মনেই খেলছে ছোট্ট এক শিশু। বয়স এক বছর। নাম আলো। সরকারের বানানো ওই ফুটপাত শুধু যেন আলোর খেলার জন্যই বানানো হয়েছে। পথচলতি লোকজন, আশপাশের দোকানপাট—সবাই আলোর বন্ধু। নরম পায়ে হামাগুড়ি দিয়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় চলে যায়, আবার ঘুরে ঘুরে ফিরে আসে মায়ের কাছে।
আলোর মা রওশন (১৭) মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছে তার ছোট্ট মেয়েটির দুরন্তপনা। হোটেল থেকে কিনে আনা ভাত-ডাল নিয়ে আলোকে খাওয়াতে বসেছে রওশন।
আলোর বাবা কই?
‘ওর বাপ এইহানে থাহেনা। আমি আছি। আমার মায় আছে। আর কী চাই।’
চলে কেমনে?
‘শাহবাগেই কাজ-কাম করি।’
কী ধরনের কাজ?
‘দোকান ঝাড়পোঁছ কইরা দেই। কারোরটা মুইছা দেই। হেরা টেকা দেয়, চইলা যায়। মায় ভিক্ষা করে, তয় মাথা খারাপ।’
আপনার মায়ের মাথা খারাপ কেন? কী হয়েছে?
‘মাইজে মাইজে হ্যারে জিনে ধরে। অন্য সময় ভালাই থাকে। ভিক্ষা করে। বেশ পায়।’
ঢাকায় কবে থেকে আছেন?
‘১৫-১৬ বছর হইব। বাবায় মারে আর আমারে ফালায় চইলা গেছল। তহনই মায় আমারে নিয়া এইহানে আইসা পড়ছে।’
আলোর বাবার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে কবে?
‘দুই-তিন বছর আগে। কিন্তু লোক ভালা না, তাই মার লগে থাকি।’
আলোর জন্মনিবন্ধন করেছেন?
‘জন্মনিবন্ধন। সেইটা কী?’
হলো একধরনের সার্টিফিকেট। এটি থাকলে পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন ধরনের সরকারি-বেসরকারি সুবিজন্মনিবন্ধন ধা পাওয়া যায়।
‘হ, এই রহম একটা সাটিফিটের কথা শুনছিলাম, কিন্তু কোথায় যাওন লাগব, হেইডা কেউই কইতে পারে না। আপনে জানেন? ওই সাটিফিট থাকলে কী হয় আফা? কয় টেকা লাগব? আমার আলোরে সাটিফিট দিব?’—উতলা মায়ের অপার কৌতূহল।
নিজে থেকেই জানাল রওশন, এই সনদ নেই তার ও তার মায়ের। বিভিন্ন লোকের মুখে শুনেছে, কোনো একটি ‘সরকারি সনদ’ থাকলে তার মা পাবনার গ্রামে বৃদ্ধ ভাতা পেতে পারতেন। রওশনকে বুঝিয়ে দিই, তার ছেলেকে কোথাও ভর্তি বা ছেলে বড় হলে কোনো ধরনের লাইসেন্স, বিশেষ করে গাড়ি চালানোর জন্য লাইসেন্স, এমনকি বিয়ে করতে হলেও এই সনদের প্রয়োজন রয়েছে।
নিজের নামে জন্মনিবন্ধন সনদ তৈরির ক্ষেত্রেও আগ্রহী হয়ে ওঠে রওশন। ‘আফা, আমারে এট্টা সাটিফিট দেওন যাইব?’
কেন নয়। আপনি ফুলবাড়িয়ায় নগর ভবন চেনেন?
‘হ।’
তা হলে সেখানে গিয়ে আপনাদের দুজনের নামে দুটি জন্মনিবন্ধন ফরম পূরণ করাবেন। তা হলে আপনার ও আলো দুজনের নামেই সনদ হয়ে যাবে। আর এটি করতে কাউকেই কোনো টাকা দিতে হবে না। তবে আপনাদের দুজনের দুটি করে পাসপোর্ট সাইজের ছবি সঙ্গে করে নিয়ে যেতে হবে।
‘আফা, আমাগোরে ফটো তুইলা দিবেন? ওইটাই নিয়া যামু।’
আচ্ছা, তুলে দেওয়া যাবে।
আলোকে নিয়ে আপনার আশা কী? বড় হলে ওকে কী বানাতে চান?
‘আমি তো পড়তে পারি নাই। ইচ্ছা আছে ওরে পড়ামু। আমার মতো কম বয়সে বিয়া করতে দিমু না। আফা, আপনার ওই সাটিফিট পাইলে আলোরে স্কুলে ভর্তি করাবার পারুম?’
অবশ্যই ভর্তি করবে।
‘আফা, আমারে সত্যই সাটিফিট দিব! কুনু অফিসে ঝাড়পোঁছের কাম পাইলেও চলব, আমারে এট্টা চাকরি দিবেন। তাইলে আমি আলোরে পড়াইতে পারুম।’
রওশন মোটামুটি চেপেই ধরল এই প্রতিবেদককে, এখনই সঙ্গে করে নিয়ে যেতে হবে তাদের ফুলবাড়িয়ার সিটি করপোরেশন অফিসে।
কাজের ব্যস্ততার কারণে তাদের সেদিন আর নিয়ে যাওয়া হয়নি। তবে পরে কোনো একদিন জন্মনিবন্ধন করানোর জন্য তাদের সিটি করপোরেশন কার্যালয়ে নিয়ে যাব, এই প্রতিশ্রুতি দিতেই হলো।