করতে যে কানের প্রয়োজন হয় এ প্রথম জানলাম।পাহাড়ি এলাকায় ভ্রমনে যেমনটা হয়- উচ্চতার কারণে কানে খিল এটে যায়। সব শুনতে পাবেন,তবু বন্ধ বন্ধ অনুভূতি।পরে শ্বাস বন্ধ করে ঢোক গিললেই ঠিক হয়ে যায়।আমিও বার কয়েক ঢোক গিললাম, কান খুলছে না। ট্রেনের সবার মুখ কেমন যেন ছোট হয়ে আসছে। আর চারিপাশের বিচ্ছিন্ন শব্দ গুলো যেন অনেক দুর থেকে ভেসে আসছে ।শ্বাস নিচ্ছি, আর আমার মনে হচ্ছে ৬টা গোলাপি শুঁড়ের হাতি জিম্নাস্টদের মতো উপর থেকে আমার বুকে লাফিয়ে পরে স্প্রিংয়ের মত খানিক দূরে গিয়ে পরছে।
কাটলেট অর্ডার করা অন্যান্য যাত্রিদের হজম শক্তির একরাশ শ্রদ্ধা জন্মালো । আমি নিশ্চিত আমি মারা যাচ্ছি।পরদিন পেপারের হেডিং দেখতে পাচ্ছি,"কাটলেট হজম করতে যেয়ে একজনের রহস্যজনক মৃত্যু "
বার বার মনে হতে লাগলো ,আহা ভাই বোন দের সাথে কি না খারাপ ব্যবহার করি!আহা ,বাবা মার সাথে তর্ক করে কি না অন্যায় করেছি! পাড়ার বেয়াদপ দোকানদারের প্রতি আরও দয়ালু হওয়া উচিৎ ছিল !
অতো শত বিষয়ের মাঝে আমাকে পাত্তা না দেয়া সুন্দরিদের কথা ভেবে আনন্দ লাগলো -পস্ট দেখতে পাচ্ছি ওদের আফসোস মাখানো কান্না-যেন বলছে ইস কি ভাল ছেলেটা চলে গেল, যাকে মনে মনে ভালবাসতাম।ওদের প্রতি করুণা দেখানো ছাড়া আমার আর কোন কর্তব্য নেই।
এভাবে কত সময় গিয়েছে মনে নেই।খানিক বাদে ছোকরাটা বিল নিতে এল। বিল দিয়ে আরেক দফা উদাস হয়ে গেলাম।৬টাকার খাবারের ৬০টাকা দামশুনে গান্ধি ,মেন্ডেলাও বোধকরি অহিংস নীতি বিসর্জন দিতেন জানালার দিয়ে সুদুরে তাকিয়ে আছি কিছুই যেন দেখছি না।
ইতিমধ্যে আরাফাত দম্পতি ঘুম থেকে উঠেছে। আমার এ হেন বিপর্যস্ত চেহারা দেখে ভাইয়া নিশ্চিত করলো আমায় ছেড়ে চলে যাওয়া বান্ধবির কথা মনে করার কারনে আমার এ দশা,তবে আশার কথা যেহেতু উনি মনরোগ স্পেসালিস্ট,তাই উনার বিশ্বাস সঠিক কাউন্সিল আমাকে ভাল করে তুলতে পারে।
আর ভাবির ধারণা(বিশ্বাস) কিছুদিন আগে আমার গার্লফ্রেন্ড মারা গেছে তার কথা ভেবে ভিরমি খেয়েছি ওরকম কিছু একটা। উনার যুক্তি, আমি নাকি আমার অজান্তে শক্ত করে মুঠি এটে রেখেছি-গভীর ভাবে ছাপ ফেলা ঘটনার কথা মনে করলে মানুষ এরকম করে। আমি যতই বলি যে আমার কোন বান্ধবি নেই উনারা ততই অভিমান করে বলেন,যে তুমি এখনও আমাদের আপন ভাবতে পারনি। এ বলে ভাবি ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে আয়না বের করে দিলেন।আয়নায় দেখি স্টার প্লাসের সিরিয়াল মিস করা মহিলাদের মতো উদভ্রান্ত লাগছে নিজেকে।
উনাদের আমন্ত্রন না রেখে কাটলেট খেয়ে এ দশা একথা তো বলা যায়না!
আরাফাত দম্পতির সাথে এখনও মাঝে মাঝে কথা হয়। প্রথম পরিচয় প্রসঙ্গ উঠলে দীর্ঘ ১৫ বছর পরও উনারা “তুমি সত্য গোপন করেছ” বলে এক বুক অভিমান নিয়ে খোটা দেন”
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জানুয়ারি, ২০১৪ সকাল ৯:৩৪