
যে কোনো কারণেই হোক গতকাল খুব আপসেট ছিলাম। ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দিছিলাম “শালার দুনিয়া তফাৎ যা!” যেদিকে দু’চোখ যায় সেদিকে চলে যাব এই চিন্তা মাথায় নিয়ে হাঁটা দিয়ে দেখি সাবকনশাস মাইন্ডে প্রতিদিনের হাঁটা পথ ধরে স্টেশনে চলে আসছি। একটু পরেই একটা ট্রেন যাবে সেন্ট্রালের দিকে। টিকেট কেটে সেই ট্রেনে চেপে বসলাম। সার্ক্যুলার কিউ তে নেমে গেলাম কী মনে করে। সার্ক্যুলার কিউ স্টেশানটা আমার সিডনীতে অন্যতম প্রিয় জায়গা। স্টেশানটা দুই/তিন তলার উপর। গ্যালারির মত কাঁচ দিয়ে ঘেরা। ওপাশে একইসাথে হারবার ব্রীজ আর অপেরা হাউজ। নীচে ফেরি-স্টেশানে ফেরিরা আসছে যাচ্ছে, ঘাটে ভিড়ছে, মানুষ নামছে উঠছে। অনেক্ষন চুপচাপ রেলিং ঘেষে বেঞ্চে বসে ছিলাম। রাত হলে ঘরে ফিরছি।
আজকে দুই দুইটা ক্লাস। কোনো প্রিপারেশান নাই। মন আরো খারাপ। আল্লাহই জানে কী ক্লাস নিব।… ট্রেনে আসতে আসতে ক্লাসের বিষয়ে চোখ বুলালাম, ‘রেইস এন্ড এথনিসিটি’। লেকচার, স্লাইডস আর থিউরিটিক্যাল বিষয়গুলোতে চোখ বুলাতে বুলাতে যখন ক্লাস রুমের দরজায় এসে দাঁড়াইছি তখনো জানিনা কী ক্লাস নিব। অন্য অনেক টিউটরের মত ফাঁকিবাজি ক্লাস নেয়া যায়। স্টুডেন্টদেরকে ডিসকাশনে লাগায়ে দিলেই পনের/বিশ মিনিট চলে যাবে। মাঝখানে পনের বিশ মিনিট ইন্ডিভিজ্যুয়াল ডিসকাশন, গ্রুপ ডিসকাশনে কী কথাবার্তা হইছে, লেকচার থেকে কী শিখছে, টেক্সট বুকে কী বলছে… বাকী পনের বিশ মিনিট আমার যা বলার বলা। কিন্তু কেন যেন অনেকবার চিন্তা করেও ফাঁকিবাজি ক্লাস নিতে পারি নাই এর আগেও। অচেনা একটা দায়িত্ববোধের চাপে ভুগি। নিজের কাছেই বিরক্ত লাগে জেনেটিক্যালি বাপ-মা থেকে পাওয়া এইসব আব জাব আদর্শিক চিন্তা ভাবনার জন্যে। অথচ চেষ্টা করেও পারিনা এড়ায়ে যেতে।
ক্লাসের দরজা পার হয়ে সাদা বোর্ডটার উপরে বড় বড় করে ‘রেইস এন্ড এথনিসিটী’ লিখতে লিখতে টের পেলাম গত দুইদিনের প্রচন্ড মন খারাপ করা মেয়েটা আমার ভিতর থেকে আস্তে আস্তে বের হয়ে হেঁটে দরজা দিয়ে চলে যাচ্ছে। উলটো সাদা বোর্ডের উপর নীল কালিতে লেখা শব্দ দু’টো আমার ভিতর ঢুকে যাচ্ছে। রেইস থেকে রেসিজম আর এথনিসিটি থেকে এথনো-সেন্ট্রিজম, কী ভীষন শক্তিশালী দুইটা শব্দ! ইহুদীদেরকে হলোকাষ্টের সময়, বাংলাদেশে একাত্তুরে, রুয়ান্ডায় চুরানব্বই সালে, সুদানের দারফুরে দুইহাজার তিনে, চীনে উইঘুর মুসলিমদেরকে গতবছরে, শ্রীলংকায় তামিলদেরকে এইত’ ক’মাস আগে, প্যালেস্টাইনে স্লো মোশন জেনোসাইড এখনো প্রতিদিন…… এইসব কিছুর সাথেই তো শব্দ দুইটা লেপ্টালেপ্টি করে লেগে আছে!
টেক্সট বুকে লিখা “যখন নির্দিষ্ট কোনো গ্রুপের মধ্যে তাদের ‘এথনিক কনশাসনেস’ প্রচন্ড শক্তিশালী হতে থাকে তখন তা এক পর্যায়ে এথনো-সেন্ট্রিজমে পরিণত হয়, যার কারণে ঐ নির্দিষ্ট গ্রুপ তাদের টার্গেট গ্রুপের চেয়ে নিজেদেরকে সুপেরিয়র হিসেবে গন্য করে”।…… একটা শব্দ খুব বড় করে আমার চোখের সামনে লেগে থাকে ‘ডি-হিউম্যানাইজেশান’- টার্গেট গ্রুপকে ধ্বংস করার প্রথম প্রক্রিয়া ঐ গ্রুপকে সাধারণ মানুষের চোখে আস্তে আস্তে খারাপ করে তোলা। যেভাবে ইহুদীদেরকে মিডিয়ায় ধীরে ধীরে এমনভাবে তুলে ধরা হয়েছিল, “ওরা মানুষ না, ওরা ইহুদী”! ঠিক যেমনটা এখন আস্তে আস্তে মুসলিমদেরকে বানানো হচ্ছে, “ওরা মানুষ না, ওরা টেররিষ্ট”!
কখন পুরো ক্লাস চুপ হয়ে এসেছে, কখন কথা বলা শুরু করেছি, কখন স্টুডেন্টরা একের পর এক প্রশ্ন করতে শুরু করেছে খেয়াল করিনি।বেলজিয়াম এথনো-সেন্ট্রিক অবসেশানে ডুবে গিয়ে নেকাব নিষিদ্ধ করেছে। আজকেই মাত্র ফ্রান্সও নেকাব নিষিদ্ধ করার জন্যে ভোট দিয়েছে।… অস্ট্রেলিয়ায় একজন সিনেটর অলরেডী নেকাব ব্যান করার কথা মিডিয়ায় বলেছেন।… ক্লাসের এক স্টুডেন্টের গলায় ঝুলানো ক্রুস-চেইনটা দেখিয়ে বলি, তোমার গলার ঐ ক্রুস সাইন যেমন বলছে তুমি তোমার ধর্মকে ভালবাসো, আমার মাথার স্কার্ফটাও সেই একই কথা বলছে। তোমার কেমন লাগবে যদি কালকে তোমার এই ক্রুস সাইনের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়?... ওরা ভাবতে থাকে! ওরা কথা বলে, ওরা প্রশ্ন করে, ওদেরই আরেকজন উত্তর দেয়। আমি ওদেরকে গত বছর সেপ্টেবারের এগার তারিখ রাতে ট্রেইন স্টেশানে সব মানুষের সামনে আমাকে এক অজি’র গালি দেয়ার কথা বলি, বলি কীভাবে অপমানে কাঁদতে কাঁদতে ঘরে ফিরেছিলাম।… পুরো ক্লাস লজ্জায় গুটিয়ে যায়। এক অজি’র অপরাধে যেন ওরাও অপরাধী।
আমি বলি এই রেইস আর এথনিসিটি যখন প্রধান হয়ে উঠে, তখন মানুবতা কীভাবে কেঁদে উঠে!... কথা বলতে বলতেই খেয়াল হলো অনেক আগের তিনটা শর্ট ডকুমেন্টারী আছে ল্যাপটপে। একটা হলোকাষ্টের উপর, কনসানট্রেশান ক্যাম্পে স্তুপ করে রাখা লাশের ছবি, চোখের সামনে ইহুদী একটা ছোট্ট ছেলেকে গুলি করে মেরে ফেলার দৃশ্য, শত শত ক্ষুধার্ত মানুষের কাঁটা তারের ওপাশে দাঁড়ায়ে করুণ দৃষ্টিতে তাকায়ে থাকার দৃশ্য… আরেকটা প্যালেস্টাইনের ক্যাম্প শাতিলার উপর, যেখানে ইহুদীরা-যারা নিজেরা একসময় ভিকটিম ছিল-তাদের হাতে পাখির মত মরেছে মুসলিমরা। রাতের আঁধারে পুরো ক্যাম্প ঘিরে ফেলে নির্বিচারে মেরেছে শিশু, নারী, বৃদ্ধ, যুবক সবাইকে!...... আমার সাথে সাথে পুরো ক্লাস স্তব্ধ হয়ে অনুভব করে, যে আজকের ভিকটিম সেই নিজের ইতিহাস ভুলে গিয়ে নিজেই কীভাবে আগামীতে খুনী হয়ে উঠে! … আরেকটা বাংলাদেশের একাত্তুরের উপর। যুদ্ধের সময় পাকিদের হাতে খুন হওয়া লাশ ভাসছে পানিতে। জ্বলছে গ্রাম। মানুষ খালি পায়ে বাচ্চা হাতে, কোলে উর্দ্ধশ্বাসে দৌঁড়াচ্ছে বর্ডারের দিকে বাঁচার আশায়, রাস্তায় পড়ে আছে লাশের পর লাশ…
ক্লাসের মধ্যে কে যেন স-শব্দে কেঁদে উঠে মুখ চাপা দিল। প্রজেক্টারে স্ক্রিন ভাল করে দেখা যাওয়ার জন্যে ক্লাসের লাইট সব বন্ধ। স্ক্রিনের আবছা নীল আলোয় আধো-অন্ধকার ক্লাসে আমি ঠিক বুঝতে পারিনা এইমাত্র কে কেঁদে উঠলো। হাতে আর মাত্র সাত মিনিট ক্লাস শেষ হতে, খেয়াল হলো মারওয়া শারবিনীর কথা। ধন্যবাদ প্রযুক্তির সহজলভ্যতাকে, দ্রুত সার্চ দিয়ে বের করে আনলাম মারওয়া শারবিনীর নিষ্পাপ ছবিটা। এথনো-সেন্ট্রিক মানসিকতার সবচেয়ে নির্মম শিকার! ওর ছোট্ট ছেলেটার চেহারাটা সহ্য করার বাইরে, এই পিচ্চির সামনে কোর্ট ভর্তি মানুষের সামনে খুন হয়েছে তার মা, মা’কে বাঁচাতে গিয়ে গুলি খেয়েছে তার বাবা। বাচ্চাটা এই ছোট্ট বুকের ভিতর মানুষের বিরুদ্ধে ঘৃণা তো আটবেনা! ও যে ঘৃণা’র চোটেই মরে যাওয়ার কথা!
‘দ্যাটস অল ফর টুডে মাই ক্লাস। আ’ল সী ইয়া নেক্সট উইক’। ক্লাসের আলো জ্বলেছে। কে কান্না করেছে খুঁজতে গিয়ে দেখি অনেকেরই চোখ লাল। হঠাৎ করে অদ্ভূদ একটা অনুভূতি হয় বুকের ভিতর। একটা সময় প্রচন্ড শক্তিশালী একটা ইচ্ছে ছিল বিপ্লবী হবো, সমাজটাকে বদলাবো। তীব্র আকাঙ্ক্ষা ছিল তাই সাংবাদিক হবো। আম্মু হতে দেয়নি। কিন্তু এখন এই মুহূর্তে ক্লাসে দাঁড়িয়ে মনে হলো, আম্মু হয়তো নিজেও জানেনা, সাংবাদিক হতে না দিয়ে আজকে আম্মু অন্য আরেক বিপ্লবী বানিয়ে ফেলেছে। বিপ্লবী হতে হলে মাঠে দৌঁড়ুতে হয়না। ছোট্ট একটা ক্লাস রুমে যে বিপ্লবের জন্ম হতে পারে, তা মাঠের বিপ্লবের চেয়ে আরো অনেক শক্তিশালী।… গতকাল সার্ক্যুলার কিউ স্টেশানে একলা বসে বসে ভাবছিলাম, জীবন কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে!? কোথায় যাচ্ছি?!... এখন ক্লাস থেকে বের হতে হতে মনে হলো, এখন একটা বিপ্লবের সময়। আমি সে বিপ্লবের মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছি।
মনটা ভাল হয়ে যায়। কেমন যেন তৃপ্তির একটা খুশীতে আমি নিজেই মুচকি হাসি। জীবনের একটা মিনিং খুঁজে পেলে, আসলেই, বেশ লাগে!