Manekshaw: A soldier who created a nation ভারতের সুপ্রচারিত অনলাইন জার্নাল রেডিফ এভাবেই এই বীর সেনানীর প্রতি শেষ অভিবাদন জানায়। তাহলে তিনিই বাংলাদেশের জন্মদাতা? এর প্রতিধ্বনি ওঠে ভারত তো বটেই এমনকি বাংলাদেশেরও বেশ কিছু পত্রিকার ভাষ্যে ও লেখায়। দেখি এবং চুপ করে থাকি।
একটা সময় শোক ছাপিয়ে মনে সমালোচনা বাজতে থাকলো চড়া সুরে। অস্বস্তির কাঁটা খোঁচাতেই থাকে। এই লেখার তাড়না সেই কাঁটা।
বাংলাদশে রাষ্ট্ররে জন্ম কি সত্যেই ভারতের এক সেনাপতির কৃতিত্বের ফসল? তিনি না থাকলে বা তাঁর জয় না হলে কি ইতিহাস অন্যরকম হতো? ইতিহাসে ব্যক্তির ভূমিকা কি এতই মোক্ষম? এসব প্রশ্ন মাথায় আসছে।
মানকেশ যা করছেনে, সটো তাঁর দায়িত্ব ছিল। তাঁর সরকারের হয়ে যুদ্ধ করা তাঁর চাকরির শর্ত। বাংলাদেশের অগণিত মুক্তিযোদ্ধার কাছে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া চাকরির শর্ত ছিল না। বিদ্রোহী হয়েই তাঁরা যুদ্ধে নেমেছিলেন। এ দুইকে এক করে দেখা সম্ভব নয়। তবে মানেকশ এখানেই অনন্য যে, তিনি দক্ষ সমরবিদ।
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া ছিল ভারত সরকারের রাজনৈতিক ও সামরিক সিদ্ধান্ত। তিনি সেই সিদ্ধান্তের সফল ও সুচারু বাস্তবায়ক। আর আমরা জানি যে, যুদ্ধ হচ্ছে রাজনীতিরই সম্প্রসারণ। ভারত তার রাজনীতি করেছে এবং তার সুফল বাংলাদশে বিপুলভাবে পেয়েছে। এখানে বলা দরকার যে, ভারত গঠনগতভাবে এমন রাষ্ট্র নয় যে, যে কোনো স্বাধীনচেতা জাতির পক্ষে অবস্থান নিতে তা সাংবিধানিক বা আদর্শগতভাবে বাধ্য। তা হলে আসাম, নাগাল্যান্ড, পাঞ্জাব বা কাষ্মীরে তাকে দীর্ঘমেয়াদে দমন-পীড়ন ও সামরিক শাসন চালাতে হতো না। এবং বাঙালির 'কথিত মুক্তিদাতা' স্যাম মানেকশ-কেও আসাম-নাগাল্যান্ড বা কাশ্মীরে বিদ্রোহ দমনে নিয়োজিত থাকতে হতো না। বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের যিনি বন্ধু তিনি আবার অন্য জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের শত্রু হন কীভাবে, যদি না যুদ্ধ কেবল তার পেশাগত বিষয় হয়? তিনি পেশাদার যোদ্ধা এবং সেই পেশায় তিনি উৎকৃষ্টদের একজন।
১৯৭১-এ ভারতের বাংলাদেশকে সর্বোতভাবে সাহায্য করা নিশ্চয়ই ভারতের মহিমাকে বাড়িয়েছে, কিন্তু সেই মহিমা থেকে বাংলাদেশের জন্ম বা বিজয় কোনোটাই হয় নাই। আমাদের জন্ম আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের বিকাশের মধ্যে এবং এই জনগোষ্ঠীর স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার মধ্যে। এ বিষয়ে কোনো ছাড় দেয়া মানে হয় ঐ রাজনৈতিক ইতিহাসকে ভুল বলে বাতিল করা নতুবা তাকে ঠিক মতো বুঝতে না পারা।
বাঙালিরা স্বাধীনতার ইচ্ছা করেছে এবং তার জন্য যুদ্ধ করার প্রস্তুতিও নিয়েছে। এই সংকল্প না থাকলে কারো পক্ষেই সম্ভব ছিল না বাংলাদেশকে মুক্ত করা। এই সংকল্প তিনটা ধারায় দিনে দিনে দানা বেঁধেছিল। প্রথমটিসাংস্কৃতিক: জাতীয়তাবোধের জায়গা থেকেই বাংলার মানুষ পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় পরিচয় এবং তার সাংস্কৃতিক রাজনীতির সঙ্গে দূরত্ব বোধ করছে। বাস্তবের পাকিস্তানের আগেই মনের পাকিস্তানকে তারা ধ্বংস করেছে। এ থেকেই জন্ম নিয়েছে স্বাধীনতা সংগ্রামের দ্বিতীয় ধারা জাতীয়তাবাদের রাজনীত। জাতির মুক্তিকে এই রাজনীতি একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের আধারে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে। ৪৮-৭১ পর্যন্ত এরই বিকাশ আমরা বহুধারায় বহু ঘটনার মধ্যে দেখি। এরই চরম পর্যায়ে জন্ম নেয় স্বাধীনতার পথে তৃতীয় ধরনের সংগ্রাম: সামরিক সংগ্রাম। ৫২ সাল থেকে শুরু করে আগরতলা মামলা র্পযন্ত এর প্রথম ধাপ এবং দ্বিতীয় ধাপ দেখা দেয় একাত্তরের র্মাচ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধে। সংস্কৃতি-রাজনীতি এবং জাতিতে সশস্ত্র করে তোলা এই তিন হচ্ছে স্বাধীনতা সংগ্রামের বলবান পর্বত। যুদ্ধ হচ্ছে এর শিখর। ভিত্তি হচ্ছে সংস্কৃতি আর রাজনীতি হচ্ছে এর সৌধ। এই শিখর পর্বেই ভারত-সহ আন্তর্জাতিক নানান শক্তির ভূমিকা দেখতে পাই। কিন্তু কেবল শিখরকেই স্বাধীনতার মূল দেহ ভাবলে পর্বতটাকে কেবল একটা টিলা মনে হতে বাধ্য।
১৯৭১ সালে উপমহাদেশে দুটি যুদ্ধ হয়েছিল। একটি বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের যুদ্ধ। অন্যটি ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের যুদ্ধ। পাক-ভারত যুদ্ধ হচ্ছে সেই টিলা বিজয়ের যুদ্ধ। ভারত রাষ্ট্রের ইতিহাসে এটা এক গৌরবজনক অধ্যায় মাত্র। ভারত রাষ্ট্রের সমগ্র অস্তিত্বের প্রতীক বা তার সমমূল্য কিন্তু এই বিজয় পায় না। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য তা তার জাতীয় অস্তিত্বের সমতুল এবং পরিণতি। ভারতীয় পক্ষ থেকে তাদের মিডিয়ায় এবং বাংলাদেশেও কেউ কেউ মুক্তিযুদ্ধকে প্রকারান্তরে ভারতেরই বিজয় হিসাবে দেখতে চান এবং মূল যুদ্ধকে_যেটা বাঙালির জাতীয় যুদ্ধ_ খাটো করে দেখেন। মানেকশ'র বিজয় বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা সম্ভব করেছে বা সেই বিজয়ের ফল বাংলাদেশের জন্ম, এমন মনোভাবের মধ্যে যে অধিপতি সুলভ দৃষ্টিভঙ্গি বা তাকে মেনে নেয়ার মধ্যে সমর্পিত মনোভাব থাকে তা আপত্তিকর। একজন কেন লক্ষ সৈনিকেরও কাজ নয়, কোনো দেশ স্বাধীন করা। সেটা তাদের ক্ষমতার বাইরের ব্যাপার। পরাধীন দেশের বেলায় তা আরো সত্য। সমগ্র জনগণের গভীর সাংষ্কৃতিক, রাজনৈতিক ও সামরকি প্রস্তুতি ও সংকল্প না থাকলে জাতীয় যুদ্ধে বিজয়ী হওয়া যায় না। এই জিনিষ সেনা কমান্ডে গঠিত হয় না।
আগে যে দুটি যুদ্ধের কথা বলেছি, তার মিলিত রূপটি ছিল মিত্র বাহিনীর প্রতিষ্ঠা। সেই বাহিনী যৌথ কমান্ডে চলতো, কিন্তু কার্যত প্রধান ছিলেন মানেকশ। এর গঠন এবং ভারতীয় বাহিনীর একতরফা সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ আছে। আগামি দিনের কোনো ইতিহাসবিদ হয়তো তা করবেন। কিন্তু যুদ্ধের মধ্যেই বাংলাদেশকে নানানভাবে কোণঠাসা করে রাখা হয়। মুজিবনগর সরকারের বিবরণীতে তার অনেক নজির আছে। যুদ্ধ পরিচালনার ব্যাপারেও এ কথা খাটে। নভেম্বরে শুরু হওয়া ভারতীয় অভিযান থেকে শুরু করে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান পর্যণ্ত এর অনেক প্রমাণ মিলবে। বাংলাদেশের জনগণের বিরাট-বিপুল প্রতিরোধ সংগ্রামকে পাশ কাটিয়ে তার সুফল নিয়ে পাকিস্তানকে এক হাত দেখে নেয়ার প্রবণতা ভারতীয়দের মধ্যে ছিল। তারই প্রমাণ ঢাকা অভিযানে বাংলাদেশি বাহিনীকে সঙ্গে না রাখা, যদিও তারা তখন কর্ণেল শফিইল্লাহর নেতৃত্বে তিন দিক থেকে ঢাকাকে ঘিরে রেখেছিল। তাদের ওপর দিয়ে উড়ে গিয়ে জেনারেল অরোরা পাকিস্তানীদের বলেন, বাঙালিরা এসে তোমাদের শেষ করে দেবে। তার চাইতে আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করো আমরা তোমোদের নিরাপত্তা দেব। ভারত এ প্রতিশ্রুতি রাখে এবং শিমলা চুক্তির মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পথ বন্ধ করে দেয়। ভারতের কাছে আমরা চিরকৃতজ্ঞ কিন্তু এরকম অনেক জটিলতার জন্ম তাদের কারণেই হয়েছে।
যাহোক আমি একাত্তরে বাঙালি সমাজরে সর্বাত্মক প্রতিরোধের ব্যাপকতার দিকেই মনোযোগ কাড়তে চাই। এ যুদ্ধে কৃষক-সন্তান ও শহুরে তরুণরা লড়াইয়ে নেমেছেল। গোটা সমাজও সেই যুদ্ধের সঙ্গি হয়েছিল। ভারতীয় অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ নিয়ে এরাই কিন্তু পাকিস্তানীদের কোনঠাসা করে ফেলেছিল। নভেম্বরের দিকে সবখানেই পাকিস্তানীদের দাপট নিজ নিজ ঘাঁটির মধ্যে সীমিত হয়ে পড়েছিল। তাও কেবল শহুরে এলাকায়। তারা তখন সপ্তম নৌবহররে আর চিনা অস্ত্রের চালানের অপেক্ষায় দিন গুণছিল। দরকার ছলি একটা ফাইনাল ব্লো। ভারতীয় বাহিনী চকিতে একতরফা ভাবে সেই কাজটাই করে। তখন বাংলাদেশ বাহিনী এর জন্যই তখন ঢাকার দোরগোড়ায় এসে অপেক্ষা করছে চূড়ান্ত নির্দেশের। তার আগেই ভারতীয়রা কৌশলে আত্মসর্মপণ নাটক মঞ্চস্থ কর। এ ঘটনার নাটকীয় বিবরণ পাবেন মুক্তিযোদ্ধা ব্রিগেডিয়ার হেলাল মোর্শেদ খানের জবানীতে। পরের আরেকটি ব্লগে তা দিলাম। রিপোর্টটা আমার ছিল। এটা ছাপা হয়েছিল ২০০৭ সালের ১৩-১৪ তারিখের সমকাল পত্রিকায়।
আমার এত কহন কওয়ার উদ্দেশ্য আর কিছু না। মুক্তিযুদ্ধ ও এর রাজনীতিকে একদল ভারতের পক্ষপুটে বসে দেখেন, আরেকদল মৃত পাকিস্তানের ভুতের আছরলাগা ঘোর থেকে দেখেন। বাংলাদেশের স্বতন্ত্র জায়গা থেকে দেখার লোক কমই আছে।
১৯৭১ সালে আমরা কেবল গোলামির জিঞ্জির ছিন্ন করেই বেরিয়ে আসিনি, ইতিহাসের দিগন্তে নতুন একটি রাষ্ট্রেরও জš§ দিয়েছিলাম। যে জনগোষ্ঠীর জেদে এই মহাকর্তব্য হাসিল হলো, স্বাধীনতার মতায় কী সে অর্জন করতে পারে, সে জ্ঞান আজো তার হয়নি। এ না জানলে স্বাধীনতার সামর্থ্যটাই মাটি হয়ে যায়। দুর্ভাগ্য যে আজ তা হতে বসেছে।
এ বাপারে বাংলাদেশের ঘরের রাজনীতিতে কোনো সমঝোতা না থাক, বোঝাপড়াটুকুও নাই। ফলে উপমহাদেশের রাজনৈতিক পাটাতনে আমাদের ভূমিকার স্পষ্টতা ও নিজস্ব কার্যকারিতাও নাই। আমরা দুলছি বড় রাষ্ট্রের ঢেউয়ের ধাক্কায়_ কাণ্ডারিহীন। সবরকম দীনতার মাফ আছে, কিন্তু নিজের অস্তিত্ব নিয়ে এরকম বেহুশ যে, তার দীনতার মাফ নাই। ইতিহাসে বেশুমার প্রমাণ আছে এর। বাংলা ভূখণ্ডে বসতকারি নানা জাতিগোষ্ঠী, ধর্ম ও সম্প্রদায়ে লোকেরা যতদিন নিজেদের রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসাবে চিনতে না পেরেছে, ততদিন নিজেদের দেশ ও সমাজের কর্তৃত্বের দাবিদার তারা হতে পারবে না।
বাংলাদেশ মানে তাই পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে আসা রাষ্ট্র নয়, নয় কেবল ভারত রাষ্ট্রের প্রতিবেশী ও সেই রাষ্ট্রের বাঙালিদের ‘অপর’ অংশের দেশ। কেবল মুসলমান বাঙালি বা সরাসরি বললে মুসলিম পরিচয়ের মধ্যে ভারত থেকে আমাদের আলাদা থাকার যুক্তি তৈরি হয় না, কেননা ভারতেও বিপুলসংখ্যক মুসলমান বাস করেন। যুক্তি হিসাবে এটা দুর্বল। বাংলাদেশ নামক ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার খোঁজ এতে মেলে না। সেই খোঁজ নাই বলেই এদেশের শাসকশ্রেণী, বিদ্বৎ সমাজ ও রাজনৈতিক
সংস্কৃতিতে আজগুবি দুই ‘বাংলাদেশ’ আবিষ্কৃত হয়। খামাখাই এক সাংস্কৃতিক গৃহযুদ্ধ চলে। এ দুই বাংলাদেশের একটা পাকিস্তানের কোটরে আস্তানা গেড়ে ভারতের প্রতি খবরদারের আঙুল তোলে। আরেকটা খেয়ে না খেয়ে ভারতের কাঁধে ভর দিয়ে পাকিস্তানের প্রেত তাড়ানোর বায়বীয় লড়াইয়ের কোশেশ করে যায়। ওদিকে দেশ ঠিকই দখল হয়ে যায়। এ দুটোই প্রতিক্রিয়াজাত। ভারত ও পাকিস্তানের রাজনৈতিক অস্তিত্বের প্রতিক্রিয়া। কিন্তু কর্তারূপ বাংলাদেশের ক্রিয়া কই? সেও কি একাত্তরের শহীদদের মতোই বেওয়ারিশ লাশ হয়ে সতকারহীনভাবে পড়ে আছে ইতিহাসের কোনো অন্ধকার আবর্তে। তাই বারবারই তার বিজয় হাতছাড়া হয়, আর তার যুদ্ধ হয়ে যায় অপরের যুদ্ধ। তাকে জন্ম দেয় অপরে! হা, বিষ্ময়! এরা এতই বেহুশ যে, জনগণ এবং জাতিই যে একমাত্র অলৌকিক, সে নিজের গর্ভে নিজেকে জন্ম দেয়, সেই হুঁশ আসে না। জাতির কোনো স্রষ্টা নাই। সে নিজেই নিজের স্রষ্টা। এই জন্যই ঈশ্বর বনাম জনগণ পরস্পরকে কখনো সার্বভৌম বলে স্বীকার করতে পারে না।