
-লাইনে নতুন?
-(নিরবতা)
-তুমি কি ভাবছো চুপ করে থাকলেই তোমার সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে?
-(নিরবতা)
-চোখ দিয়ে পানিও পড়ে দেখি! কান্দ ক্যানো? এই লাইনে কানতে থাকলে সারাজীবন কানবা। ……আমাকে দেখো তোমার কী মনে হয় আমি কান্দি?
-(নিরবতা)।
-কী? তুমি কী ঠিক করছো কথা বলবানা? কথা না বললে পরিস্থিতি আরো বেশী খারাপ হবে। চোখের পানি মুছো। বলো দেখি কীভাবে আসলা এইখানে?
-ও…… ও আমাকে……… (ঢুকরে কান্না)।
-একবার বললাম চোখের পানি ফালবা না, কথা কানে যায়না?...... আর বলতে হবেনা। বুঝছি। শোনো তোমার মতন কেইসের মেয়ে এখানে অনেক আছে। মেয়ে হয়ে জন্মাইছো এমনিতেই অনেক পাপ নিয়ে জন্মাইছো, তার মধ্যে আবার গাধা হয়ে জন্মাইছো। ছেলে একটা আইসে ননায়ে ননায়ে দু’কথা বলছে, যে বাপ-মা এত কষ্ট করে জন্ম দিছে, খাওয়ায়ে পরায়ে বড় করছে, তাদেরকে ফালায়ে বের হয়ে পড়ছো ঐ ছেলের হাত ধরে। পাপের উপর পাপ, গাধার উপর গাধা, এখানে আসবা না তো কোথায় যাবা!
-বুবু, আমি কল্পনাও করিনাই……
-চুপ! তুমি আমাকে বুবু বলবানা। আমি তোমাকে বুবু বলার কোনো অধিকার দেই নাই।
-বুবু, প্লীজ…
-আবার ইংরেজী মারাও! দূরে যাও। ঐখানে গিয়ে বস। শোনো, তোমাকে এই রুমে দিয়ে গেছে কিছু আসল জিনিস শিখায়ে পড়ায়ে দিতে। তোমার চেহারা আছে। একটু শিখে নিতে পারলে খদ্দেরের কাছে অনেক ডিমান্ড বাড়বে।
-বুবু প্লীজ, এভাবে কথা বলবেন না, প্লীজ আমাকে বাঁচান! ঐ মহিলাকে বলেন আমি দরকার হলে মানুষের বাসায় কাজ করে খেটে ওনার টাকা দিয়ে যাবো! প্লীজ আমাকে এখান থেকে বের হওয়ার ব্যবস্থা করে দেন!
-অসম্ভব। তোমার জন্যে সে অনেক টাকা দিছে তোমার নাগরকে।
-প্লীজ, আপনার পায়ে ধরি, প্লীজ, আমার বাবা অনেক বড়লোক, যত টাকা দিয়েছে তার ডাবল দিবে। প্লীজ…
-আমার পায়ে এভাবে চোখের পানি ফেলে লাভ নেই, তোমাকে প্রথমেই বলছি। এখানে ঐ ডাইনির কথাতেই সব চলে। আমার ডিমান্ড খদ্দেরদের কাছে বেশী তাই আমাকে একটু সাইড দিয়ে চলে, এই যা। তোমাকে বের করা আমার পক্ষে সম্ভব না।
-বুবু, প্লীজ…
-(নীরবতা)
-আমাকে বাঁচান! আমি জীবনেও আর এই ভুল করবোনা। আপনি আমাকে বাঁচান। একবার শুধু আমাকে বের হওয়ার ব্যবস্থা করে দেন, প্লীজ! আপনার কথাবার্তা শুনে আপনাকে শিক্ষিত মনে হচ্ছে। প্লীজ, আমাকে বাঁচান!
-শুধু শুধু এইভাবে আমার পা ধরে চোখের পানি ফেলতেছ। এই পৃথিবীর একটা কঠিন নিয়ম আছে। ছেলেরা ভুল করলে দুনিয়া তাকে আরো ভুল করার সুযোগ দেয়। কিন্তু মেয়েরা একবার ভুল করলে এই দুনিয়া তাকে কঠিন থেকে কঠিন শাস্তি দেয়। আমাকে দিছে। পাশের রুমের শাহানাকে দিছে। এখানের যত মেয়ে আছে সবাইকে দিছে। তোমাকে বাদ দিবে কেনো? ……… কেঁদে লাভ নেই। কাঁদলে সবাই তোমাকে আরো বেশী পেয়ে বসবে, ঐ ডাইনি আরো বেশী খদ্দের চাপায়ে দিবে। শক্ত হও, খদ্দের সামলাইতে শেখ।
-আমি আপনার পা ছাঁড়বোনা। আমাকে বাঁচান, না হলে আমি সুইসাইড করবো! আমার পেটে ওর বাচ্চা! আমাকে আর পেটের বাচ্চাটাকে আপনি মেরে ফেলেন! বিষ দিয়ে মেরে ফেলেন বুবু, তাও এখান থেকে আমাকে বাঁচান! এইখানে এইভাবে আমি বাঁচবোনা। আমি ভুল করছি! আমাকে বাঁচান! প্লীজজজজজ!
(চৈতি- যার এখনকার নাম মাধুরী- মিশ্র অনুভূতি নিয়ে তার পা জড়িয়ে ধরে ডুকরে কাঁদতে থাকা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকে। একসময় তার মনে হয় লাথি মেরে মেয়েটাকে দূরে সরিয়ে দেয়। ঘিন্না লাগে মেয়েটার ভেতর নিজেরই অতীত দেখে। কিন্তু কেনো যেনো পা দু’টো লোহার মত মনে হয়। লাথি দেয়ার শক্তি নেই সে পায়ে। আড়াইবছর আগে শেষবার আর কোনোদিন চোখের পানি ফেলবেনা বলে শক্ত প্রতিজ্ঞা নেয়া চৈতি’র চোখ ভিজে আসতে থাকে। সে সময় ইন্টারমিডিয়েট পড়া ছোট বোন মিতি’র ‘আপু’ ডাক কানে ভাসতে থাকে ডং ডং ঘন্টার মত। ভেজা চোখেই চৈতি বুঝে, এই বুবু ডাকতে থাকা মেয়েটাকে এখন ও শক্ত করে লাথি না দিলে, সারাজীবন মেয়েটা লাথি খাবে!
শ্রাবনের একদিন বিকেলে, সতী গৃহবধুদের কাছে খারাপ পাড়া বলে বিখ্যাত গলিটার, একটা রুমের ভিতরে দু’জন মেয়ের একজন চোখে পানি নিয়ে, আরেকজন বুকে সমুদ্র নিয়ে কাঁদে। কিন্তু প্রচন্ড বৃষ্টির শব্দের সাথে সে কান্নার শব্দ বিলীন হয়ে যায় বলে পৃথিবীর কারো কোনো খবর হয় না। অনেক দূরে কোথাও কলেজ পড়ুয়া সদ্য কিশোরী মেয়েটা খোলা চুলে জানালার গ্রীল দিয়ে হাত বাড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে বৃষ্টি ধরতে চায়।)