মেহেরজান যুদ্ধ ও ভালবাসার ছবি। মানুষ ভালবাসার দাবি ছাড়তে পারে না। মেহেরের ভালবাসা কেন বাঙালি মুক্তিযোদ্ধা পাবে না? বাঙালি নারীর ভালবাসা চিরতরে সর্বাবস্থায় বাঙালি পুরুষই পাবে। কড়া জাতীয়তাবাদী পুরুষ ইগো এর ব্যতিক্রমকে অজাচার (ইনসেস্ট) ভাবে। তাই এটা ভালবাসার স্বত্বের মামলা। বাঙালির স্বাধীনতা যুদ্ধকে ব্যাখ্যার অধিকারও সর্ববাঙালির হতে পারে না। তা নির্দিষ্ট শ্রেণীর, বর্গের, ভাবধারার ও ক্ষমতার হাতেই থাকবে। তাই এটা যুদ্ধেরও মামলা। এই মামলায় আসামি মেহেরের প্রেম এবং জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের ভেতরে নানাজান নামক চরিত্রের নিজস্ব যুদ্ধ।
এই মামলায় প্রধান অভিযোগ: মেহেরজানের যুদ্ধ কি একাত্তরের যুদ্ধ? মেহেরের প্রেম কি দেশপ্রেমের চাইতেও বড়? এবং প্রেম স্বয়ং কি রাজনীতি ও জীবন-মরণের চাইতে বড়? দুটো উত্তরই বড় ‘না’ হয়ে দেখা দিয়েছে অনেকের মনে। এই মামলা জটিল এবং এর ইতিহাস সুপ্রাচীন। আসলে এই প্রশ্ন হয়তো ‘আমি কে, কী আমার পরিচয়’ এই প্রশ্নের মতোই পুরনো। তাহলেও বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয়ের পেণ্ডুলাম যখন থেকে ডানে-বামে প্রবল দুলতে থাকলো সেই প্রথম বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় থেকেই এই প্রশ্ন এই ভূখণ্ডের মধ্যবিত্ত সমাজকে ভোগাচ্ছে, সময়ে সময়ে তার প্রভাব উপচে নিম্নবর্গের রাজনৈতিক চেতনার ওপরও পড়েছে। মেহেরজান ছবির কাঁধে তাই দায়িত্ব পড়েছে, কেবল মুক্তিযুদ্ধই নয়, আত্মপরিচয়ের এই ধন্দের গ্রহণযোগ্য নির্মাণ দেখানো। এর ফয়সালা না হলে, এই ফাঁড়া না পেরুলে সকলই গরলই ভেল হয়ে যাবে। এবং মনে হবে, কীসের লাগিয়া এ ছবি বানানু। বাকি সব প্রশ্ন, বাকি সব চরিত্র ও ঘটনা এর নিরিখেই নির্ণিত হবে।
কিন্তু কার যুদ্ধ, কার ভালবাসা? কোন ময়দানে এর ফয়সালা হবে? বর্তমান রাজনীতির ময়দানে? নাকি ইতিহাসের মহাফেজখানায়? মেহেরজান ছবি থেকে কী প্রমাণ করার দায়িত্ব আমাদের? যা আমরা আগে থেকেই বিশ্বাস ও বন্দনা করি, এ থেকে তারই নিশ্চয়তা চাইছি কি? মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সব গল্প-কবিতা-চলচ্চিত্র-বর্ণনা-বক্তব্য কি সরকারি লাইন অনুযায়ীই হবে? এ বিষয়ক যাবতীয় ভাবনা-চিন্তা-শিল্পের বাঁধা ছক মজুদ আছে কোথাও? সবার দায়িত্বই হচ্ছে সেই ছককে পাহারা দিয়ে যাওয়া এবং কেবল তারই মনোছবি কপি করে সৃজনশীলতার মেহনত বাঁচানো?
ডান-বাম নির্বিশেষে তাই যেন এ ছবি নিয়ে এক ধরনের সাংস্কৃতিক গৃহযুদ্ধ দেখা যাচ্ছে। নিষিদ্ধ করার দাবি উঠছে, ওঠাচ্ছেন তাঁরাই যাদের আবার বাংলাদেশের ‘মুক্তবুদ্ধির’ জেহাদি গণ্য করা হয়। ওদিকে সিনেমা হলে পাবলিক টাকা দিয়ে টিকিট কিনে ছবি দেখে পয়সা উসুল মনে বাড়ি যাচ্ছে, কথা বলছে। ব্লগ-ফেসবুকের নারায়ে তকবির তাদের কাছে পৌছাচ্ছে না। সেটা পৌঁছে দিতেই প্রথম আলো বিজ্ঞাপন দিয়ে বিতর্ক আয়োজন করে তাদেরও টেনে আনছে। একটা কিছু হচ্ছে।
যুদ্ধ রাজনৈতিক না অরাজনৈতিক?
বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত সমাজে ও তাদের রাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধ সর্বদাই রাজনীতি রঞ্জিত একটি বিষয়। কিন্তু তাদের তৈরি সাহিত্য ও চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধ নিতান্তই এক অরাজনৈতিক ঘটনার বেশি কিছু নয় সাধারণত। আখ থেকে রস বের করে নেওয়ার মতো মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক শাঁসটি বের করে নিয়ে ১৯৭১-কে কেবল যুদ্ধ, ধ্বংস, গণহত্যা ও নির্যাতনের অভিজ্ঞতা হিসেবে দেখাই মোটামুটি মুখস্থ ঝোঁক। এই অভিজ্ঞতার বাঁকে বাঁকে ‘জয় বাংলা’ বলে তাকবীর দিলেই মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক মর্মটা প্রকাশ হয় না। অথচ জাতীয় মুক্তির রাজনৈতিক সংকল্প ছাড়া, প্রতিরোধী জাতীয়তাবাদের আদর্শিক উপাদানসিক্ত হওয়া ছাড়া মুক্তিযুদ্ধকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব?
এই প্রেক্ষিতে মেহেরজান রাজনৈতিক ছবি হিসেবে নির্মিত হয়েছে। এবং তার প্রতিক্রিয়াটাও রাজনৈতিক। এ বিতর্ক কেবল ছবিটাকেই উন্মোচিত করছে না, সাংস্কৃতিক এলিট বৃত্তের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ছাঁচটাও চেনাচ্ছে। ছবিটা তৈরি করা, এর কাহিনীর ধারা এবং বিতর্কের উত্থাপকদের অভেদ এখানেই যে, সকলেই মোটামুটি এলিট গোষ্ঠীর মধ্যে পড়ে। বাকিরা এদেরই বিভিন্ন পক্ষে কাতারে কাতারে মোতায়েন হয়ে যাচ্ছে। আমি এখানে তৃতীয় একটি দৃষ্টিকোণ, তৃতীয় একটি পক্ষ হাজির করার চেষ্টা করবো, যা মুক্তিযুদ্ধের অমীমাংসিত কিছু এলাকায় প্রবেশ করবে এবং দেখাতে চাইবে জাতি ও জন-এর মধ্যকার ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক সংযোগটি কীভাবে উচ্চবর্গীয় জাতীয়তাবাদে আড়াল হয় এবং কীভাবে মেহেরজানও শেষ পর্যন্ত তা দেখাতে ব্যর্থ হয়।
এখানে বলা দরকার, স্বাধীনতাযুদ্ধের আত্মদান, সংগ্রাম ও ধ্বংসের অভিজ্ঞতারাজনীতির ঊর্ধ্বের বিষয়। এটাই সেই বুনিয়াদি ভিত্তি যার ওপর স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রাজনীতি দাঁড়িয়েছে বা দাঁড়ানো উচিত। বাংলাদেশ কেন্দ্রিক যে কোনো রাজনীতির ভিত্তিও এটা। মুক্তিযুদ্ধের বৈধতা, তার সংগ্রাম, তার আত্মদান, তার অপমান-বিপর্যয়, য় ও ধ্বংসের অভিজ্ঞতার প্রতি তাই সমর্পিত না হয়ে পারা যায় না। জনইতিহাস ও জনস্মৃতির মধ্যেও মুক্তিযুদ্ধ তেমনই এক অ্যাবসলিউট ঘটনা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত, যাকে আগলে রাখার কাজ জনগণ করে এবং বারে বারে তা থেকে বৈধতার সমর্থন রাষ্ট্রকেও করতে হয়। কারণ সেটাই আমাদের অস্তিত্বের ভিত্তি। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, কারণ মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। বাংলাদেশ সার্বভৌম থাকবে কারণ তা লক্ষ লক্ষ শহীদের আত্মদানেরসংকল্পের অলঙ্ঘনীয় বাস্তবতা। একাত্তরের রাজনীতির আলোচনা হতে পারে এই স্বীকৃতি দানের পরেই। মুক্তিযুদ্ধে সবার ভূমিকার সমালোচনা হতে পারে, কিন্তু শহীদদের প্রাণদান আর যোদ্ধাদের সংগ্রামকে কোনোভাবেই বাতিল করা যায় না। গেলে, তা হয়ে দাঁড়ায় বাংলাদেশবিরোধী। শর্মিলা বোস কিংবা মানেকশ’র বন্ধুবেশী শয়তানি এ কারণেই বাংলাদেশবিরোধী।
মেহেরজানের মূল ক্রাইসিস
ধর্ষক ও ধর্ষিতা, নিহত ও হত্যাকারী কীভাবে পরস্পরকে ভালবাসতে পারে? প্রথমত, উভয়ের মন থেকে ঘটনাটির স্মৃতি মুছে ফেলে যুদ্ধ ও সংঘাতের বাইরের জমিনে তাদের নিয়ে যেতে পারলে। অর্থাৎ অভিজ্ঞতাটা এবং ইতিহাসটাকে নাই করে দিলে, সেই শূণ্য সময়, সেই ফাঁকা স্পেসে তাদের মিলবার একটা সুযোগ থাকলেও থাকতে পারে। এবং সেই ভালবাসার সাক্ষি হতে হলে দর্শকদেরও সব ভুলে যেতে হয়, চলে যেতে হয় ইতিহাস, ভূমি, মানুষ আর স্মৃতির বাইরের সেই শূণ্যস্থানে।
কিন্তু স্মৃতি, যন্ত্রণা, ভয় ও ঘৃণা দ্বারা ভারাক্রান্ত একটি গ্রামে কীভাবে তা সম্ভব? সম্ভব নয় বলেই ভালবাসাটা হয় অপরাধী এবং পাত্রপাত্রীদের হতে হয় অভিযুক্ত। তারা হারিয়ে যায় এবং প্রত্যাখ্যাত হয়। সেই নিষিদ্ধ প্রেম হওয়ার আরেকটি পথ হলো, সময়কে উল্টোদিকে প্রবাহিত করে খোদ নির্যাতনের ঘটনাটিকে অতীতেই রদ করা, ঘটতে না দেওয়া। কিন্তু এ দুটোর কোনোটাই সম্ভব নয়। সম্ভব একমাত্র ভবিষ্যতে, যখন উভয় পক্ষ একটা রিকনসিলিয়েশন প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে গিয়ে নতুনভাবে মানবিক বন্ধন নির্মাণ করবে, সৃষ্টি করবে নতুন ইতিহাস এবং নতুন বাস্তবতা। তখন হয়তো তা সম্ভব। তার জন্য গত আড়াইশ বছরের ইতিহাসের ভুল ও বিকৃতি সংশোধন করতে হবে। কিন্তু উপমহাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে, পাকিস্তানের অধপাতি চরিত্রে যা আদতে এখনো অসম্ভও অবাস্তব।
মেহেরজান ছবির যে পটভূমি পরিচালক তৈরি করেছেন, সেখানে ওপরে বলা ওই সম্ভাবনা দুটির উল্টোটাই দেখি। কাহিনীর শুরু থেকেই বাঙালিদের মনে ঘৃণার ও যন্ত্রণার স্মৃতি প্রতিমুহূর্তে আরো ঘন ও তীব্র করা হচ্ছে। ছবির শুরু হচ্ছে শেখ মুজিবের স্বাধীনতার ভাষণ দিয়ে। শেষ হচ্ছে ছবির কেন্দ্রপুরুষের হত্যাকাণ্ড দিয়ে। মাঝখানে যুদ্ধ ও ভালবাসা, যন্ত্রণা ও প্রতিবাদ, ঘৃণা ও সহমির্মতার টেনশন। পাকিস্তানি ধর্ষণ-শিবির থেকে পালিয়ে গ্রামে ঢুকছে নীলা। দৃঢ়চেতা স্বাধীন চরিত্রের এই কমিউনিস্ট নারী সঙ্গে করে নিয়ে আসছে কেবল গণধর্ষণ ও নির্যাতনের ট্রমাই নয়, নিয়ে আসছে পাকিস্তানিদের হাতে তার বাবার নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ধাক্কাও।
গ্রামে ঢুকবার পথের উঁচু ঢাল। সেখানকার সেই নরম মাটি বেয়ে উঠবার সময় তার সেন্ডেল আটকে যায়, তার সেই কষ্টকর হাঁটাটাই বুঝিয়ে দেয়, কত প্রতিকুল তার এই যাত্রা এবং সামনেও রয়েছে কত বাধা। এই পথ দিয়েই সে আবার চলে যাবে পেয়ারাবাগানে, বন্দুক হাতে ‘শুয়োরের বাচ্চা খানসেনাদের’ হত্যা করতে। তাকে এগিয়ে দেবেন তারই নানাজান। পালিয়ে আসছে তার খালার পরিবারও_ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জামাই, আর তার তরুণী কন্যা মেহেরসহ। এই যাত্রায় তারাও চাুষ করেছে, হুমকিগ্রস্থ হয়েছে ভয়াবহ নিপীড়নের। খবর আসছে, পাকিস্তানী সেনারা গণহত্যা-নির্যাতন-জ্বালাও পোড়াও করতে আসছে এই গ্রামেও।
মেহেরের পরিবার আর নীলা বাড়ি পৌঁছবার আগেই হুমকি আসে স্থানীয় রাজাকারদের তরফে। হুমকি হয়ে আসে স্বয়ং এক পাকিস্তানী মেজর আর তার জিপ ভর্তি ট্রুপ। নানাজানের আরাম কেদারা দখল করে সেই মেজর বুঝিয়ে দেয়, নানাজান সম্মান ও মতাচ্যুত। এখন সেই মেজরের করুণার কাছেই তাকে সমর্পিত হতে হবে। পায়ের ওপর পা তুলে বসে থাকা উদ্ধত মেজরের সামনে অপমানিত নানাজানের দাঁড়িয়ে থাকার অর্থ আরো পরিষ্কার হয় যখন, নানাজানের আরাম কেদারার পাদানিতে লাথি দিয়ে মেজর ধমক দিয়ে সামনের ছোটো চেয়ারে তাকে বসতে বলে। ছবির একেবারে প্রথমেই নানাজান চিহ্নিত হয়ে যান এক ফলিং ফিগার হিসেবে, অক্ষম গোত্রপতি হিসেবে, যার আর নিজের পরিবার এবং নিজের সমাজকে রার ক্ষমতা নেই। ছবির বাকিটা জুড়ে, মৃত্যু পর্যন্তই আমরা তাঁর পতন ও পরাজয় দেখি। অবান্তর হয়ে যেতে দেখি, ইতিহাসের বাইরে চলে যেতে দেখি। এভাবে মুক্তিযুদ্ধের ৪১ বছর পর নানাজানের মতো চরিত্র এমন এক রাজনৈতিক পটভূমিতে হাজির হন, যখন তাঁর উপস্থিতির কোনো দাগ আর সমাজে নেই, যখন তাঁর প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। তিনি হয়ে ওঠেন ইতিহাসের এক আপে, যার কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই, যার গতি শেষ হয়েছে মরুতে।
২য় কিস্তি পড়ুন
মেহেরজান: যুদ্ধ ও ভালবাসার মালিকানার মামলা ২
Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জানুয়ারি, ২০১১ দুপুর ২:৫৫