
“তোকে নিয়ে ঘর বাঁধবার স্বপ্ন আমার অন্তহীন/রাত্রিদিন/তবু বাঁধ সাধে আরেক আশা/ফুটপাতে যাদের বাসা/আগে তাদের জন্য একটা ঘর বানাই/তারপরে তোর সিঁথিতে/তারার সিঁদুর রাংগিয়ে দিতে/করবো ঋণ!”
নচি’দার এই গান যতবার শুনেছি ততবার ভেবেছি এই ‘অণির্বাণ’রা কি আসলে সত্য হতে পারে? এমনকি হতে পারে এইধরণের কিছু মানুষ আসলেই ছিল অথবা আছে? একসময় সমরেশ আর সুনীলের লেখা নকশাল ছেলে-মেয়েগুলোর কাহিনী পড়তে পড়তে চোখের সামনে যে সমাজ গড়ার স্বপ্নগুলো চোখ খোলা রেখেই ফকফকা আলোয় রংধনু’র মত দোল খেতো, ভাবতাম, এমন কি হওয়া সম্ভব?! ‘হাজার চুরাশির মা’ বা এই ধরনের কী যেন নাম মুভিটার, তাতে ছেলেটা বাবার সব সম্পত্তিকে পায়ে ঠেলে মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে যোগ দিতে গিয়ে এমন কঠিন মৃত্যুর মধ্য দিয়ে শুধু একটা নাম্বার হয়ে যায়, একটা বেওয়ারিশ লাশ- ১০৮৪, এমন মানুষ কি হয়? অথবা সেই ছেলেটার মত যে সমাজটাকে ভেংগে আবার গড়বে বলে বেরিয়ে যাওয়ার আগে মা’কে লিখে যায়, ‘আবার জান্নাতে দেখা হবে মা’! অথবা সেই তুখোড় ব্রিলিয়ান্ট ছেলেটার মত, ঘুণে ধরা সমাজটাকে বদলাবে চায় বলে ইটের উপর যার মাথা রেখে আরেক ইট দিয়ে থেতলে মেরে ফেলে সমাজবিরোধীরা! ……… এদের আদর্শ ভিন্ন, এদের চিন্তার পদ্ধতি ভিন্ন, কিন্তু এদের স্বপ্ন একটাই- আশেপাশের মানুষগুলোর ভালভাবে বাঁচার জন্যে ভাল একটা সমাজ!
এরা আসলেই কেমন যেন হয়। জীবনের ছোটখাটো দুঃখ আর কষ্টে-ক্লেশে আমরা যারা নিত্যনৈমিত্তিক ঘৃণা আর বিরক্তিতে বসবাস করি, ওরা আমাদের মত না। ওরা টাকার পিছে ছুটেনা। ওরা সোশাল প্রেস্টিজ নিয়েও মাথা ঘামায় না। ওদের ব্যক্তি জীবন কীভাবে যেন এত বড় হয়ে যায় যে পুরো সমাজটাই কেমন করে যেন ওদের ব্যক্তিগত হয়ে যায়। সে বিশাল ব্যক্তি জীবনে ওদের চোখের সামনে একটাই স্বপ্ন, সমাজ বদলের স্বপ্ন! আর সে স্বপ্নের জন্যে কী নির্দ্বিধায় এরা সব জলাঞ্জলি দিয়ে ‘অনির্বাণ’ হয়ে যায়! আমরা যখন ছোট্ট একটা ঘর বাঁধার আপ্রাণ চেষ্টায় ঘর্মাক্ত, পুরো সমাজ, পুরো পৃথিবীটাই তখন ওদের ঘর হয়ে যায়। ওরা সে একটা মাত্র বড় ঘরের অন্ধকারের প্রহরী বনে যায়।
মানুষের জীবনে একটা সময়ে এসে দু’টো ভালবাসা পৃথিবীর একমাত্র সত্য হয়ে দাঁড়ায়। জন্মদাতা আর দাত্রী’র প্রতি ভালবাসা, আর ঘরবাঁধার মানুষটার প্রতি ভালবাসা। কিন্তু অণির্বানরা কী নির্দ্বিধায় শতরুপাদের মাথায় সিঁদুর পড়ার স্বপ্নকেও পাশ কাটিয়ে চলে যায় মানুষের মুক্তি’র খোঁজে। ওদের কী বুক ভাংগেনা? ভাংগে। ওদেরক কি কান্না পায়না? পায়। তারপরও ওরা যায়। হাজার হাজার শতরুপা’র মাথার সিঁদুর বাঁচাতে, হাজার হাজার মায়ের বুকের ঘরের ছেলেকে ঘরেই রাখতে, ওরা জানে- ওদের মত কিছু মানুষকে যেতে হয়। ওরা যাওয়ার সময় সবাই ওদের দিকে বিদ্রুপাত্নক দৃষ্টিতে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে,কিন্তু এই ভ্রু কুঁচকানো মানুষেরা জানেনা, পৃথিবীতে এই ‘অনির্বাণ-শতরুপা’রা আছে বলেই পৃথিবীতে এখনো ‘মানুষের মুক্তি’র স্বপ্ন বেঁচে আছে। ওদের আদর্শ যতই আলাদা হোক, ওদের স্বপ্ন একটাই। যখন এইরকম কোনো অণির্বানের কথা জানি, শুনি, নিজের কাছেই নিজে কেমন ক্ষুদ্র হয়ে যাই। লজ্জায় মাথা নুয়ে আসে। বড্ড স্বার্থপর লাগে নিজেকে। ওদের স্বপ্নের কাছে নিজেদের নিত্য-নৈমিত্তিক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্রতা লজ্জাজনক হয়ে দাঁড়ায়। দীর্ঘশ্বাস আর দৈন্যতায় তখন প্রার্থণা করি, পৃথিবীতে যুগে যুগে সব অনির্বানেরা তাদের স্বপ্নের মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকুক।