১
আমি ব্যস্ত ছিলাম। আমার স্ত্রী কি যেন নিয়ে ফোনে খুব চেঁচামেচি করছিলেন । খুব সম্ভবত আমার জাতীয় সাহিত্য পুরস্কার পাওয়া নিয়ে আমার ঘনিষ্ঠ মহলে একথা ওকথা শোনা যাচ্ছিল । আমার স্ত্রী দশভুজা দুর্গা , সে আর তরুণ ভক্তরা বেশ দাপিয়ে বেরাচ্ছিল। আমার এসবে নাক গলানো একদম মানা । স্ট্রোক হয়েছিল , কদিন আগেই । আমি খবরের কাগজ ওলটাচ্ছিলাম । সেসময় ফারুক আব্দুল্লাহর ফোন পেলাম , আমার ফোন সবসময় সাউন্ড অফ থাকে, আমি ফোনটা দেখতে পাচ্ছিলাম না একদম । কিন্তু খবরের কাগজের একটা অংশ কখনো আলোকিত হচ্ছিল কখনো নিভে যাচ্ছিল ।
আমার ঘরটা একটু অন্ধকার অন্ধকার , কৃত্রিম আলো ছাড়া, স্বাভাবিক আলোতে আমার ঘরটা কেমন জানি ধূসর লাগে ।
আমি এইঘরটাতে বন্দী করে ফেলেছি নিজেকে । মাঝে মাঝে বুড়ো কবিদের কেউ মারাটারা গেলে কাঁদুনে গেয়ে এলিজি লিখি । বেশ চলে যায় । যদিও শরীরটা মোটেই ভালো নেই । শীলার রিনরিনে কণ্ঠ আমাকে খুব বিদ্রোহী বানিয়ে দিল , আমার মনে হল শীলা খুব সুখী । শীলা ইচ্ছে করে আমার ঘরে ভারী পর্দা দিয়ে আমার পৃথিবীটা অন্ধকার করে রেখেছে, যদিও আমি খুব করে জানি শীলা ছাড়া আমি একদিনও চলতে পারবোনা । তাই টপ করে ফোনটা ধরে ফেললাম । আমাকে ফোন ধরতে ডাক্তার নিষেধ করে দিয়েছে । ফোনে আমার বোনের ছেলেটার মরে যাবার খবর পেয়েই না আমার চোখে আর শ্বাসযন্ত্রে তীব্র অন্ধকার ঝলসালো । হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার সময় ডাক্তার বলে দিলেন "উত্তেজনা থেকে সাবধান"। শীলা আমার ঘরে ভারী পর্দাগুলো লাগাতে লাগাতে জানিয়ে দিল "আর মেয়ে ভক্তগুলোর মাথা খেয়োনা, উত্তেজনা মোটেই ভালো নয় তোমার জন্য"
আমি বললাম "শীলা , তুমি পাণ্ডু আর মাদ্রীর গল্পটা জানো তো?, তোমার থেকে উত্তেজক আর কি হতে পারে" । শীলার গালদুটো উত্তাপ ছড়িয়েছিল, আর হয়ে উঠেছিল লাল ।
তো শেষকথা , আমি ফোনটা ধরেছিলাম । এতো কিছু বলার কারণ হল , ফারুক আব্দুল্লাহ , যে কিনা এতো কিছু লিখতোনা বলে আমরা তাকে কখনোই লেখক মানিনি, সেই ফারুক আব্দুল্লাহকে যে এককথায় বাড়িতে আসতে বলে দিলাম , তার কারণ হয়তো শীলার ওপর রাগ থেকে , কিংবা অভিমান থেকে ।
শীলার সাথে ফারুক আব্দুল্লাহর একদা খুব ঝগড়া ছিল । ছোটবেলা থেকে বাপের বাড়িতে "সাহিত্যচর্চার"গুণে , শীলার সাহিত্যচর্চা ছিল বনেদী গোছের । এই বোধ থেকেই কিনা , সে ফারুক আব্দুল্লাহকে তার বাক্যবিন্যাস নিয়ে কিছু একটা বলেছিল । ফারুক আব্দুল্লাহ মোটেই ভালমানুষ গোছের কেউ ছিলনা
সে বলেছিল "দ্যাখেন, আমি ঐসব ক্রিয়েটিভ রাইটিং পড়ে লিখতে বসিনি , পাঠকদের যদি খুব আরাম দরকার হয়, তেনারা অন্যত্র যাক "। শীলা খুব চৌকস মেয়ে , কিন্তু কি জানি , হয়তো মুখের ওপর এভাবে কেউ কিছু বলে দেবে , সে সেটা মেনে নিতে পারেনি । কিংবা এমনও হতে পারে সে খুব আকর্ষণবোধ করেছিল , তাই সে পরে ফারুক আব্দুল্লাহর সাথে কথা বলেছিল । অসভ্য ছেলেটা নাকি তাকে বলেছিল "দ্যাখেন শীলা, আমার লেখা আপনার কখনোই ভালো লাগবেনা, আপনার সাহিত্যবোধ আমার কাছে বরাবরই ছিঁচকাঁদুনে , তুলতুলে তাই হাস্যকর, আপনি আমার লেখা পছন্দ করেন সেটাও আমি চাইনা , কিন্তু আমরা একসাথে শুতে পারি "
এ ব্যাপার নিয়ে শীলা আর তার বেশ কয়েকজন বান্ধবী মিলে বেশ "পুরুষতান্ত্রিকতা" , "চরিত্রহীনতা" চারপাশ বেশ সরগরম করে ফেলেছিল । আমি তখন শীলাকেও তেমন চিনতাম না , ফারুক আব্দুল্লাহকে বেশ চিনতাম । এবং কেন যেন ওকে আমার খুব ভালো লাগতো । ফারুক আব্দুল্লাহর ভেতরে অস্থিরতা ছিল , যেটা ছিল সংক্রামক । আমি আর ফারুক আব্দুল্লাহ মিলে কি যেন নামের একটা সাহিত্য পত্রিকা বের করার চিন্তা করেছিলাম । ওটা করা হয়নি আর । ও উধাও হয়ে গেল হটাৎ , "হারিয়ে" যাওয়া ব্যাপারটা জীবনে এতো দেখে ফেলেছি তার আগে । তাই ফারুক আব্দুল্লাহর কণ্ঠ যখন বললো "আসিফ ভাই, ফারুক আব্দুল্লাহ বলছিলাম , চিনতে পারছেন ?" সেইসময় আমি আসলেই অনুভব করলাম , ফারুক আব্দুল্লাহ হারিয়ে গিয়েছিল ।
শীলার ওপর অভিমান থেকেই হোক , আর হারানো কিছু ফিরে এলে কেমন হয় এটা দেখবার খায়েশ থেকেই হোক , আমি সরাসরি ফারুক আব্দুল্লাহকে বাড়িতে আসতে বলে দিলাম ।
শীলার ততক্ষণে ফোনে কথা বলা শেষ , ও আমার ঘরে এসে জানাল "মামুন ভাইটা কি হিংসুক, দেখেছ , তোমার পুরস্কার পাওয়া নিয়ে একগাদা আজেবাজে লিখেছে , অথচ দ্যাখো ওনার ডিভোর্সের পর তুমি আমি ওকে কতভাবে হেল্প করেছিলাম ", অন্য যেকোন সময় হলে, চৌধুরী মামুনের এসব যে পাক্কা নিমকহারামী সেই বিষয়ে আমিও শীলার ধারণাকে পোক্ত করার মত তথ্যবহুল সমর্থন দিতাম , কিন্তু আমি বললাম "হেল্প করেছি বলে তো মাথা কিনে নেইনি", শীলা এমত উত্তর আমার কাছে পেয়ে অভ্যস্ত নয় । সে খানিকটা বিচলিত হয়ে পরেছিল, আমি তখনই জানালাম "ফারুক আব্দুল্লাহ সন্ধ্যাবেলা আসবে"। শীলা আমাকে বলল "ও কি একা আসবে ?"
আমি এবার অপ্রস্তত হয়ে পড়লাম , জানালাম "জানি না তো"
শীলা ঘর থেকে যাবার পর, আমার মধ্যবয়সী সচেতনতাবোধ ফিরে এলো , আমি ভাবলাম, ফারুক আব্দুল্লাহ কি আমার কাছে টাকা ধার চাইবে ? কিংবা কোন পত্রিকা অফিসে কোন চাকরি ? কিংবা ও কি জানে শীলা এখন আমার বউ ? অথবা শীলা আমার বউ জেনেই ও আসছে ?
আমি ফারুক আব্দুল্লাহকে খুব ভালো করে ভেবে দেখলাম , ভেবে দেখলাম এই মধ্যবিত্ত ধান্দাগুলো ওর রপ্ত হয়নি বলেই ও হারিয়ে গিয়েছিল । একদিন আড্ডা দিতে দিতে ও বলেছিল
"আসিফ ভাই বুঝলেন, আমি মাঝে মাঝে একটা দুঃস্বপ্ন দেখি। দেখি এক সুন্দরী মেয়ে একটা জন্মদিনের কেক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, আমাকে বলছে , একটা সর্ট করে সুন্দর কিছু লিখে দাওনা" , বুঝলেন, লেখককূলের এইরকম দিন চলে আসছে , বিশেষত কবিদের, পারিবারিক বিউটিশিয়ান, ডাক্তারের মত একজন পারিবারিক কবিও থাকবে । ও ওখানে বসে থাকা চৌধুরী মামুনকে উদ্দেশ্য করেই বলেছিল। মামুনের শ্বশুর ছিল কোন এক সাহিত্যপত্রিকার সম্পাদক , আর ওর সেজো শ্যালিকা ছিল ফারুক আব্দুল্লাহর প্রেমিকা , মামুনের মত "প্রেমের" কবিতা কেন ফারুক আব্দুল্লাহ লেখেনা , এরকম অভিযোগ করেছিল বলেই , মামুনের শ্যালিকার সাথে তার সম্পর্কটা চুকে গিয়েছিল । আহা , এই মামুনের প্রেমের কবিতার জন্য আমিই কি কম ঝামেলা পোহালাম ? শীলা প্রথম রাতেই আমাকে বলেছিল "তোমরা কেউই মামুন ভাইয়ের মত লিখতে পারোনা"।
আমি স্মৃতি পোহাতে পোহাতে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম , পর্দাগুলো সরিয়ে দিলাম
বিকেলকে সন্ধ্যায় গড়াতে দিলাম,
আর অনুভব করলাম , সন্ধ্যা কিভাবে পেয়ে বসেছে আজকাল ।
২
এর মাঝে ফারুক আব্দুল্লাহ আর একবার ফোন করে, বলে "আসিফ ভাই, চৌধুরী মামুন দেখা করতে বলছে, সাড়ে সাতটার দিকে আপনার বাসায় আসি?এমন নির্মল বিনোদন কি মিস করা উচিৎ হবে? " আমি হাসি, বলি "তুমি তোমার মত সময় নাও, আমার কোন তাড়া নাই, শীলাও বাড়িতে আছে"
ওপাশে সেকেন্ড খানেক নীরবতা
তারপর ও বলল "শীলার প্রিয় কবিতো এখন আপনি ?" আবার আমি হেসে ফেললাম, বললাম "তুমি আসতো, তারপর কথা হবে"
আমি অনেকদিন পর ঝরঝরে বোধ করতে লাগলাম ।
আমি আমার ঘর থেকে বের হলাম, শীলাকে দেখলাম ঘর গোছগাছ করছে।
শীলাকে বললাম "আমাকে একটা সিগারেট দিবে", শীলা সিগারেটের প্যাকেটটা এনে দিল, আর লাইটারটা
"তোমার ভালো লাগছে?" শীলা বলল ।
আমি খুব সংক্ষিপ্ত একটা মাথা নাড়লাম ।
শীলা আমার পাশে এসে বসলো । আমার ভীষণ কথা বলতে ইচ্ছে করছিল ।
"জানো শীলা, ফারুক আব্দুল্লাহ যে বয়েসে লেখালেখি ছেড়ে দেয়, ঐ বয়েস আসলে লেখক হবার জন্য যথেষ্ট নয়, কিন্তু ওর যে ক্ষমতাটা আমাকে মুগ্ধ করেছে বারবার, তা হচ্ছে একজন লেখককে খুব দ্রুত বুঝে নেবার একটা সহজাত প্রবণতা ছিল, হয়তো এখনো আছে "
শীলা খুব মন দিয়ে শুনছে, আমি ওর দিকে ভালো করে তাকালাম,
শীলা আসলেই অনেক সুন্দর, এখনো ।
আমি চোখে ঝাপসা অনুভব করলেও চশমার প্রয়োজন বোধ করছিলাম না ।
আমি আর শীলা পাশাপাশি বসে থাকলাম, হয়তো আমরা কথা বলছিলাম । সাড়ে তিনবছরের যোগাযোগের পর ১০ বছরের বিরতি , ফারুক আব্দুল্লাহকে পুনর্নির্মাণের একটা সুযোগ আমরা হাতছাড়া করিনা । কেবল ফারুক আব্দুল্লাহর সাথে আমার খুব বন্ধুত্ব অথবা শীলার পুরাতন "ইগো" প্রবলেমের জন্য নয়, আমাদের যাপিত জীবনের অনেক অনুচ্চারিত অথবা গায়ের জোরে এড়িয়ে যাওয়া সত্যগুলোর জন্য ফারুক আব্দুল্লাহ আমাদের গুমোটজীবনে একটা জানালা হিসেবে প্রতিভাত হয়।
এইযে সরকারী পদকটা নিয়েই যা যাচ্ছেতাই হল, আসলে দশবছর আগেও কি আমি, আসিফ ইমতিয়াজ এতো নোংরামি সহ্য করে এটা নিতে পারতো ? কিংবা শীলাও কি পারতো, কেবল এই পুরস্কারটার জন্য এমন কোমরবেঁধে ঝগড়া করতে ?
শীলা কি সন্তানের অভাববোধ করে খুব ? এজন্যই কি এতো ব্যস্ততার অভিনয় করে যায় ?
ফারুক আব্দুল্লাহর ফোন আমাকে কিংবা আমাদেরকে হটাৎ চারপাশের ঘটিত বাস্তবতার প্রতি অনাস্থা জানানোর সুযোগ করে দেয় ।
ফারুক আব্দুল্লাহর সবথেকে বড় বিশেষত্ব, সেসময়কার আড্ডায় যেটা তাকে সবসময় চিনিয়ে রাখতো তাহল বেয়াদবী করার অদ্ভূত শক্তি । ওর ঐ বেয়াদবীর পেছনে ওর নিজের একটা যুক্তি ছিল, ও বলতো "আসিফ ভাই, বলেন তো লোকে কবে সন্দেহ করতে শিখবে ঠিকঠাক?, দ্যাখেন শ্রদ্ধার নামে যে কালচার চলে আসছে, তা খুব নিম্নমানের পৌত্তলিকতা, একদম বিশ্রী, অমুক লেখক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, তাই তার কাছে পড়ি না পড়ি , তার লেখার কথা বলতে গেলেই মানুষজন যে কুঁজো হয়ে স্যার আউড়ায়, সেটারে আমার কাছে একদম মধ্যযুগীয় লাগে, আমি যে মাঝে মাঝে বেয়াদবি করি, এটা মনে রেখেই করি, ঐ ব্যক্তির ওপর আমার কোন রাগ থাকতে পারেনা , কিন্তু ওরা যে সংস্কৃতি চাপিয়ে দেয় সেটারে এই নৈরাজ্য ছাড়া আমি আর কোনভাবেই ডিফেন্ড করতে পারিনা "
আর ফারুক আব্দুল্লাহর ছিল হাই ডিপ্রেশন, ঐ সময়টা ও আড্ডায় আসতো না, আমাকে হয়তো জানাতো "আসিফ ভাই ডিপ্রেশনের সাইকেলটা শুরু হচ্ছে মনে হয়"। আমাদের সাড়ে তিনবছরের যোগাযোগে আমি ওকে এরকম "ডিপ্রেশন সাইকেল" ৬-৭ বার পার করতে দেখেছি
ও খুব খারাপ থাকতো সেসময়, খুব বিমর্ষ , লেখার জন্য খুব অস্থিরবোধ করতো, কিন্তু সে কিছুই লিখতে পারতোনা , আমি ওর কথা শুনতাম , ও বলে বলে হালকা হয়ে উঠতো ।
আর যখন, কোন একসকালে ও অনুভব করতো, বিষণ্ণতা আর নেই। অনেক দিন শরীরে জেঁকে বসা ব্যথার অভ্যস্ততা যেমন ব্যথাহীনতাকে সাব্যস্ত করে একধরণের "কি নেই, কি নেই" ধারণার, তেমন একটা সংবেদনে সে তার চলে যাওয়া বিষণ্ণতাকে স্মরণ করতো ।
এরকম একটা চক্র থেকে বের হয়ে, যখন সে একদিন আড্ডায় আসলো, তখন এক সম্পাদিকা, যিনি এনজিওকর্মী হিসেবে বেশ নাম করেছিলেন, তিনি তার কি সাহিত্যপত্রিকার জন্য লেখা খোঁজ করছিলেন, বোঝাচ্ছিলেন কে কবি , কে লেখক , কোন লেখক ভাইয়ের সাথে এই সম্পাদিকা বোনের বেশ ভালো সম্পর্ক । অথবা সাহিত্যচর্চা না করে, তিনি এনজিও করে সাহিত্যের কি বড় ক্ষতি করে ফেলেছিলেন, এসব আর কি । তখন ফারুক আব্দুল্লাহ সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে আমাকে বলল "আসিফ ভাই, এটা কেবল একটা দুর্বল পর্যবেক্ষণ, তারপরও আজকাল বিশ্বাস করি বুটিক কিংবা পার্লারের ব্যবসা করা মহিলাদের অনেক বড় একটা অংশকে মনে হয়, আনস্যাটিসফাইড, ইদানীং সাহিত্যজগতেও এঁদের অনুপ্রবেশ ঘটছে "
ফারুক আব্দুল্লাহ , যার লেখা কখনোই সম্পূর্ণ হয়ে উঠেনি, কিন্তু সে নিজেই হয়ে ওঠতে চেয়েছিল গল্পের চরিত্রগুলোর মত আনপ্রেডিক্টেবল ।
ইন্টারকমে গেট থেকে জানালো ফারুক আব্দুল্লাহ বলে একজন এসেছে,
আমি আর শীলা আমাদের দরজাটার সামনে দাঁড়ালাম ।
৩
আমাদের ভেতর কোন উচ্ছ্বাস কাজ করেনা । বরং ফারুক আব্দুল্লাহর হাত ধরে পরীর মত ফুটফুটে ৬-৭ বছরের মেয়েটি আমাদের মুগ্ধ করে রাখে ।আমি এতো স্বচ্ছ চোখ আর কখনো দেখিনি।আমাদের সাথে দৃষ্টি বিনিময় হলে সে তার ছোট্ট মাথাটা নাড়ায়। তার ছোট্ট ঠোঁট আর চিবুক কথায় ঝলমল করছে । মেয়েটার ছোট্ট কাঁধ ধরে কিছুটা ঝুঁকে পরে, জিজ্ঞেস করে “কি নাম তোমার? ”
ফারুক আব্দুল্লাহ বলে “ও কথা বলেনা, ও আঁকে”
যেন কথা বলার বিকল্প আঁকা, এমন সরল বিশ্বাসে ফারুক আব্দুল্লাহ বলে। শীলার জন্য ও একটু বিস্তারিত করলো “এটা আমার মা, ও কথা বলতে পারেনা,”
আমরা আমাদের বসার ঘরে বসি ।
আমি ফারুক আব্দুল্লাহকে লক্ষ্য করি, ওর ভঙ্গীতে একটা আরোপ দেখতে পাই, যেন ও খুব পরিচিত হাসিতে খেয়ে দেবে দশবছর। আমি ওকে হয়তো একটু পরাজিত দেখতে চাইছিলাম , একটু রিক্তও কি? একারনে নয় যে আমি ফারুক আব্দুল্লাহকে কোনভাবে অপছন্দ করি, বরং ব্যাপারটা উল্টো। আমি ওকে খুব পছন্দ করি।
আমি তো কেবল কচ্ছপ-খরগোশ নীতিগল্পের কচ্ছপের শিরোপাটা আর একটু উজ্জ্বল চেয়েছি। আমি হারিয়ে যাইনি। এই জীবনে কতটা আর দেখেছ তুমি, ফারুক আব্দুল্লাহ? যেন ঘুমিয়ে পড়া খরগোশ, আলস্যভরা চোখ, যেখানে পিচুটির মত জমে আছে স্বপ্ন।আমার গন্তব্য খুব অনুত্তেজক,ওর মত বরং হারিয়ে যাওয়াই ভালো ছিল, আমি অনুভব করি। ফারুক আব্দুল্লাহর বয়স বাড়েনি একদম, চোখের নিচে কালি পড়েছে যদিও,তবে ওটা মনে হয় ভ্রমণ ক্লান্তিজনিত।
সোফায় কিছুটা তেরছা ভাবে বসে, ওর পাশে আলোর মত বোবা মেয়েটি তার ছোট্ট আঙ্গুলগুলো ধরে বুনে যাচ্ছে কথা। আর ফারুক আব্দুল্লাহ তার দিকে তাকালে তাদের চারটা চোখের মধ্যে হয়ে যেতে থাকে অসংখ্য ভাবের কারবার। আমি আর শীলা আমাদের ভাব সংকটে বিব্রত হই, বাচ্চাটার ভেতরে এতো জীবন আমাদের সম্মোহিত করে, আমরা তাকিয়ে থাকি। এইসময় ফারুক আব্দুল্লাহ তার পিঠে বয়ে আনা ব্যাক-প্যাকটা খোলে, ওটার বাইরের পকেট থেকে একটা চশমার খাপ, যেখানে লেখা “নাহার অপটিকস”, ওটা খোলে, এবং চশমাটা পরে। আর ওর মেয়েটা ওর দিকে তাকিয়ে ঠোঁট টিপে হাসে, যেই হাসিটা আমাদের ভেতর সংক্রমিত হয়, আমরা আস্থা ফিরে পাই।আমি শীলার দিকে তাকালে দেখি তার চোখেও স্বস্তি। কেননা কিছুক্ষণ আগেও আমরা ফারুক আব্দুল্লাহকে লক্ষ্য করেছি, যেন তার ওপর দিয়ে মাঝের দশটা বছর যাই নাই, বয়স বলতে পরিপক্ক-গুণ, যেটা চামড়া, অস্থি ভেদ করে সেঁধিয়ে যায় ভেতরে, তা যেন তার ত্বক ভেদ করে নাই মোটেও । কিন্তু তার চোখের নির্ভরতা আমাদের জানাল, ফারুক আব্দুল্লাহকেও বয়স ছুঁয়েছে।
এতক্ষণে মেয়েটার সাথে শীলার বেশ বন্ধুত্ব হয়। আমি জিজ্ঞেস করি “তারপর, অনেক দিন, তাইনা ? কি করলে এতোদিন?”
ফারুক আব্দুল্লাহ যেন এই প্রশ্নটার জন্যই অপেক্ষা করছিল।
ও বলতে শুরু করে, আমরা জানতে পারি সে বছর আটেক দেশের বাইরে ছিল,বছর দুয়েক হল ফিরেছে। তার মেয়েটা পোষ্য।
এখন সে তার বাপমায়ের রেখে যাওয়া বাড়িতে তার মেয়েটাকে নিয়ে থাকে।
তো এখন মেয়েটার জন্য একটা ভালো স্কুল সে খুঁজছে, বোর্ডিং স্কুল মত। একটা স্কুলে কথা হয়েছে, হয়তো আগামী মাসে তার আবার আসতে হতে পারে ।
আমাদের লেখালেখি নিয়ে কথা হয়
আমার কবিতাগুলোর ও এখনো মনযোগী পাঠক। আমার ভালো লাগে । ও ওর হারিয়ে যাওয়ার গল্প বলতে থাকে। “আসিফ ভাই, বুঝলেন, আমি যখন চলে যাচ্ছিলাম, বেশ লাগছিল, ভাবছিলাম ফিরে আসবো, ঐযে বুয়েন্দিয়া বাড়ির বড় ছেলেটার মত, কৈশোরে জিপসিদের দলে মিশে গিয়ে সারাদুনিয়া ভ্রমণ করে আবার ফিরেছিল, সরাইখানায় উল্কি আঁকা শরীর নিলামে তুলেছিল। সত্য বলতে কি আমার হারিয়ে যাওয়া ছাড়া কোন উপায় ছিলনা, আমার জীবন যাপনের ভেতরে ঢুকে পরেছিল ক্লান্তি, আমাকে উদ্দীপ্ত করার মত বিষয়ের অভাব হচ্ছিল, কিংবা আমার ভেতরে জমে যাচ্ছিল সমস্ত স্পৃহা, আমি যেমন বলতে চেয়েছি তা যেন ধ্বনি বিপর্যয় কিংবা প্রচলিত ভাষার অন্তস্থ সীমাবদ্ধতার কারণে ভুল উচ্চারিত হয়েছে, ভুল অনূদিত, ভুল শ্রুত হয়েছে। তবে আমার চলে যাওয়াটা সুখকর হয়নি, বিদেশে যতদিন ছিলাম, আমার নিজেকে বহিষ্কৃত মনে হয়েছে, কখনো এমনও মনে হয়েছে আমার বাক্যবিন্যাস নিয়ে প্রশ্ন করা সেই পাঠিকার মুখের ওপর অমন বেহুদা ঔদ্ধত্য, আমার বিশাল অন্যায় হয়ে গেছে, যেন কোলরিজের বুড়ো নাবিকটার মত আমিও মেরে ফেলেছি আমার সৌভাগ্যের অ্যালবেট্রস, কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে আমি পাঠক প্রিয়তাকে আমার গন্তব্য মানতে পারিনি , আমি পাঠকের চোখে যন্ত্রণা দিতে চেয়েছি, আমি চেয়েছি পাঠক যেন হোঁচট খায়, আমার হৃদয় নিঙড়ানো উচ্চারণ , চিত্র ও দৃশ্যকল্প কেউ আলগোছে শুনে নেবে, আয়েসি ভঙ্গিতে গিলে নেবে, আমি মানতে পারিনি, কিন্তু আমি আমার মত করে লিখতে পারিনি একটা লাইনও, দেশে ফিরে, যখন আমার দেখা হয় এই শিশুটির সাথে, যে নিয়ত বলে যাচ্ছে, যদিও ভাষার শাব্দিক লেনদেনে নয়, আরো গভীর, আরো মোহময়, আরো বিস্তারিত কোন ফর্মে ও বেঁধে ফেলেছে ওর প্রকাশকে, এবং প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে কালি-কলম আমার কাছে ধরা পরেছে ইনএফিসিয়েন্ট হিসেবে”
শীলা ওঠে, ওর রান্নাঘরের কাজ দেখতে, ওর হাতধরে ওঠে ফারুক আব্দুল্লাহর মেয়েটা।
আমি ফারুক আব্দুল্লাহকে আবার লক্ষ্য করি, বুঝতে পারি ও অনেকদিন এভাবে এতো কথা বলেনি, ওর হাঁপানো অনুভব করি, আমি ওঠে ওর কাছে যাই, ওর কাঁধে হাত রাখি।
ও আমার দিকে তাকালে, আমি দেখতে পাই তার চোখের নিচে গভীর কালি, কপালের শিরা দপদপ করে লাফাচ্ছে, যেন ওর হৃৎপিণ্ডটা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খণ্ডে ছিটকে পরেছে, শিরায় উপশিরায়। আমি আমার নিজেকে কথা বলতে দেখি, কিংবা শুনতে পাই আমার কণ্ঠ, যেটা বলছে “তুমি ঠিক আছোতো, ভালো আছো, ফারুক আব্দুল্লাহ”।
যেই মুখোশ ফারুক আব্দুল্লাহ এতক্ষন সেঁটে রেখেছিল, তা আলগা হয়ে যেতে দেখি।
ফারুক আব্দুল্লাহ ফিসফিস করে বলে
”আসিফ ভাই আমি মারা যাচ্ছি”
তার উচ্চারণের ভেতর এমন কিছু একটা ছিল, যেটার ভেতর ছিল একটা অনিবার্যতা, আমি বিস্তারিত জানতে চাইনা, আমার হাঁটু টনটন করে, আমি ওর পাশে বসে পড়ি, বলি
”আর একটু বেঁচে থাকা যায়না?”
সে খুব কাতর স্বরে বলে “আমিও খুব চাইছি বেঁচে থাকতে”
আমরা চুপচাপ বসে থাকি, এবং আমিও অনুভব করি, আমাদের দুজনের নীরবতা, বহু কথা হয়ে আমাদের চোখে রং ছড়াচ্ছে।
এরপর শীলা আসে, আমরা রাতের খাবার খাই, অনেক গল্প করি, আমাদের বন্ধুদের গল্প হয়, আমাদের শত্রুদের গল্প হয় ।
ওকে যখন রাতের ট্রেনে তুলে দিতে যাই, আমি আর শীলা, ততক্ষণে ফারুক আব্দুল্লাহর মেয়েটা তার কোলে ঘুমিয়ে পরেছে । গাড়িতে বসে ফারুক আব্দুল্লাহ তার ব্যাগটা খোলে । একটা পাণ্ডুলিপি মত কাগজের স্তূপ বের করে, শীলার হাতে দেয়। জানায়, সে শীলার ভালো লাগবার মতো কিছু লিখতে চেয়েছে, ও খুব হালকা ভাবে কথাটা বলার চেষ্টা করে, আমার চোখের দিকে তাকায়, খুব বোঝার চেষ্টা করে আমি বিব্রত হচ্ছি কিনা। আমি মোটেই বিব্রত হচ্ছিলাম না, এটা বোঝানোর জন্যই আমি কথা বলি, যদিও সেসময় নীরবতা আমার ভালো লাগছিল ।
আমি শীলাকে বলি “আমি ঠিক বুঝে ওঠে পারতাম না, আমাদের আড্ডার মেয়েগুলো ফারুক আব্দুল্লাহকে অমত নারী-বিদ্বেষী ভাবতো কেন, বুঝেলে শীলা, আমাদের ফারুক আব্দুল্লাহ কিন্তু মস্ত প্রেমিকও ”
ফারুক আব্দুল্লাহ হাসে, তার চোখগুলোও হাসে, তার ঠোঁটগুলো খুশি হয়ে ওঠে। সে জানায়, “আমিই পৃথিবীর সর্বশেষ প্রেমিক”
ওর ট্রেন চলে যাবার পর, আমি আর শীলা যখন ফিরছি । বেশ রাত তখন, শীলা গাড়ির অন্ধকার দিকটায়, আমার মুখে এসে পড়ছে ল্যাম্পপোস্টের আলো । কিন্তু আমাদের ভেতর অনেক যোগাযোগ হয়, হয়ে যায় অনেক কথা, যদিও তা উচ্চারিত হয়না । শীলার কোলে পরে থাকা কাগজগুলো দেখে, আমি অনুভব করি, কি তীব্র যন্ত্রণায় ফারুক আব্দুল্লাহ লিখে গেছে এসব, দারুণ বিষন্নতা, আর রক্তে অসুখের প্রবাহ নিয়ে, ফারুক আব্দুল্লাহ তার সৌভাগ্যের অ্যালবেট্রসকে যেন ফিরিয়ে আনতে চেয়েছে।
আমার অর্ফিয়ুসের কথা মনে পড়ে যায় ।
আর আঙুলগুলো টনটন করে উঠে , যেমন উঠতো একটা দারুণ প্রেমের কবিতা লেখবার আগে ।