তখনও দুপুরটা জুত করে বসতে পারেনি হাজী আব্দুর জব্বারের উঠোনে, গাছের ছায়া উঠোনটার অর্ধেকের দখল নিয়েছে, হালকা বাতাসে পাতাগুলোর নড়াচড়া রোদকে খুব সুবিধা করতে দেয়না । চৈত্রের যা একটু হম্বিতম্বি তা হাজী সাহেবের টিনের ঘরের দেয়ালে । হাজী আব্দুর জব্বারের দুই ছেলে তাদের পরিবার নিয়ে এখানেই থাকে । বড় ছেলের ঘরে একটা নাতিও আছে আব্দুর জব্বারের। ছোটছেলের বিয়ে হল কিছুদিন আগে । হাজী আব্দুর জব্বারের আপন বড় ভাই আব্দুর সোবহানের ছোটমেয়েটাকে তিনি তার ছোটছেলের বউ করে এনেছেন। মরহুম ভাইজানের প্রতি তার অসীম শ্রদ্ধা, তাই ছোটছেলের বউকে তিনি বাড়ির মেয়ের মতই দেখেন, সেই দুপুরে আব্দুর জব্বার তার ছোটছেলে শাহীনের মোটরসাইকেলের পেছনে এই কিছুক্ষণ আগেই তাদের গঞ্জের দোকানে রওনা হলেন । ওখানে তাদের একটা কাপড়ের দোকান আর সারের ডিলারশিপ । আব্দুর জব্বারের বড় ছেলে মাসুদ বেশ সংসারী, বৈষয়িক। গ্রামের হাইস্কুলের মাস্টার আর তাদের কৃষিজমিগুলো দেখাশুনা করে। বিষয়বুদ্ধি ভালো থাকায় এই কয়েক বছরে তাদের ভূসম্পত্তির পরিমাণ অনেকটা বাড়িয়ে নিয়েছে। তবুও হাজী আব্দুর জব্বার মনে হয় শাহীনকেই বেশী ভালোবাসেন। ৬০-৬২ বছর বয়সেও আব্দুর জব্বারের তার পরিবারের সমস্ত সুতার নিয়ন্ত্রণ তার হাতে রাখতে পেরেছেন । ছেলেরা তাকে এখনো খুবই ভয় পায়।
মাসুদ তার স্ত্রী-সন্তানসহ ৪-৫ দিন ধরে শ্বশুর বাড়িতে। শাহীনের বউ বিলকিস তার ঘরের মেঝেতে বসা, ফ্যানটা ঘর্ঘর শব্দ করে হটাৎ থেমে গেলে, বিলকিসের কণ্ঠ শোনা যায়।
”ঐ পারভীন দ্যাখতো আম্মার ঘরে আমেনা ঘুমাইছে নাকি? আম্মারে বাতাস করতে বল”
পারভীন বিলকিসের শাশুড়ির ঘরে যায়, কয়েকবছর ধরে শয্যাশায়ী মহিলার ঘুমন্ত বুক থেকে পাকা মেঝেতে ভারী কিছু টেনে নিয়ে যাবার মত একধরণের ক্লান্তিকর শব্দ শোনা যায়। তার দেখাশুনার জন্য রাখা আট-দশ বছর বয়েসী আমেনাকে দেখা যায় মাথার কাছে হাতপাখা নিয়ে বাতাস করতে। পারভীন উঠোন পেরিয়ে বিলকিসের ঘরে আসে, বিলকিসকে তখন দেখা যায় বাপের বাড়ি থেকে নিয়ে আসা ১৪ ইঞ্চি টেলিভিশনটার ধুলো ঝারতে।
বিলকিসের আচরণে নতুন বউসুলভ ব্যাপারটা নাই। সে খুব ছেলেবেলা থেকেই এই বাড়িতে আসে। শাহীনের সাথে যে তার বিয়ে হবে, সেটা সে মোটামুটি অনেক আগে থেকেই জানে । এই বাড়িতে তার চলাচল সাবলীল । বিয়ের সময় মেঝেতে আঁকা খুব কাঁচা হাতের আলপনার উপর পা ছড়িয়ে বসলে পারভীন অনুভব করে বিলকিসের সারা অবয়ব থেকে যে সৌন্দর্য বের হচ্ছে তার নাম স্বাস্থ্য। বিলকিসের ২০ বছরের তরুণী শরীরের কোথাও আড়ষ্টতা নেই, যদিও তার ফর্সা গায়ের রং এবং কোমর ছড়িয়ে নামা চুলের প্রশংসাই সবথেকে আগে আসে, কিন্তু বিলকিসের শরীর অনেক সুগঠিত, অনেক জীবন্ত । পারভীন বিলকিসের চুল বেঁধে দিতে দিতে প্রস্তুতি নেয়, শাহীনের একটা ফুলপ্যান্ট চেয়ে নেবার জন্য। তার সৎ ছেলেটা হাবাগোবা, ১২-১৩ বয়সের তুলনায় বেড়ে উঠছে ধাইধাই করে। পারভীন জয়নালের ২য় স্ত্রী হিসেবে যখন আসে তখন ছেলেটার বয়স চার, শরীরের তুলনায় মাথাটা খানিক বড়, মরা মাছের চোখের মত দৃষ্টি, ন্যাড়া মাথায় তিন চারটা বড় বড় ঘা, পারভীন বাচ্চাটাকে দেখে ভয় পেয়ে যায়, তার রিকশাওয়ালা স্বামীর কাছে সে অনুযোগ করে, ক্ষুদে শয়তানের মত দেখতে ছেলেটা চোখ খুলে ঘুমায়, অনেকরাতে ঘুম ভাঙ্গলে পারভীনের মনে হত ছেলেটা তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। সে তার মরে যাওয়া সতীনের পিণ্ডি চটকায়, রাগে গজগজ করে। কিন্তু কিছুদিন চলে গেলে পারভীন ছেলেটার সত্যিকারের মা হয়ে উঠে । ছেলেটার পেটে রাজ্যের ক্ষুধা, জয়নালের রিক্সাচালানো উপার্জন আর পারভীনের বাড়িতে বাড়িতে ঝিগিরি করে যা পায় তার অর্ধেকটাই ছেলেটার পেটে যায়। শিশু হিসেবে কুৎসিত হলেও কৈশোরে ছেলেটা বেশ সুন্দর হিসেবে ধরা দেয়, বেশ সুঠাম হয়ে উঠে সে ।
পারভীন তার ছেলেটাকে নিয়ে চিন্তিত হয়ে উঠে, এইতো তিন-চারদিন আগে চায়ের দোকানে কয়টা পোংটা ছেলে, ছেলেটার লুঙ্গি ধরে টানছে, বলছে “তোর মাগুর মাছটা দেখাইলে তোক এলা খিলাইম”। ছেলেটা এক হাতে প্রানপনে তার লুঙ্গির গিঁট ধরে রাখার চেষ্টা করছে, আর এক হাত কামড়ে ধরছে, সে ছেলেগুলোর তুলনায় স্বাস্থ্যবান হলেও তাদের প্রতিরোধ করবার মত কোন কৌশল সে শেখেনি, রেগে গেলে সে নিজের হাত কামড়ে ধরে, কাঁপতে থাকে, আর ঠোঁটের কোনা থেকে ঝরে পড়ে গ্যাঁজলা আর অস্ফুট গোঙানি । পারভীন খবর পেয়ে ছুটে যায় গালির তুবড়ি ছোটায় “জাউড়ার বাচ্চারঘর তোমার বাপেরটা দেইখবার পাইসনা”। ছেলেটার হাত ধরে টেনে আনে ঘরে, অক্ষম আক্রোশে হাবাছেলেটাকে দুই চারটা কিলঘুষিও দেয় ।
জড়বুদ্ধি ছেলেটার পাকস্থলী আর প্রজননযন্ত্রের এরকম বাড়াবাড়ি রকম স্বাভাবিকত্ব পারভীনের কাছে খোদার অবিচার বলেই মনে হয় ।
সে বিলকিসের কাছে তার চাহিদা পেশ করার আগেই, ছুটে আসা পদক্ষেপের শব্দ শুনতে পায়, আর একটা কণ্ঠ জানায় “পারভীন’বু তোর ছাওয়া পানিত পরি মলছে”। পারভীনের মুখ থেকে একটা অসমাপ্ত চিৎকার বের হয়, তারপর সে দৌড়ে বের হয়ে যায় ঘর থেকে, সম্ভবত তার হাত কিংবা পা দরজার চৌকাঠে বাঁধা পায়, সে হুমড়ি খেয়ে পড়তে গিয়েও সামলে নেয় ।
পারভীন চলে গেলে বিলকিসের সারা শরীর জুড়ে গতকালকের গোলাঘরের দমবন্ধ গন্ধটা জেঁকে বসে। কালকে গোলাঘরে কোন একটা দরকারে বিলকিসকে ঢুকতে হয়েছিল, ইঁদুর আরশোলা কিংবা অন্য পোকামাকড়ের উপদ্রব থাকতে পারে ভেবে বিলকিস পারভীনের জড়বুদ্ধি ছেলেটাকে সাথে নেয় , ছেলেটা বিলকিসের বেশ অনুগত। গোলাঘরের ভেতরের মাচায় ছেলেটা ডুলি নামানোর জন্য উঠলে ছোট ছোট লাল পিঁপড়ে ছেলেটার শরীরে ছড়িয়ে পরে, আর ছেলেটা তার সারা শরীর নির্মমভাবে চুলকাতে থাকে, তার লুঙ্গির গিঁট খুলে গিয়ে উদোম হয়ে পরে সে, তার উরুসন্ধি থেকে সাহসী তর্জনীর মত দাঁড়িয়ে যাওয়া অঙ্গটি বিলকিসবানুকে কিছুটা সম্মোহিত করে। বিলকিস তার মরা বাপের কসম খেয়ে বলতে পারে কোন রকম কামনা থেকে নয়, কেবল ধানের চারার সবুজ ঊর্ধ্বমুখী বিস্তার, সবুজে বেড়ে উঠা কোন প্রানকে যে কামহীন তাড়নায় তাড়িত করে, সেরকম অনুভূতি থেকে সে সেটা স্পর্শ করে। আর গতকালকে থেকে অদ্ভুত ঘোর লাগা গন্ধ, যা কিনা বদ্ধ গোলাঘরের শস্য আর ইঁদুরের মলের ঝাঁঝালো গন্ধের মত তীব্র, তা বিলকিসের রক্তজুড়ে ভেসে বেড়াতে থাকে । গতরাতে শাহীনের ইচ্ছুক শরীর থেকে সন্তর্পণে বাঁচিয়ে রেখে আজো বেশ সেই মাদকতা পোহাচ্ছিল বিলকিস । কিন্তু জড়বুদ্ধি ছেলেটার মৃত্যু সেই গন্ধটাকে পরিবর্তিত করে দিল, তার শরীরে যেন মৃত্যুর সমস্ত ওজন সওয়ার হয়েছে । তার মাথা টনটন করে উঠে , সে ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে শুয়ে পরে।
পারভীনের বিলাপ থামে, ছেলের লাশ কবরের দিকে রওয়ানা হলে, তার শরীর জুড়ে নেমে আসে অবসাদ, সারাদিন বলতে গেলে না খাওয়া। পারভীন এতোক্ষন যে বিলাপ করেছে তা যতটা না শোকের তার অধিক ক্রোধের। তার বিলাপের ছত্রে ছত্রে বহু অভিযোগ উচ্চারিত হয়, তার শুকনো চোখে শূন্যতা ভর করে। এবং সন্ধ্যা নামলে জমায়েত পাতলা হতে হতে একসময় পারভীন একা হয়ে যায় । পারভীন ঘরে খাবার খোঁজে, তার জড়বুদ্ধি ছেলেটার রাক্ষুসে ক্ষুধার জন্য ঘরের ছাদে বাঁধা একটা হাড়িতে পারভীন ছাতু রেখে দিত, ওটা শুধুই ঐ ছেলেটার জন্য, অনেক ক্ষুধায়ও পারভীন কখনো সেই হাড়ি থেকে নিজের জন্য খাবার নেয়নি, কিংবা জয়নালকেও তা নিতে দেয়নি। একটা প্লাস্টিকের বাটিতে ছাতু ভিজিয়ে লবন মাখিয়ে সে যখন মুখে দেয়, তখন তার চোখ উপচে পানি ভরে উঠে, খুব নীরব কান্না তার গাল ভাসিয়ে দেয় ।
অনেকরাতে শাহীন ঘরে ফিরলে বিলকিস তার শরীরে নিজেকে ঘষে ঘষে সাফ করে তার শরীরে জেঁকে বসা মৃত-গন্ধের নিশানা ।