
যত ব্যস্তই থাকিনা কেন দুই মিনিটের জন্যে হলেও সকালের সংবাদ শিরোনাম টা না দেখলে সারাদিনটাই কেমন যেন অস্বস্থি লাগে। কিন্তু সেই দুইমিনিটের সংবাদ শিরোনামে পর্যন্ত দেখি 'ফেইসবুক'! যেখানেই যাই, সেখানেই দেখি ফেইসবুক।
কেইস-একঃ
দেশে থাকলে সামাজিক অনুষ্ঠান এড়িয়ে চলি যথাসম্ভব। এই এড়িয়ে চলাটা খুব সম্ভব উত্তরাধিকার সূত্রে আম্মু থেকে পাওয়া। আম্মুর মতে, এসব অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তাদের উদ্দেশ্য থাকে উপহার পাওয়া। আর অংশগ্রহনকারীদের উদ্দেশ্য থাকে নিজেদের সাজ-সজ্জা, বড়লোকী দেখানো।… অনেকের দ্বিমত থাকতে পারে, কিন্তু কথাটা সত্য। বিয়ে, আকীকা থেকে শুরু করে প্রতিটা অনুষ্ঠানে মহিলাদের একেকটা শাড়ী আর গয়না, মেয়েদের মেকাপ আর নতুন ফ্যাশনের ড্রেস'র যে বাহারী মডেলিং চলে, মানুষের এই নির্লজ্জ দেখানোর প্রবনতা বসে বসে দেখাও অনেকটা বিরক্তিকর। ……কিন্তু বিদেশে আসার পর সামাজিক অনুষ্ঠানগুলাই একমাত্র উপায় সবাইকে একসাথে পাওয়ার, দেশের মত সবাই মিলে হৈ চৈ করার। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এখানেও একই কাহিনী, সেই দেখানোর প্রবণতা। তো সেদিন এক অনুষ্ঠানে দেখি 'ম' বার বার এসে বলে 'একটা ছবি তুলে দে'না!' আর ছবি তোলার পরের কথা হলো, 'বাসায় গিয়েই কিন্তু মেইল করে পাঠায়ে দিবি'। শেষে বিরক্ত হয়ে বললাম, 'কাহিনী কী?! এত ছবি দিয়ে কী করবি! আশ্চর্য, অনুষ্ঠানে আসছোস নাকি ছবি তুলতে আসছস?' খেলাম উলটা ঝামটা, 'ছবি তুলে দিতে না চাইলে বললেই তো পারস, এত কথা শুনাচ্ছিস ক্যান?' অবাক হয়ে যখন কিছু বলতে যাচ্ছিলাম, তখন পাশের জন বললো 'ফারু, তুই এখনো বুঝস নাই? আরে অনেক গুলা ছবি থেকে অন্ততঃ একটা ছবিতো ভাল আসবে। সেই ছবিটা ফেইসবুকে যাবে আজকে, তুই একটা গাধা!' …… আমি আসলেই হয়তো গাধাই। কারণ আমার কিছুতেই বুঝে আসেনা অনুষ্ঠানে এসে মজা না করে কেনো শুধু শুধু কেউ সুন্দর ছবি তোলার স্ট্রেস মাথায় নিয়ে ঘুরবে?!
কেইস-দুইঃ
আমার খুবই পরিচিত এক বন্ধুজন 'ত' এর কিছু ফেইসবুক স্ট্যাটাস এর নমুনাঃ 'এইমাত্র টিভির অমুক অনুষ্ঠান দেখে উঠলাম, অমুকের অভিনয় বোগাস হয়েছে', 'এখন আমি ইউনি তে, আজকে ক্লাস হবেনা', 'রাত এখন একটা, এখনো ঘুম আসছেনা', 'অমুক আর এক ঘণ্টা পর সিলেট রওনা হবে, ইশ, আমারও যেতে ইচ্ছে করছে', 'এই মুহূর্তে আমি এই আত্নীয়'র বাসায়, ধুর না এলেই ভাল হতো, ভাল্লাগছেনা', 'কাল সকালে পরীক্ষা, কিছুই পড়া হয়নি এখনো'! ইত্যাদি ইত্যাদি!
কেইস-তিনঃ
'ল' দেখি আমার সাথে কথাই বলেনা! আরে, কাহিনী কী? শেষে সামনাসামনি পেয়ে আটকালাম, 'এই কী ব্যাপার, আপনি যে দেখি আমার সাথে কথাই বলছেন না? এড়িয়ে এড়িয়ে যাচ্ছেন?' চেহারাটা আষাঢ় মাসের মেঘের মত করে উত্তর দিলেন, 'দেখো ফারু, তোমার সাথে আমার কথা নাই।' 'সেকী বাবা, কাহিনী কী বলবেন তো! করেছি কী আমি?' 'আরে করেছো কী মানে? তোমাকে না আমি ফেইসবুকে এড করার আগেই বলছিলাম ফেইসবুকে আমার একটা স্ট্যাটাস আছে! তুমি সিডনী থাকো, অথচ ফেইসবুকে এমন গাইয়্যা ভাষায় কমেন্ট করো, ঐদিন ফটোটার নীচে কমেন্ট করছো 'ঝাক্কাস লাগতাছে আপনারে', অন্ততঃ ইংলিশে লিখতে পারতা ইউ আর লুকিং গর্জিয়াস!'…… ওনাকে হতভম্ব করে দিয়ে হো হো করে হেসে উঠেছিলাম। অবশ্য বাসায় এসেই ওনার প্রোফাইল ডিলেট করে দিয়েছি ফ্রেন্ড লিষ্ট থেকে। বাপরে বাপ! যে কিনা বাস্তবে একরকম আর ফেইসবুকে একরকম, আমার বাস্তবের ওনার সাথে কথা বললেই চলবে। ফেইসবুকের ফেইক ইমেজের যাকে আমি চিনিনা, তাকে এড রেখে শুধু শুধু টেনশান নেয় কে!
কেইস-চারঃ
ঘটনা সিরিয়াস। সিডনীর এক মেয়ে ফেইসবুকে পরিচয় হওয়া দুই লোকের সাথে দেখা করতে গিয়ে আর ফেরত আসেনি। দুই দিন খোঁজাখোঁজির পর অবশেষে সেই মেয়ের লাশ পাওয়া গিয়েছে। পুলিশ লোক দু'জনকে খুঁজে বেড়াচ্ছে!
কেইস-পাঁচঃ
ঘটনা ফানি। খবরে প্রকাশ পুরা ওয়ার্ল্ডে ফেইসবুক সবচেয়ে জনপ্রিয় সৌদি আরবে। যেহেতু ছেলে-মেয়েদের বাস্তবে মেলামেশায় খুবই স্ট্রিক্ট রুলস সেখানে, এখন তাই ওখানকার ছেলে-মেয়েরা বাস্তবে দেখা-সাক্ষাতের ঝুঁকি না নিয়ে ডেটিং-মেটিং সবকিছুই করে ফেইসবুকে! শুধু একটা ঝুঁকি যেকোনো ভাবে অপরপক্ষকে ফেইসবুকের এড্রেসটা জানিয়ে দেয়া!
কেইস-ছয়ঃ
এবার আমার ঘটনা। প্রথম দিকে ফেইসবুকে ঢুকার উদ্দেশ্য ছিল লেখা শেয়ার করা। তাই যেখান থেকেই ফ্রেন্ড রিকোয়েষ্ট আসতো কিছু না দেখেই এড করে নিতাম। পরে দেখি, লেখা শেয়ারের চেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ালো তর্ক-বিতর্ক! কেউ কেউ উদ্দেশ্যমূলকভাবে ব্লগের মত ফেইসবুকেও দেখি কমেন্ট ফ্লাডিং করে (মানুষ যে কেন এত খারাপ!) …… কোনটা রেখে কোনটা সামলাই, শেষে বিরক্ত হয়ে ফেইসবুক ডি-একটিভ্যাট করে রাখলাম।…… আহমাদ আমার কলিগ, লেবানিজ-অস্ট্রেলিয়ান। একদিন কী কারণে যেন কথায় কথায় বললো, 'তোমার ফেইসবুকে আমাকে এড করে নাও, ওখানে শেয়ার করে দিব।' বললাম, আমার ফেইসবুক তো ডিএকটিভ্যাট'। যখন জানালাম স্ট্রেস লোড নিতে পারছিনা তাই ডি-একটীভ্যাট করে রেখেছি, অবাক হয়ে ও যে কমেন্ট করেছিলো, তাতে অনেককিছু শেখার আছে 'মাইট, হোয়াটস ইউর প্রবলেম? ফেইসবুক ইজ আ টেকনলজি হুইচ মেইক্স আওয়ার কম্যুনিক্যাশান ইজিয়ার মাইট, হোয়াই ইউ এড পিপল হোম ইউ ডোন্ট নো? ইউ হ্যাভ ইউর ব্লগস টু শেয়ার ইউর রাইটিং, হোয়াই এগেইন ফেইসবুক মাইট? ইট ইজ অনলি ফর পিপল ইইউ নো… ইট গিভস ইউ অল দ্য অপশন্স টু শেয়ার অর নট টু শেয়ার ইউর ইনফো, ইটস ইউর প্রবস মাইট, নট ফেইসবুক'স!' ……… সেদিন ঘরে এসে প্রথমেই ফেইসবুক রি-একটিভ্যাট করে যাদেরকে যাদেরকে চিনিনা তাদের সবাইকে ডিলেট করে দিয়েছি।
ফেইসবুক একটা সোশাল নেটওয়ার্কিং। এটা আপনাকে সব ধরনের অপশন দিচ্ছে আপনি কোনটা শেয়ার করবেন কোনটা শেয়ার করবেন না। এখন আপনি নিজেই যদি সব শেয়ার করে রাখেন, যাদেরকে চিনেননা তাদেরকেও এড করে করে বিশাল এক ফ্রেন্ড লিস্ট বানিয়ে রাখেন আর আশা করেন আপনার কোনো ঝামেলা হবেনা, তাহলে সে দায়িত্ব আপনার! ……… ফিরে আসি আমার দুই মিনিটের সকালের সংবাদ শিরোনামে। মানুষের জীবন এখন খুবই খুবই ফাষ্ট চলে। এই দুইমিনিটের সংবাদ শিরোনামও সেই দ্রুত তালের সাথে তাল মিলিয়ে ক' সেকেন্ডের জন্যে একজন সমাজ বিজ্ঞানীকেও ধার করে এনেছে যিনি এই কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ফেইসবুক নিয়ে কমেন্ট করবেন। তার কমেন্টের শেষ লাইন ছিলো, 'ইন দ্য এন্ড, ইটস ইউ হু আর রেসপনসিবল'। কথাটা সত্য। কেইস একের মত সারাক্ষণ মাথায় ফেইসবুকে ছবি আপলোড করার টেনশান নিয়ে ঘুরলে, কেইস দুইয়ের মত ঘন্টায় ঘন্টায় ফেইসবুকে 'আমি এখন কী করছি' টাইপ স্ট্যাটাস দিতে থাকলে, কেইস তিনের মত বাস্তবের আপনি আর ফেইসবুকের আপনি যদি দুইজন হোন, ফেইসবুকে যে 'উদ্দেশ্যেই' হোক একটা ফেইক ইমেজ বানিয়ে রাখলে এবং ভার্চূয়াল স্ট্যাটাস বজায় রাখতে হিমশিম খেলে, কেইস চারের মত ভার্চূয়ালি চেনা মানুষের সাথে দেখা করতে যাওয়ার রিস্ক নিলে, কেইস পাঁচের মত ফেইসবুকে ভিন্ন ভিন্ন 'সম্পর্ক' খুঁজে বেড়ালে, কেইস ছয়ের আমার মত বোকামী করে চেনা-অচেনা সবাইকে এড করে নিলে অবশ্যই দিন শেষে ফেইসবুক জনিত কিছু ঘটলে তার জন্যে আপনি-ই দায়ী।
আমার একজন স্যারের একটা কথা আমার খুবই পছন্দ, তিনি ফেইসবুকে প্রোফাইল ইনফো-তে যা লিখেছেন তার মূল কথা হলো, 'জীবনটা খুব ছোট, আমি একে সিম্পল করে নিয়েছি'। আমি বলি, জীবনটা ছোট'র পাশাপাশি ভীষন কমপ্লিকেটেড। টেকনোলজিকাল ডেভেলপমেন্টের পাশাপাশি সবধরনের ডেভেলপমেন্টের এক্সপেরিমেন্টে আপনি নিজেও জানেননা আসলে আপনি শুধু একজন ভিক্টিম মাত্র। নিজের এই 'ভিকটিমত্ব' কে নিজেই বোকার মত বাড়িয়ে তোলার কোনো মানে নেই। জীবন ছোট, একে সিম্পল রাখুন। আশেপাশের আত্নীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব নিয়ে সুখী থাকুন, আরামে-রিলাক্সে থাকুন। খামাকা মাথায় টেনশান নিয়ে স্ট্রেসড হয়ে ব্লাড প্রেশার বাড়ানোর কোনো মানে আছে? অন্ততঃ আমার কাছে নাই। তাই সব কথার শেষ কথা, যদি ফেইসবুক সামলাতেই না পারেন, তাহলে ব্যবহার করারই দরকার নেই।