বারাসাত থেকে শিয়ালদহ স্টেশনে পোস্টিং হবার পর স্টেশন মাস্টার গফুর সাহেব দেখলেন দাংগার ভয়াবহ রূপ।বারাসাতে থাকতেই শুনেছেন কলকাতার অবস্হা শোচনীয়।বিবি বাচ্চা সব ব্রাহ্মণবাড়ীয়াতে বাড়ীতে,নিয়ে আসতে সাহস করেন নি।পরিস্হিতি ভালো হলে নিয়ে আসবেন।এ নিয়ে বেশ অস্বস্হিতে আছেন।ঠিক এরকম অস্বস্হিতে আছেন আরেকজন-গফুর সাহেব থেকে হাজার মাইল দুরে নোয়াখালীতে-মাহাত্মা গান্ধী।নোয়াখালীতে দাংগা শুনে প্রায় ছুটে চলে এসেছেন। এসে শুনেন উনার জন্মস্হান গুজরাটে দাংগা!অহিংস বাণি যদি ঘরের মানুষ না বোঝে তাহলে কি লাভ হলো এ মতের!তাঁর উপর আপদ হিশেবে জুটেছে মানুষ জনের দেয়া ভিআইপি মর্যাদা।কলকাতার পরিস্হিতি আপাতত ঠান্ডা।চাঁদপুর গোয়ালন্দি স্টিমারে থার্ডক্লাস কেবিনে কোলকাতা ফিরছেন।কোলকাতা থেকে গুজরাট আরেক পথে।কাপ্তান বাপুজি কে বিলক্ষন চিনেন।আই ভুলেও ফার্স্ট ক্লাসে সাধাসাধি করে বিব্রত করেন নি ।খালাশি লস্করদের সাথে আড্ডা মেরে খারাপ সময়টুকু ভুলে থাকছেন।আর মাহাত্মা লোকটাও কিরকম যেনো।দেখলে গর গর করে মনের সব কথা বেড়িয়ে আসে।গাণ্ধির মনও উচাটন, কখন গুজরাটে পৌছুবেন।চেলা রা সব বাপুজীকে একলা থাকতে দিচ্ছেন,উনারা জানেন এসময় কারো সংগ চাননা।১৯৪৬-সায়েন্সের শতাব্দি,আর মানবজাতি এতসব বুঝে দুদুটা বিশ্বযুদ্ধ আর রায়ট করে- এ ভেবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন।স্বামীর চিন্তায় হাজেরা খাতুন-গফুর সাহেবের বিবিও চিন্তায় উচাটন হয়ে আছে।
"নুরু মিয়া,আমারে কলিকাতাত নিয়া যাইতে পারবা?ফরিদের বাপে কিরকম আছে আল্লায় জানে"
নুরু মিয়া গফুর সাহেবের ইমেডিয়েট ছোট ভাই,ফরিদ,বড় ছেলে নাইনে পড়. রেজিস্ট্রেশন বারাসাতে হওয়ায় এক কলিগের বাসায় জায়গীর হিশেবে আছে।
নুরু মিয়া ধরে আনতে বল্লে বেধে আনা টাইপ মানুষ।
"বাউস তুমি ভাইবনা তো,আমি নিয়া জামু তুমারে"
ঘটনাক্রমে আমরা দেখবো নুরু মিয়া, হাজেরা বিবি,সাতবছর বয়েসি ছেলে আযীয,আর আঠারো মাসের ফৌজিয়া-কোলকাতা পর্যন্ত গান্ধীজির সহযাত্রী হতে যাচ্ছেন।আর এ ফাঁকে নুরু মিয়ার কিছু কাহিনী শুনে নিই।
নুরু মিয়ার স্বভাবে গোয়ার আর রক্তে বিপ্লবী।কমরেড মোজাফ্ফর আহমেদ যখন ফেরার হন তখন নুরু মিয়ার অতিথি ছিলেন।৪৩ দূর্ভিক্ষের সময় শষ্য ভর্তি ট্রেন চট্রগ্রাম থেকে ঢাকায় যাবার পথে গংগাসাগর স্টেশনের কিছুদুর আগে ডাকাতি হয়েছিল উনার নেতৃত্বে।বাপুজীর চরম বিরোধি।নুরু মিয়ার কাছে অহিংস আন্দোলনে স্বরাজ লাভ আর চিরুনী দিয়ে খেত নিরানো একই কথা।
আসুন আবার গোয়ালন্দি স্টিমারে ফিরে যাওয়া যাক।
ফৌজিয়ার ফিডারের দুধ গরম করতে হবে।হাজেরার আবার সী সীকনেস।কি আর করা,নুরু মিয়া ফৈজিয়া আর আযীযকে নিয়ে কেন্টিন পানে। এ ফাঁকে দুপুরের খাবারটাও সেরে নেয়া যাবে,লোকে বলে গোয়ালন্দি স্টিমারের কেন্টিনের ইলিশ নাকি বেহেস্তের খাবারের মেনুতেও থাকবে।
কেন্টিনের বেন্চটাতে চশমা পরা জরাজীর্ন বৃদ্ধ ঘুমিয়ে আছে।বিদেশি মনে হয়।
"হোয়াই আর ইউ স্লীপিং হেয়ার?"
নুরু মিয়ার গমগমে কন্ঠে ধমকে উঠলেন
বৃদ্ধ ধরমরিয়ে উঠে বসলেন।
স্মিত হাসি দিয়ে যুবকের কাছে ক্ষমা চাইলেন।যুবকের কোল থেকে ফৌজিয়া কে টেনে নিয়ে খানিকক্ষন আদর করলেন ,আযীযের মাথার চুল গুলো এলমেলো করে দিয়ে জানতে চাইলেন
"কউন সি ক্লাস মে পড়তি হু?"
উনি বুঝে গেছেন এ পরিবার টা বাংগাল।
আর যুবককে প্রাণ ভরে আশীর্বাদ করলেন।
এহেন ভালো ব্যবহার পেয়ে বার বার মাপ চাইতে লাগলো।
নুরু মিয়া জানতো না ইনিই গান্ধীজি।পরে ক্যাপ্টান মারফতে জেনেছেন।
কে ভেবেছিলো বাপুজি কে এহেন অবস্হায় পাওয়া যাবে।
স্বরাজ লাভ না হতে পারে কিন্তু মানুষের মন জয় করতে অহিংশ নীতির বিকল্প পেলনা নুরু মিয়া।আযীয হচ্ছেন আমার বাবা।ফৌজিয়া আমার বড় ফুপু,ফরিদ আমার বড়চাচা ৭১ এর শহীদ। নুরু মিয়া আমার নানা।
এটা একান্তই পারিবারিক গল্প ।গফুর হলেন আমার দাদা