‘‘গরিবদের কাছে দিনবদল মানে খাদ্য ও কর্মসংস্থান, খোলামেলা পোশাক আর ছেলে-মেয়ের অবাধ ফুর্তি নয়...ইরানের রাজনীতির কেন্দ্র ধর্মে নয় শ্রেণী সংঘাতে।’’ ফাইনান্সিয়াল টাইমস সম্পাদকীয়, ১৫ জুন, ২০০৯
মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগের কায়রো ভাষণে বারাক ওবামা পঞ্চাশের দশকে স্বাধীন ইরানের প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে উচ্ছেদের কথা স্বীকার করে দুঃখপ্রকাশ করেছিলেন। সেই দুঃখ যে কপট, তার প্রমাণ ইরানের নতুন নির্বাচিত সরকারকে উচ্ছেদের জন্য অর্থ, কূটনৈতিক ও মিডিয়ার চাপ এবং ইরানের অভ্যন্তরের একটি কায়েমি মহলকে উস্কে দেওয়া। বিশ্বের কোন গণতান্ত্রিক নির্বাচনকে আমেরিকা প্রভাবিত করতে চায়নি? গাজা, ভেনেজুয়েলার পর এখন ইরানের নির্বাচনের ফলকেও তারা উল্টে দিতে চাইছে। (সত্তরের বাংলাদেশের নির্বাচনের ফলও কি তারা মেনে নিয়েছিল?) লেবাননের নির্বাচনকে যেভাবে তারা কিনে নিয়েছে ইরানের নির্বাচনকে সেভাবে কিনতে না পারার অস্থিরতাই কি তাদের আচরণে প্রকাশ পাচ্ছে না? মার্কিন ইহুদি লবি এখন বিপন্ন বোধ করছে। তাই নেতানিয়াহুর চেলারা নির্বাচন জালিয়াতির ধুয়া তুলে ওবামার সঙ্গে আহমাদিনেজাদের বৈঠককে ভেস্তে দেওয়ায় খুবই সক্রিয়।
সবই চলছে পাণ্ডুলিপি অনুসারে। ইরানের নতুন সরকারকে ভোট জালিয়াত বলে অভিযোগ করে, আহমাদিনেজাদকে ইরানের জনগণের নিপীড়নকারী হিসেবে চিহ্নিত করে সাদ্দামের মতো অপসারণ করার পরিকল্পনা ধরে অগ্রসর হচ্ছে তারা।
সরকার-কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত মার্কিন মিডিয়া, ব্রিটিশ সরকারের বিবিসিÑ যারা গাজার দুঃস্থ শিশুদের জন্য মানবিক সাহায্যের আবেদন পর্যন্ত প্রচার করেনি কিংবা কাতারের ধনকুবের আমীরদের আল জাজিরা; যার যার সরকারের ইরান-বিদ্বেষের চিহ্নই বহন করে চলেছে। সাম্রাজ্যবাদী আর তাদের পুঁজিবাদী-রাজতন্ত্রী খয়েরখাঁ-রা তাদের কমন শত্র“ ইরানি সরকারের বিরুদ্ধে একজোট হয়েছে। হঠাৎ গজানো ইরান বিশেষজ্ঞদের নোংরা বচনে ভরপুর সংবাদ জগত চালাচ্ছে মিথ্যাকে সত্য বলার গোয়েবলসিয় প্রচার। সবকিছুই এক ব্যক্তিকে অপদস্থ ও পরিত্যক্ত করবার জন্য। তাঁর নাম আহমাদিনেজাদ, ইরানের জাতীয়তাবাদী নেতা। তবে, এখন পর্যন্ত ফ্রান্সের সারকোজি ছাড়া আর কোনো ইউরোপীয় রাষ্ট্রপ্রধান ইরানের নির্বাচনকে আনুষ্ঠানিকভাবে জালিয়াতি বলেননি। তাদের বক্তব্যের ঝোঁক মুসাভিপন্থিদের দমন না করার দিকে।
অনেকেরই চোখে আহমাদিনেজাদ নিতান্তই এক ইহুদি-বিদ্বেষী মৌলবাদী। (সেটা প্রমাণের জন্য তারা তাঁর ইসরায়েলকে নিয়ে একটি ফার্সি উক্তির ভুল অনুবাদ করে কুৎসা রটায়। তিনি বলেছিলেন, ইতিহাসে ইহুদিবাদের কোনো অস্তিত্ব থাকবে না। কিন্তু প্রচার করা হয় তিনি নাকি বলেন, ইসরায়েলের অস্তিত্ব থাকবে না।) কিন্তু অন্য আহমাদিনেজাদ, যিনি তাঁর দেশের স্বাধীনতার রক, যিনি টেলিভিশনে অভিজাতমহলের দুর্নীতি ফাঁস করে দেন এবং যিনি দেশের তেলসম্পদ ব্যবহার করে সংখ্যাগরিষ্ঠ গরিব মানুষের অবস্থার উন্নতির জন্য সচেষ্টÑ পশ্চিমা গণমাধ্যমে ইরানি প্রেসিডেন্টের সেই ভাবমূর্তি কখনো দেখানো হয় না।
ঠিক একই দৃশ্য দেখা গিয়েছিল ব্রিটেনের ১৯৪৫ সালের নির্বাচনের পর। ‘‘তারা শ্রমিক সরকার (লেবার পার্টি সরকার, যাদের মতাসীন হওয়া ভারতবর্ষের স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত করেছিল) নির্বাচিত করেছে, দেশ এটা মেনে নেবে না’, ১৯৪৫ এ ব্রিটেনের নির্বাচনি ভূমিধসের পর এক অভিজাত এই উক্তিটিই করেছিল। পাশ্চাত্যের রাজধানীগুলোও আজ মরিয়া হয়ে আহমাদিনেজাদের পিছু হঠা দেখতে চাইছে।
এটা ঠিকই যে মির হোসেন মুসাভির সমর্থন রাজধানীর ধনী বৃত্ত ছাপিয়ে গেছে। ইরানের মধ্যবিত্তের বড় একটি অংশ, ছাত্র ও ধর্মনিরপেতাবাদীরা মুসাভির পেছনে জড়ো হয়েছে। অথচ এই অভিযোগকারীদের দল কিংবা তাদের আন্তর্জাতিক মিত্ররা এখন পর্যন্ত কোনো ওজনদার প্রমাণ হাজির করতে পারেনি।
পশ্চিমা গণমাধ্যম তবুও আনন্দের সঙ্গে তেহরানের বনেদি তরুণদের বিক্ষোভের দৃশ্য প্রচার করে চলেছে। মুসাভি যেখানে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের বেসরকারিকরণ, সমষ্ঠির ঊর্ধ্বে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও পাশ্চাত্যের সঙ্গে মাখামাখির পক্ষে (আমদানি-রপ্তানির ব্যবসায়িরাও সেটাই চায়), সেখানে আহমাদিনেজাদ সরকারি কর্মচারিদের বেতন ও অবসর ভাতা বাড়ান এবং গরিবদের দেন ঋণ মওকুফের সুবিধা ও সহজ সুদের ঋণ। থাকতে চান স্বাধীনচেতা, জাতীয় সম্পদের হেফাজতকারী। মুসাভি ‘মুক্তবাজারি পুঁজিবাদের’ পক্ষে তিনি তেলসম্পদ বেসরকারি খাতে (মার্কিন-ব্রিটিশ তেলকোম্পানিদের হাতে!) ছাড়তে চান, বন্ধ করতে চান আহমাদিনেজাদের গরিবমুখী সামাজিক সহযোগিতা কর্মসূচি। তাই বিষ্ময়ের কিছু নেই যে, শ্রমিক শ্রেণী, ধর্মমনা মানুষ এবং গ্রাম-মফস্বলের অধিকাংশ গরিব মানুষের মধ্যে আহমাদিনেজাদ জনপ্রিয় থাকবেন। ২০০৫ সালের মতো জনপ্রিয়তা ধরে রাখাও তাঁর জন্য কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। গত মাসে নিরপেক্ষ মার্কিন জরিপ সংস্থা টেরর ফ্রি টুমরো এবং সেন্টার ফর পাবলিক ওপিনিয়ন এর জরিপেও উঠে আসে যে, আহমাদিনেজাদ ২: ১ এর থেকেও বেশি ভোটে জয়ী হতে যাচ্ছেন। টাইমস পত্রিকাও ঘোষণা করে যে, আহমাদিনেজাদই জয়ী হবেন।
মার্কিন জরিপ সংস্থাটি বলছে, ‘আমাদের জরিপে আহমাদিনেজাদের সমর্থনের ভিত্তি অনেক ব্যাপক। মুসাভি নিজেকে আজেরি বলে জোর দিলেও আজেরিদের মধ্যে আহমাদিনেজাদের সমর্থন মুসাভির দ্বিগুণ। (অথচ মুসাভি সমর্থকদের অভিযোগ হলো নিজ জাতিগোষ্ঠী আজেরিদের মধ্যে মুসাভি আহমাদিনেজাদের অর্ধেক ভোট পেতে পারেন না। যেন জাতি পরিচয় শ্রেণী ও অর্থনৈতিক স্বার্থের থেকে বড় হতেই হবে!_অনুবাদক)
...ইরানের সব বয়সীদের মধ্যে ১৮-২৪ বছর বয়সীরাই হলো আহমাদিনেজাদের শক্ত ভিত্তি। একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র, গ্রাজুয়েট ও শহুরে বিত্তবানদের মধ্যে মুসাভি জনপ্রিয়। আমেরিকার এনবিসি টেলিভিশনে তরুণ ইরানীদের দেখানো হয়েছে যারা ইন্টারনেট ব্যবহার করে সংষ্কারের দাবি তুলছে। কিন্তু বাস্তবে মাত্র তিন ভাগের এক ভাগ ইরানি ইন্টারনেট ব্যবহার করে।...ইরানি কর্তৃপ যে ফল ঘোষণা করেছে তা আমাদের জরিপেরই দর্পণস্বরূপ। এটা বড় আকারের জালিয়াতি হতেই পারে না।’’
এসব কিছুর পরও, যেই তেহরানের রাস্তায় মুসাভির সমর্থকরা ‘সবুজ বিপ্লবের’ ডাক দিল, কারচুপির প্রমাণহীন অভিযোগ তুললো, অমনি আহমাদিনেজাদের সমর্থনের নজিরগুলো সবাই যেন ভুলে গেল। বিরোধীদের অভিযোগের প্রধান ভিত্তি হলো কিছু কিছু আঞ্চলিক ভোটের ফল এবং তড়িঘড়ি করে সরকারি ভাবে ফল ঘোষণা। অথচ ভোট গণনা শেষ হওয়ার আগে মুসাভি নিজেই তাঁর বিজয় ঘোষণা করেছিলেন। ফলত সরকারও প্রতিক্রিয়া করতে বাধ্য হয়। খেয়াল করলেই বোঝা যায় যে, ফলাফল তেমন অস্বাভাবিক নয়। মুসাভি প্রায় চার লাখ ভোটে তেহরানে জয়ী হয়েছেন, কেননা রাজধানীতেই বেশি অবস্থাপন্নদের বাস। আবার রাজধানীরই গরিব এলাকায় তিনি শোচনীয়ভাবে হেরেছেন। প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যেকার এক কোটি দশ লাখ ভোটের ব্যবধান জালিয়াতির ফল বলে বিশ্বাস করা কঠিন! কাণ্ডজ্ঞান দিয়েই চিন্তা করুন, আপনার দেশ ইসরায়েল ও আমেরিকার পরমাণু হামলার হুমকির মুখে, আপনার দেশ আরবের একমাত্র গর্ব, আপনার জাতি আত্মসম্মানসম্পন্ন ও জাতীয়তাবাদী আত্মবিশ্বাসে বলীয়ন, এরকম অবস্থায় আপনি কি আপনার দেশের সেরা রককে পরিত্যাগ করবেন? তার মতো সৎ ও দুর্নীতিহীন নেতাকে ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের পুতুল সরকারকে কি আপনি ভোট দেবেন? দিলেও কতজন তা দেবেন???
ইরানি জনগণ আহাম্মক নয় যে, খোলামেলা পোশাক, অবাধ যৌনতার সুযোগ আর পুঁজিবাদী খায়েশের জন্য তারা বিদ্যমান কল্যাণমূলক অর্থনীতি, খেয়েপরে থাকার নিশ্চয়তা আর জাতীয় স্বার্থকে বিকিয়ে দেবে! কিন্তু তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা সেটাই শেখাচ্ছেন। ইরানের রাজপথে পশ্চিমা মদদপুষ্ট মুসাভির সমর্থকদের বিােভ যতটা নন্দিত, একই সময়ে আহমাদিনেজাদের সমর্থনে ল ল লোকের সমাবেশ ততটাই আড়াল করা হয়। আইরিশ টাইমস পত্রিকার সাংবাদিক খেয়াল করেন, ‘কোনো কোনো এলাকায় মানুষের মনোভাব উৎসব মুখর। লাখ লাখ মানুষ নতুন করে পুননির্বাচিত প্রেসিডেন্টের পে তেহরানের কেন্দ্রস্থলে মিছিল করতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে’। তেহরান এখন দ্বিধাবিভক্ত। গরিব প্রধান দণি তেহরানের বিজয়মুখরতা আর উত্তর তেহরানের অভিজাত অঞ্চলের বিােভ যেন দুই আলাদা শহরের চিত্র।
এই বিভাজন ইরানের শাসকবৃত্তের বিভাজনেরই চিহ্ন। প্রধান নেতা খামেনি ও সাবেক দুই প্রেসিডেন্ট রাফসানজানি ও খাতামির দ্বন্দ্বেরই প্রকাশ ঘটছে আহমাদিনেজাদ বনাম মুসাভির দ্বন্দ্বে। রাফসানজানিকে একসময় বলা হতো ‘হাঙ্গর’ পরে বলা হয় ‘ধূর্ত শেয়াল’ আর এখন ‘কিংমেকার’। আহমাদিনেজাদ রাফসানজানির দুর্নীতি ও পশ্চিমাদের সঙ্গে যোগসাজশ ফাঁস করে দেওয়ার প্রকাশ্য হুমকিও দিয়েছেন। শাসকদের এই দুই বৃত্ত আসলে জনমুখী জাতীয়তাবাদ আর মার্কিনপন্থি পুঁজিবাদের দ্বন্দ্ব আকারেই দেখা দিয়েছে। যার জন্য একদিকে গরিব-মেহনতি-নিম্নবিত্ত অন্যদিকে উচ্চ আয়ের পশ্চিমাপন্থি ভোগবাদী এলিট মহল। এখানে বলা দরকার যে, মুসাভির মুরুব্বি রাফসানজানি ইরানের ধর্মীয় নেতাদের একটি অংশ ও বিজনেস এলিটদের নিজের পক্ষে টানতে পেরেছেন। ইরান জুড়ে কয়েকশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নেটওয়ার্কও তাঁর অধীনস্ত।
ইরানের সমাজের এই শ্রেণী বিভাজন পশ্চিমা গণমাধ্যমে উপেতি। তারা কেবলই ধর্ম দেখে, মানুষের বাস্তব স্বার্থের পে দাঁড়ানোকে দেখে না। মুসাভির তথাকথিত সংষ্কার আন্দোলনের সমর্থন কেবল সুবিধাভোগী শ্রেণীর মধ্যে। সমাজের নিচুতলায় এর সমর্থন কম। মুসাভি গোষ্ঠী ওয়াশিংটনের সঙ্গে আরেকটু নরম কণ্ঠে কথা বলতে চায়। যদিও তারা ইরানের পারমানবিক বোমা অর্জনের পক্ষে। কিন্তু তারা হামাস ও হিজবুল্লাহকে সমর্থন করে না। অন্যদিকে আহমাদিনেজাদপন্থিরা বিশ্বাস করে, কেবল দৃঢ়তার মাধ্যমেই আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে পাশ্চাত্যের স্বীকৃতি পাওয়া সম্ভব। মুসাভি যতই সংষ্কারের কথা বলুন না কেন, ১৯৮১ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত ইরানের প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় তিনি গণহারে বিরোধীদের হত্যা করেন। এদের বেশিরভাগই ছিল বামপন্থি কর্মী। ইরাক-ইরান যুদ্ধেও তাঁর ভূমিকা প্রবল ছিল। ঐ যুদ্ধে প্রায় দশলক্ষ ইরানি পঙ্গু বা নিহত হয়। সেই আমলে তাঁকে ‘অতি-রক্ষণশীল’ বলা হতো। এবারেও তাঁর পেছনে রয়েছে ইরানের সাবেক দুই প্রেসিডেন্ট আলী আকবর রাফসানজানি, খাতামি ও মোল্লাতন্ত্রের একটি অংশ। রাফসানজানি ইরানের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি। তার গ্রুপ ইরানের তেলসম্পদের বেসরকারিকরণ চায়। আহমাদিনেজাদ চান দেশের ধন-সম্পত্তির পুনর্বন্টন, তা এরা মানতে নারাজ।
ইরান এখন ফিলিস্তিন থেকে পাকিস্তান পর্যন্ত বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্য সংকটের কেন্দ্রে চলে এসেছে। ইরাকে বুশ সরকারের বিপর্যয়কর ব্যর্থতা ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের বিস্তৃতি এখনো শেষ হয়নি। সেই লক্ষ্যে ইরানে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির চেষ্টা হচ্ছে। গত ১৫ জুন পাকিস্তানের সাবেক সেনাপ্রধান মির্জা আসলাম বেগ সেখানকার পশতু রেডিওতে বলেন যে, ইরানের নির্বাচনে মার্কিন হস্তক্ষেপের অকাট্য প্রমাণ মিলেছে। ‘দলিলপত্র প্রমাণ করছে সিআইএ সেখানে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে মসনদ উল্টে দিতে ৪০০ মিলিয়ন ডলার খরচ করেছে।’ এ ধরনের বিপ্লব তারা করেছিল জর্জিয়া ও ইউক্রেইনে। এটা সম্ভব যে, ইরানের রাজনীতির গৌণ চরিত্র মুসাভি তাদের কেনা গোলাম, তাকেই হয়তো ভাবা হচ্ছে ইরানের জারদারি/কারজাইয়ের চাকরির উপযুক্ত বান্দা হিসেবে।
এর মধ্যে ইরাক ও আফগানিস্তানে প্রতিরোধ যুদ্ধ ও সহিংসতা আরো বাড়ছে। শহরগুলো থেকে মার্কিন সেনাদের সরিয়ে আনা হচ্ছে। আফগানিস্তানে আরো ২১ হাজার সৈন্য পাঠিয়ে দখলদারিত্বকে স্থায়ি করার ব্যবস্থা নিচ্ছেন ওবামা। ন্যাটো বাহিনীর ওপর আক্রমণও সর্বকালের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। আফগান যুদ্ধ প্রতিবেশী পাকিস্তানেও ছড়িয়ে গিয়ে ২০ লাখের মতো উদ্বাস্তু সৃষ্টি করেছে এবং দেশটির উত্তরপিশ্চম অঞ্চলে মার্কিন ড্রোন হামলায় বেসামরিক হত্যাযজ্ঞ ঘটাচ্ছে।
কেউ যদি এসব থেকে ভেবে থাকেন যে, পশ্চিমা দখলদারিত্ব অতীতে পরিণত হতে যাচ্ছে তবে তিনি ভুল ভাবছেন। মার্কিন প্রতিরা মন্ত্রী রবার্ট গেটস এর কথা প্রতিধ্বনিত করে ব্রিটিশ সেনাপ্রধান সম্প্রতি বলেছেন, ‘ইরাক ও আফগানিস্তান কোনো ভুলের পরিণাম নয়_ তারা হলো ভবিষ্যতের দিকচিহ্ন’।
এরকম এক অবস্থায় ভেতর থেকে ইরানকে নড়িয়ে দিয়ে স্বাধীন আঞ্চলিক শক্তি থেকে তাকে নির্জীব করে ফেলা হবে আমেরিকার জন্য বিরাট এক উপহার। তাতে করে বাগদাদ থেকে বৈরুত পর্যন্ত সমস্ত অবাধ্য শক্তিকে বশ করা সহজ হয়। ইরাক আগ্রাসনের পর সেখানে আমেরিকা যে গ্যাঁড়াকলে পড়েছে তা থেকে বের হয়ে আসার পথও তাহলে খুলে যায়। কিন্তু এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে, দালালদের দিয়ে জর্জিয়া-ইউক্রেইনের মতো করে তেহরানে আরেকটা রংদার বিপ্লব ঘটানো ততটা সহজ নয়।
আমার কৈফিয়ত: আমার কোনো কোনো বন্ধু, অনেক গণতন্ত্রমনা বাংলাদেশিও ইরানে মার্কিন-ইসরায়েল মদদপুষ্ট মুসাভি গংয়ের ক্যুদেতার চেষ্টার সমর্থক বনেছেন। তাদের মতো আমিও ইরান বিশেষজ্ঞ নই। কিন্তু বহুদিন ধরে মধ্যপ্রাচ্যের সংকটের পর্যবেক্ষণ ও খোঁজখবর আমাকে তাদের বিপরীতে দাঁড় করিয়েছে। আমি বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী নতুন যে বামপন্থি শিবির শ্যাভেজ-মোরালেস-লুলা-প্রচণ্ডদের নেতৃত্বে দানা বাঁধছে তাদের সমর্থক। একই কারণে হামাস-হিজবুল্লাহ-আহমাদিনেজাদদের শিবিরকে মিত্র মনে করি। আমি জানালার লোভে দরজা বিকিয়ে দেওয়ার পক্ষে নই। আজকের বাংলাদেশেও একধরনের ভুঁইফোঁড় বুদ্ধিজীবী, ফ্যাশনদুরস্ত যৌনকাতর তারুণ্য আর ভোগবাদী উচ্চবিত্ত শক্তি অর্জন করেছে। ব্যক্তিগত স্বার্থে দেশের মাটি-সম্পদ-পানি ও সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দিতে এদের একটি লোমও কাঁপে না, অথচ পাশ্চাত্যের অধিপতিদের মিথ্যে আশ্বাস আর ভোগের হাতছানিতে এদের লোমকূপ পর্যন্ত রসে ভরে ওঠে। বিশ্বের সকল অধীনস্ত দেশেই বিশ্বায়িত পুঁজি ও তাদের কালচার ইন্ডাস্ট্রি এদের পয়দা করে চলেছে, এদের মন-মগজ ম্যাট্রিক্স ফিল্মের বন্দিদের মতোই অবশ ও অচেতন। এরাই আজকের রাজাকার। এরাই সিঁদ কেটে সাম্রাজ্যবাদী ঘাতকদের আসবার পথ তৈরি করে দেয়। ইরানের ঘটনায় এদের মুখোশ আরেকবারের মতো উন্মোচিত হলো। কী কারণে মাত্র কয়েক লক্ষ ইংরেজ ৪০ কোটি ভারতবাসীকে ২০০ বছর ধরে অধীনস্ত করে রাখতে পেরেছিল, এদের উপস্থিতি তার ব্যাখ্য দেয়। বাংলাদেশেও আমাদের এদের চিনে নিতে হবে, সজাগ থাকতে হবে। এ ছাড়া বাঁচার আর কোনো পথ খোলা নাই।
* সংযোজনটা এখানে দিলে বড় হবে বলে কমেন্টে দিলাম শেষের দিকে।