বাংলাদেশের গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ধরণ- ১লা সেপ্টেম্বর ২০১৫ এর আগে ২ চুলার গ্যাসের দাম ছিল ৪৫০, ১লা সেপ্টেম্বর ২০১৫ থেকে তা বাড়িয়ে ৬৫০ টাকা করা হয় যা আবার বাড়িয়ে ১০০০ টাকা করা হচ্ছে, বৃদ্ধির হার ১২২,২২%। এই সময়ে ১ চূলা গ্যাস ৪০০ টাকা থেকে বেড়ে ৮৫০ টাকা হবে, দাম বাড়ার হার ১১২,৫০%।
অন্যান্য গ্যাস খাতের মধ্যে- আবাসিক গ্রাহকদের মধ্যে যাঁরা মিটার ব্যবহার করেন, তাঁদের ক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার ৬০ দশমিক ৬৮ শতাংশ। আবাসিক খাতের পরেই গ্যাসের সবচেয়ে বেশি দাম বাড়বে ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ (বেসরকারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানে ব্যবহারের জন্য মালিকদের নিজস্ব উৎপাদিত) উৎপাদনে। বৃদ্ধির হার ১০২,৯৪%। সিএনজি খাতে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির হার ৩৯,১০%। সিএনজির দাম বাড়বে ৩৩%। চা-বাগানে ব্যবহৃত গ্যাসের বৃদ্ধির হার ২০,৫৫%। বিদ্যুৎ উৎপাদনে যে গ্যাস দেওয়া হয় তার বৃদ্ধির হার ৫,২৪%। শিল্পে বৃদ্ধির হার ৩২,৬০%। বাণিজ্যিক গ্রাহকদের ক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার ৩০,৫৫%। সার উৎপাদনে বৃদ্ধির হার ৯,৭১%।
আন্তর্জাতিক এনার্জি খাতে দামের পরিস্থিতি- বিশ্ববাজারের গ্যাসের ওয়েলহেড দাম প্রতি ঘনফুট ৩,৫ ডলার। গত ৫ বছরে প্রতি ঘনফুট গ্যাসের গড় দাম ৩,৫ ডলারের কিছু নিচে ছিল। বাংলাদেশে গ্যাসের উৎপাদনকারী দেশ এবং আমাদের গ্যাসের দাম তুলনামূলক কম। বলা হয়ে থাকে ৬৫০ টাকার যে দাম তা বিশ্ব আন্তর্জাতিক দামের অর্ধেকের কাছাকাছি।
গত ৫ বছরে প্রতি ঘনফুট গ্যাসের গড় দাম ৩,৫ ডলারের কাছাকাছি ছিল।
তবে এখানে কিছু বড় বড় ফাঁক ফোঁকর ও দুর্নীতির ব্যাপার রয়েছে।
১। ডিস্ট্রিবিউশন এন্ডে চুলাপ্রতি মাসিক ৯২ ইউনিট গ্যাস খরচ দেখিয়ে বিল নেয়া হয় ৬৫০ টাকা। অথচ খরচ হয় ৪২-৪৫ ইউনিট, এই অভিযোগ নিস্পত্তির উদ্যোগ না নেয়ার দুর্বিত্তায়িত কারণ দৃশ্যমান।
২। বেসরকারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানে (মূলত গার্মেন্টস সেক্টর) ব্যবহারের জন্য মালিকদের নিজস্ব উৎপাদিত ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ এর গ্যাস জেনারেটর গুলোতে যে গ্যাস পাইপলাইনের যে সংযোগ রয়েছে তার প্রায় শত ভাগ গ্যাস ভিত্তিক বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট গ্যাস চুরি এবং মিটার টেম্পারিং এর সাথে জড়িত। দুর্নীতির পরিসর চলমান রাখতে ইন্ডাস্ট্রিয়াল লাইন গুলোকে প্রিপেইড করার বিবেচনা কখনই আমলে নেয়া হয় নি।
৩।উপরুন্তু বিদ্যুৎ এবং সার উতপাদনে ব্যবহৃত পুরানো এবং নিন্ম ইফেসিয়েন্সির গ্যাস জেনারেটরে প্রায় ৭৫% গ্যাস লস হচ্ছে। অর্থত অতি অধিক পরিমান গ্যাস পুড়ে সামান্য বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে মেশিনারির অতি নিন্ম ইফেসিয়েন্সির কারনে।
৪।অদক্ষ ও নিম্নমানের যন্ত্রপাতির কারনে দৈনিক সরবরাহ করা গ্যাসের ১৬ শতাংশ অপচয় হচ্ছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) প্রণীত ‘এনার্জি সিকিউরিটি’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। সম্প্রতি এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন জ্বালানি সম্পদ বিভাগে জমা দেয় এডিবি। এতে বলা হয়, সারা দেশে প্রতিদিন গড়ে গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে দুই হাজার ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট। এর মধ্যে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট অপচয় হচ্ছে। এক্ষেত্রে বিদ্যুৎকেন্দ্র, সার কারখানা ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানে অপচয়ের হার বেশি। এছাড়া আবাসিকেও প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ গ্যাসের অপচয় হচ্ছে। অপচয় বন্ধ করা গেলে এ গ্যাস দ্বারা তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে।
৫। পেট্রোবাংলার বিরুদ্ধে আইওসির গ্যাস ক্রয়ে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। দুদকের অনুসন্ধান ও তদন্ত কমিটির ২৮.১.২০১৫ তারিখের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ব্যয় উসুল, কম্প্রেসর স্থাপন ও পরিচালনা, গ্যাসের দাম পরিশোধে ডিসকাউন্ট সুবিধা না নেয়া এবং যন্ত্রপাতি আমদানি— এসব ব্যাপারে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে পেট্রোবাংলা অভিযুক্ত। প্রতিবেদনে আইএমইডির সূত্রে তিতাস গ্যাস সঞ্চালন ও বিতরণ কোম্পানির বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে এবং বলা হয়েছে, ত্রুটিপূর্ণ মিটার ও মিটার টেম্পারিং, গ্যাস অপচয় এবং অবৈধ সংযোগের কারণে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। গণশুনানিতে অভিযোগ করা হয়েছে, চুলাপ্রতি মাসিক ৯২ ইউনিট গ্যাস খরচ দেখিয়ে বিল নেয়া হয় ৬৫০ টাকা। অথচ খরচ হয় ৪২-৪৫ ইউনিট। এ অভিযোগ নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেই। চুলায় গ্যাস নিরবচ্ছিন্নভাবে না পাওয়া এবং পেলেও কাঙ্ক্ষিত চাপে না পাওয়ায় ভোগান্তি ও বিপর্যয়ে মধ্যে আছে নগরবাসী। গ্যাসের অপ্রতুল সরবরাহ ও স্বল্প চাপ শিল্প খাতকে চরম সংকটে রেখেছে। ফলে শিল্প খাত জ্বালানি সংকট ও উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির শিকার। এ অবস্থার প্রতিকার ছাড়াই শিল্পেও গ্যাসের দাম বৃদ্ধি হচ্ছে।
অর্থাৎ অদক্ষতা, মেয়াদ উত্তীর্ণ নিন্ম ইফেসিয়েন্সির বিদেশী গ্যাস জেনারেটরের বোঝা এবং সংশ্লিষ্টদের সর্বগ্রাসী দুর্নীতিকে (মিটার টেম্পারিং এবং ঘুষ) স্পেইস দিতে সবধরনের গ্যাস ডিপেন্ডেন্ট সেক্টরে গ্যাসের মূল্য প্রায় দ্বিগুন করার কথা বলা হচ্ছে, অথচ কমার্সিয়াল সেক্টরের গ্যাস চুরি, প্রি পেইড মিটারিং, সঞ্চালন এবং উৎপাদন ইফেসিয়েন্সি আনার কোন আলোচনা নেই।
গ্যাস উৎপাদনকারী দেশগুলো নিজস্ব ব্যবহারের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক দামের চেয়ে অনেক কম দামে গ্যাসের প্রাইসিং করে থাকে। এই প্রাইসিং এর কয়েকটি মডেল রয়েছে যার প্রধান ফোকাস হচ্ছে গ্যাসের দাম তেলের দামের সাথে সামঞ্জস্য রেখে করা যাতে গ্যাস অতিমাত্রায় প্রাইমারি ফুয়েল হিসেবে আবির্ভুত হয়ে জ্বালানি নিরাপত্তায় সংকট বয়ে না আনে।
বাংলাদেশ তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে সমন্বয় করে ফ্লটিং করছে না-
১। তেল খাতকে সরকার তার রাজস্ব আয়ের খাত হিসেবে বেছে নিয়েছে (এখন গ্যাসকেও রাজস্ব খাতে আনতে চায়!)।
২। তেলের পুরো বাজারে বিপিসি’র মনোপলি আছে এতে দুর্নিতিও কমছে না। বিপিসি’দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থাপনার মনোপলি তেলের আমদানি, সঞ্চালন এবং ডিস্ট্রিবিউশনে খরচ বেশি দেখিয়ে অবারিত চুরি এবং দুর্নিতির সুযোগ করে দিয়েছে এতে সরকারের যা রাজস্ব আসা উচিত ছিল তা অনেক কম আসছে, অন্যদিকে শুল্ক ছাড়াই তেলের দামও বেশি পড়ছে। ২০১৬ তে আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যারেল প্রতি যখন অপরিশোধিত তেল ৩৫ ডলার ছিল, তখন বিপিসি তা ৬৭ ডলার করে কিনেছে।
৩। তেলের দাম বেশি হবার কারনে সরকারি বিদ্যুতের দাম বেশি, বেসরকারি কোম্পানিরা গ্যাস ভিত্তিক ক্যাপ্টিভ জেনারেশনকে প্রাধান্য দিয়েছে, অন্যদিকে তারা গ্যাস চুরিও করতে পারছে, আবার সেসব গ্যাস জেনারেটর এর মেশিনারি শুল্ক মুক্ত, নিন্ম মানের ইফেসিয়েন্সির গ্যাস জেনারেটরে দেশ ভরে গেসে, ফলে বেশি গ্যাস পুড়িয়ে কম বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী, প্রতি টন ইউরিয়া সার উৎপাদনে গ্যাসের প্রয়োজন হয় ২৫ হাজার ঘনফুট। অথচ বাংলাদেশে একই পরিমাণ সার উৎপাদনে গ্যাস ব্যবহার হচ্ছে গড়ে ৪৪ হাজার ঘনফুট। অদক্ষতায় ৭৬% বেশি গ্যাস ব্যবহার হচ্ছে
৪। তেলের দাম বেশি হবার কারনে সিএঞ্জির উপর চাপ পড়েছে।
৫। বিদ্যুতের ইন্ডাস্ট্রিয়াল সরবারোহ নিয়মিত না হবার কারনে এবং গ্যস চুরির সুযোগ থাকায় বেসরকারি খাতে নিজস্ব গ্যাস জেনারটের (অতি নিন্ম ইফেসিয়েন্সির) প্রভাব বেশি।
পেট্রল এবং অকটেনের দাম কমানো উচিত। এতে সিএনজির ওপর থেকে চাপ কমবে এবং গাড়ির মালিকরা তেলেই গাড়ি চালাবে। বিপিসির মনোপলি ভেঙে ফার্নেস অয়েলের মার্কেট স্বচ্চ মনিটরিং এর মধ্যমে বেসরকারি খাতে ওপেন করে দিলে দাম অর্ধেকে নামতে বাধ্য, এতে বিদ্যুতের দাম ব্যাপক কমবে, গ্যাসের উপর চাপ কমে আসবে। পুরো শিল্প উৎপাদনে বেগ আসবে এবং পণ্য থেক সরকারের ভ্যাট আসবে। সামগ্রিক ভাবে জনগণের ওপর থেকে চাপ কমে আসবে।
উল্লেখ্য, ২৪/৭ নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবারোহের নিশ্চয়তা দিলে বেসরকারি ক্যাপ্টিভ খাতে কেন ছোট ছোট (সার্ভিস মেয়াদ উত্তীর্ণ পুরানো বিদেশী জেনারেটর যা খুবই নিন্ম ইফেসিয়েন্সির) গ্যাস জেনারেটর লাগবে, এই ফয়সালা দরকার। সরকার বিদ্যুতের জন্য প্রি পেইড কমার্শিয়াল বিতরনের অবকাঠামো নিয়ে সমীক্ষা করেছে কি? ১২০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতার বিপরীতে মাত্র ৮০০০ মেগাওয়াট বিতরণ সক্ষমতা কেন? গত এক দশকে উৎপাদন ৩ থেকে ৩.৫ গুণ করা হলেও সঞ্চালন এবং বিতরণ অবকাঠামো কেন মাত্র ২০% বাড়িয়ে উৎপাদন সক্ষম প্ল্যান্ট বসিয়ে রেখে (কুইক রেন্টালের প্ল্যান্টে) এখনো ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে? এই সমন্বয়হীন পরিকল্পনার উত্তরণ কিভাবে হবে, বিদ্যুতের সঞ্চালন এবং বিতরণকে ইন্ডাস্ট্রিয়াল মডেলে রূপান্তর করে বেসরকারি গ্যাস প্ল্যান্ট নিরুৎসাহিত করার পরিকল্পনা আর কত দেরিতে হবে?
অর্থাৎ আমাদেরকে গ্যাসকে প্রায় একমাত্র প্রাইমারি জ্বালানির হিসেবে সরানোর পথে যে অন্তরায় গুলো আছে তা সরাতে হবে, গ্যাসের অপচয় নির্ভর আন-ইফেশিয়েন্ট ব্যবহারের যে দুঃখজনক মডেল তা সংস্কার করতে হবে। গ্যাস এবং বিদ্যুতের জন্য পৃথক কমার্শিয়াল ডিস্ট্রিবিউশন লাইন করতে হবে এবং কমার্শিয়াল লাইন প্রিপেইড করতে হবে। বর্তমান সঞ্চালন লাইনকেই রি-ডিজাইন করে এবং এতে কমার্শিয়াল এলাকা-ইপিজেড-এবং বড় বড় ইন্ডিস্ট্রিয়াল প্ল্যান্ট গুলো কালেক্টেড রেখে এই কমার্শিয়াল সঞ্চালন তৈরি করা যায়।এসব না করে শুধু বাছবিচারহীন গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি সরকারের সাময়িক আয় বৃদ্ধি ছাড়া কার্যত কোন টেকসই সমাধান দিবে না।
বাংলাদেশে গ্যাসের সম্পদ মূল্য শূন্য? বলা হয়ে থাকে আমাদের গ্যাসের দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে নিজস্ব গ্যাসের সম্পদ মূল্য শূন্য ধরে নির্ধারণ করছি। উদাহরণ স্বরূপ রান্নার গ্যাসে বর্তমানে ২ চুলার বিপরীতে যে ৬৫০ টাকা নেয়া হচ্ছে এটা কিসের দাম? প্লেইন এনালাইসে দেখা যাচ্ছে শুধু সঞ্চালন, বিতরণ এবং ব্যবস্থাপনা খরচ? কেন এই খরচ এত বেশি হবে?
বর্তমানে বাংলাদেশ ও ভারতে সিলিন্ডারপ্রতি এলপিজির নির্ধারিত মূল্য ও তার বিভাজনের একটি তুলনামূলক পর্যালোচনা
৪০ কিলোমিটারের মধ্যে বাংলাদেশে ভোক্তাপর্যায়ে এলপিজির সিলিন্ডারপ্রতি নির্ধারিত মূল্য ৭০০ টাকা। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের বাজারে প্রতি সিলিন্ডারে এলপিজি পাওয়া যায় ১২ কেজি। ভারতে ১৪,২ কেজি। ফলে ভারতের এলপিজি সিলিন্ডারের মূল্যহারকে বাংলাদেশের সমতুল্য মূল্যহারে পরিবর্তন করার ক্ষেত্রে এলপিজির পরিমাণ ধরা হয়েছে ১২ কেজি।
ভারতে এলপিজি ভ্যাট মুক্ত। অর্থাত্ ভারত এলপিজি খাতকে রাজস্বের উত্স হিসেবে গণ্য করে না। বাংলাদেশী মুদ্রায় ভারতের বাজারে বিপণনকৃত প্রতি সিলিন্ডার এলপিজির মূল্য ৪৮৩ দশমিক ৫০ টাকা। এ মূল্য নির্ধারণে ১২ কেজি এলপিজির এক্স-রিফাইনারি মূল্য ধরা হয়েছে। অন্যান্য ব্যয়ের হিসাব ১২ কেজি ধরা হলে সিলিন্ডারপ্রতি এলপিজির মূল্য ৪৮৩ দশমিক ৫০ টাকার চেয়ে কম হতো।
ক্যাব আবেদনে বলেছে, ‘এলপিজি’র বাজার এখন অসাধু ব্যবসাকবলিত। এ বাজার রাষ্ট্র বা বাজার কেউই নিয়ন্ত্রণ করে না, নিয়ন্ত্রিত হয় ব্যবসায়ীদের দ্বারা। ভোক্তাস্বার্থ ও জ্বালানি নিরাপত্তা রক্ষার্থে এলপিজির দাম ৭০০ থেকে কমিয়ে ৪৫০ টাকা পুনর্নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে।। সে প্রস্তাবমতে, ‘এলপিজির দাম পুনর্নির্ধারণের মাধ্যমে বাজার বিইআরসির নিয়ন্ত্রণাধীন এনে এলপিজিকে অসাধু ব্যবসামুক্ত করা ভোক্তা অধিকার সুরক্ষায় জরুরি।’
কিভাবে আন্তর্জাতিক পরিসরে গ্রাহক পর্যায়ে কিভাবে দাম নির্ধারিত হয়? উদাহরণ- নেদারল্যান্ডস। ৩৫.৬% সম্পদ মূল্য/উতপাদন খরচ, ১৮.৮% উতপাদন-সঞ্চালন-নেটোয়ার্ক ম্যেনেজমেন্ট কষ্ট এবং বাকি ৪৫,৬% ট্যাক্স এবং ভ্যাট।
সমুদয় গ্যাস বিক্রির অর্থ থেকে সরকার শুল্ক-ভ্যাট পায় ৫৫ শতাংশ। আবার গ্যাসের সম্পদমূল্য ধরে দাম বাড়ানোর অর্থ থেকেও শুল্ক-ভ্যাট পায় ৫৫ শতাংশ। দাম বৃদ্ধিজনিত অর্থ থেকে সরকার পাবে ৮১,১ শতাংশ (শুল্ক-ভ্যাট ৫৫%, লভ্যাংশ ২%, করপোরেট কর ৩%, সম্পদমূল্য মার্জিন ১৫,৯৬% এবং জিডিএফ মার্জিন ৫,১৮%)। বাদবাকি ১৯,৯% থেকে যাবে আইওসি গ্যাস ক্রয় মার্জিন ৩% বৃদ্ধিতে (বিদ্যমান ১৪ শতাংশ)। মাত্র ৫% যেতে পারে উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণ কোম্পানিগুলোর মার্জিন বৃদ্ধিতে। উদ্বৃত্তাংশ সম্পদমূল্য মার্জিনে সমন্বয় হয়ে সম্পদমূল্য হিসেবে থেকে যাবে সরকারেরই হাতে। প্রস্তাবিত দাম বৃদ্ধিজনিত অর্থের এমন বিভাজন গণশুনানিতে অনৈতিক ও অন্যায্য বলে অভিহিত হয়েছে।
ভ্যাট, লভ্যাংশ, কর, সম্পদ মূল্য এবং অন্যান্য মার্জিন নির্ভর গ্যাস এর দাম নির্ধারনের এই বাংলাদেশী মডেল বড়ই অদ্ভুত, আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক বিবেচনায় এটা বড়ই অন্যায্য, এ থেকে বুঝা যাচ্ছে সরকার এনার্জি খাত থেকে আয় বাড়ানোর জন্য যাবতীয় শিল্প বিকাশ এবং উৎপাদন বিরোধী আয়োজন (পড়ুন এনার্কি) করে রেখেছে।
গ্যাসের প্রাইসিং মডেল উৎপাদনকারী এবং আমদানীকারি দেশে ভিন্ন। বাংলাদেশ উৎপাদনকারী মডেল থেকে আমদানীকারি মডেলে ঢুকতে চাচ্ছে, এতে কোন সমস্যা দেখছি না, এটা দরকারও! তবে শিল্পের মেরুদণ্ড এনার্জি খাত থেকেই সরকারের রাজস্ব তোলার ভয়ঙ্কর অদুরদর্শী পরিকল্পনা, তেলের বাজার ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি, গ্যাসকে একমাত্র প্রাইমারি জ্বালানীতে আটকে রাখার ব্যবস্থাপনা এবং এল পি জি গ্যাসের আসাধু ব্যাবসায়ী চক্রের মাফিয়া গিরি আড়ালে রেখে এই রূপান্তর প্রক্রিয়া শুরু করলে তার সুফল সরকার এবং নাগরিক কেউই পাবে না। এতে দেশি বিদেশি আসাধু ব্যবসায়ীরাই শুধু লাভবান হবে। সরকারের সাময়িক রাজস্ব স্ফীতির আড়ালে লুকিয়ে আছে ভয়ঙ্কর জ্বালানী বিপর্জয়ের দায়!
দেশে এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত ২৬টি গ্যাসক্ষেত্রে গ্যাসের মজুত নিরূপণ করা হয় ২৭,১২ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। এর মধ্যে ১৩ দশমিক ৬৩ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসই ব্যবহার হয়ে গেছে। অবশিষ্ট আছে ১৩,৪৯ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। গত কয়েক বছরে দেশে নতুন গ্যাসক্ষেত্রের সন্ধান মেলেনি, নতুন উৎপাদনও শুরু হয়নি। মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা-সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির পর সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল তবে এখন পর্যন্ত তা কাজে লাগানো যায়নি পছন্দের কোম্পানিকে কাজ পাইয়ে দিবার অস্বচ্চতায়। গ্যাসের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে তাই পুরনো ক্ষেত্র থেকেই উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা চলছে যা গ্যাস ক্ষেত্র গুলকে অকার্জকর করে তুলবে বলে ধারনা করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত যে গ্যাসক্ষেত্রগুলো আবিষ্কৃত হয়েছে, তার মধ্যে ২৪টিই স্থলভাগে। বাকি দুটি অফশোরে। বর্তমানে উৎপাদনে আছে ২০টি গ্যাসক্ষেত্র, যার সবই স্থলভাগে। অফশোরে গ্যাস উত্তোলনে আমাদের ব্যর্থতা নিদারুণ।
নাগরিক কম্ফোর্টের দিক থেকে সাপ্লাই গ্যাস ভালো হলেও অত্যধিক ঘনবসতি পূর্ণ ঢাকা এবং চট্রগ্রামের মত শহরে শিরা উপশিরার মত বিস্তৃত ভূগর্ভস্ত গ্যাস লাইন ভূমিকম্প, ভূমি ও ভবন ধ্বস এবং ভূগর্ভস্ত বিদ্যুৎ সঞ্চালনের অনুকূল নয়। অন্যদিকে রান্নায় সিলিন্ডার এর ডিস্ট্রিবিউশন ভয়ঙ্কর জ্যামের নাগরীতে ট্রাফিক বাড়াবে। তাই এই দুয়ের মধ্যে একটা ট্রেড অফ থাকা চাই। মিটার হীন চূলার পদ্ধতিও টেকসই নয়, এই পদ্ধতি রেখে দাম বাড়ালে তা আদলে গ্যাসের অপচয়কেই উৎসাহিত করবে।
ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন (ইপিজেড, এস ইপিজেড, বিসিক, বেসরকারি শিল্প পার্কে) এবং বিশেষ করে সার ও সিমেন্ট কারখানার জন্য শুধু মাত্র প্রিপেইড ফ্যাসিলিটি সম্পন্ন কমার্শিয়াল গ্যাস পাইপ লাইন ডিজাইন করা যায় কিনা সেটা ভাবতে হবে। কেননা আন্তর্জাতিক দামে এল্পিজি কিনে এনে তা পুনঃ প্রসেস করে বর্তমানের গ্যাস লাইনে সরবারোহ করলে সেটা চুরিতে এবং সিস্টেম লসে যাবে, জ্বালানী ব্যবস্থাপনার ইফেসিয়েন্সি এবং দামের দিক থেকে এটা টেকসই নয়।
বাংলাদেশ এখনো পর্যন্ত কোন আন্তর্জাতিক গ্যাস পাইপ লাইনে যুক্ত হবার কৌশলী পরিকল্পনা নেয়নি। ভারতকে জল, স্থল এবং আকাশে বিভিন্ন সড়ক-রেল-নৌ-টেলি এবং ইন্টারনেট (এমনকি সমুদ্র বন্দরও) ট্রানজিট দিয়ে দিলেও তার বিপরীতে সীমান্তের পাশ দিয়ে যাওয়া ভারত-মিয়ানমার গ্যাস পাইপ লাইনে যুক্ত হবার কোন দুরদর্শী পরিকল্পনাই নেয়নি।
অন্যদিকে তেলের দাম পতন এবং এল এন জি বাজার সহনীয় থাকার সময়ে এল এন জি টার্মিনাল না থাকা, পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নে গড়িমসি ধীরগতির কারনে শক্তিশালী উৎপাদনকারী দেশের সাথে বৃহৎ চুক্তিতেও যেতে পারছে না। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারের কম দামের সুবিধা অবকাঠামোর অভাবে নিতে পারছে না। বন্দর এবং এল এন জি টার্মিনাল সুবিধা এবং ইন্ডাস্ট্রি সহায়ক সঞ্চালন এবং মিটারিং মডেল তৈরিতে আরো ৫-৭ বছর কালক্ষেপণ হয়ে গেলে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক বাজারের এল এন জি ভিত্তিক গ্যাস জ্বালানীর সুবিধা একেবারেই নিতে পারবে না। কেননা এই সময়ে বিশ্বের দেশ সুমূহের উপর কয়লা ভিত্তিক প্ল্যান্ট থেকে সরে আসার পরিবেশবাদী চাপ বাড়বে, উন্নত দেশ সমূহ নিজেরাই কয়লা থেকে সরে এসে বিকল্প নন নিউক্লিয়ার জ্বালানীর জন্য এমনিতেই টাইট কূটনৈতিক তৎপরতা আরো বাড়াবে এবং বিশুদ্ধতম ফসিল ফুয়েল সিকিউর করতে বদ্ধ পরিকর হবে। এখানে বাংলাদেশের মত দুর্বল জ্বালিনী কূটনীতির দেশগুলো ব্যাপক ভাবে পিছিয়ে পড়বে। সেক্ষেত্রে বিকল্প প্রাইমারি জ্বালানির সন্ধান বাংলাদেশের জন্য খুবই কস্টার্জিত (আর্থিক এবং পরিবেশ বিবেচনায়) হয়ে উঠবে। তাই সময়ে ফুরিয়ে যাবার আগেই বোধোদয় হওয়া দরকার বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের!
এনার্জি পরিকল্পনায় সঠিক বোধ আসুক সংশ্লিষ্টদের,
বাংলাদেশের জ্বালানী নিরাপত্তা নিঃশঙ্ক হোক!
বাংলাদেশ এগিয়ে যাক!
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ২০১৬ রাত ১:৫৩