
আমি কি খুব অল্পতেই হতাশ হয়ে যাই? প্রশ্নটা মনে নাড়াচাড়া করতে করতে কখন যে কার্পেটে হাত-পা ছড়ায়ে দিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে সিলিং’র দিকে তাকায়ে থাকতে শুরু করছি, কখন যে প্রায় আধ ঘন্টা পার হয়ে গেছে, হুঁশ আসলো তৌহিদের ঘুম থেকে উঠে বাথরুমের দরজা বন্ধ করার আওয়াজ শুনে। কালকে ক্লাস নিতে হবে ‘হেলথ আর বায়োমেডিসিন’র উপর, ওয়েস্টার্ন সোশিওলজিক্যাল দৃষ্টিভংগী থেকে। সারাদিনের এই সেই কাজে পড়ার সময় করা কঠিন, তাই ভোরে উঠে পড়তে বসছিলাম। ভোরের একটা আলাদা গন্ধ আছে, কেমন যেন পরিষ্কার বাতাস আর গাছপালার সবুজের মিশানো একটা গন্ধ। গন্ধটা আমার খুব ভালো লাগে। বারান্দায় দাঁড়ায়ে বুক ভরে ভোরের গন্ধ নিয়ে অনেক আশা নিয়ে পড়তে বসছিলাম যে অনেক পড়ব আজকে। একঘন্টাও যায় নায়, হতাশ হয়ে সিলিং দেখা শুরু করছি। বুকের ভিতর ভোরের গন্ধ’র বদলে হতাশার বিদঘুটে তিতা স্বাদ।
প্রতিটা ব্যক্তি মানুষ যেমন নিজের আদর্শ আর বিশ্বাসের বেলায় অন্ধ হয়ে যায়, একসাথে জাতিগতভাবেও মানুষের সে অন্ধত্ব যায়না। এখানেই আমার যত দুঃখ। আমার একটা বিশ্বাস আছে, আমার একটা আইডিয়োলজি আছে, অবশ্যই থাকবে। মানুষ মাত্রই চিন্তা করবে, কিছু একটা বিশ্বাস করবে। এবং খুব স্বাভাবিকভাবেই নিজের বিশ্বাসকে অন্য সবার বিশ্বাসের উপরে প্রমাণ করার সর্বাত্নক চেষ্টা করবে। সবই ঠিক আছে। কিন্তু তাই বলে অন্যকে জোড় করে ধরে বেঁধে নিজের বিশ্বাসকে গিলায়ে দেয়ার চেষ্টা, এমনকি অন্যরকম বিশ্বাসীদের অস্তিত্বই মুছে দেয়া বা তাদের অতীত-বর্তমান সব অস্বীকার করে বসে থাকা- এ কেমন ধারা মনুষ্যত্ব?!!
পড়তেছিলাম ট্র্যাডিশনাল হেলথ কনসেপ্ট নিয়ে। কীভাবে ওয়েস্টার্ন বায়োমেডিসিন আস্তে আস্তে অস্তিত্ব লাভ করলো। এর আগে কোন জাতির, কোন দেশের বা এলাকার ‘হেলথ কনসেপ্ট’ কেমন ছিল। একটা সময় চাইনিজ মেডিসিনের মূল মন্ত্র কীভাবে ‘ইন’ আর ‘ইয়াং’ ছিল। কখন গ্রীকরা মেডিসিনের বেলায় চারটা ইলিমেন্টে বিশ্বাস করতো; black bile, phlegm, choler আর blood। কখন কোনো ধরনের অষুখকে ‘স্রষ্টার অভিশাপ’ মনে করা হতো। অথবা ধারণা করা হতো ‘জ্বীন-ভূতের আছর’ বা ‘ডাইনির যাদু’। কীভাবে আস্তে আস্তে ধর্ম থেকে রাষ্ট্র আলাদা হওয়ার মত ধর্মে থেকে মেডিসিনকেও আলাদা করা হলো। …… পড়তে পড়তে দেখি আমি মডার্ন ওয়েস্টার্ন মেডিসিনের চাপ্টারে চলে আসছি! তাড়াতাড়ি আবার ব্যাকে গেলাম, আরে মুসলিম মেডিসিনের কথা কই?! ওম্মা, কোথাও নাই। কীভাবে সম্ভব! মেইন টেক্সট বই রেখে এবার রেফারেন্সগুলা নিয়ে বসলাম। কোথাও না কোথাও তো মেডিসিনের হিস্ট্রীতে মুসলিম মেডিসিনের কথা থাকবেই। কীভাবে সম্ভব যে ইতিহাসের এত সিগনিফিকেন্ট আর সাবস্টেনশিয়াল একটা চাপ্টারকে পুরাই গাপ্ করে ফেলবে?!!! কিন্তু একি, কোথাও যে নাই!!!
ছোটকালে আম্মু আমাদের সব ভাইবোনদেরকে খুব ঘন ঘন ডাব্বু করে দিতো। বিশেষ করে আমাকে। মাথায় এত্ত বেশী ঘন চুল ছিল যে প্রায় সময় অসুস্থ থাকতাম। উপায় একটাই, ধরে বসে সুন্দর করে কী যেন নাম ছিল ব্লেড-টার, খুব বিখ্যাত ব্লেড ছিল তখন, ঐ ব্লেড দিয়ে আমার পুরা মাথা টাক্কু মাথা চাইরানা করে দেয়া। আর বড়ভাইয়া একটু পর পর সুযোগ পাইলেই সে ডাব্বু মাথায় এসে চপাৎ করে চাটি দিয়ে বলতো ‘ডাব্বু মাথা চাইরআনা/চাবি দিলে ঘুরেনা’! আর আম্মু যতবার ডাব্বু করতো, ততবার আমার ডাব্বু মাথা দেখে প্রথম যে কথাটা বলতো সেটা হলো ‘তোর মাথাটা এত ছোট!’ আমি এখন বড় হয়ে (বড় হওয়ার সংজ্ঞা কী?!) আসলেই বিশ্বাস করি, হয়তো আমার মাথা ছোট বলেই আমি অনেককিছু বুঝিনা।
গ্রীকদের কথা বললো, চাইনিজদের কথা বললো, এমনকি কোন আমলের মিশরের ফারাওদের মমি বানানোর মেডিক্যাল কথাবার্তা পর্যন্ত বললো, কিন্তু মুসলিমদের কোনো চিহ্নই নাই!! মানুষ এত নিমকহারাম হয় কী করে?! ক্রুসেডের যুদ্ধের সময় খৃষ্টান প্রধান রিচার্ড’র চিকিৎসার জন্যে মুসলিম সেনাপতি সালাউদ্দিন তার নিজের ব্যক্তিগত চিকিৎসককে বিনা দ্বিধায় পাঠায়ে দিল ফ্রীতে চিকিৎসা করে দিয়ে আসার জন্যে, আর এরা এমন নিমকহারাম উলটা পরে জেরুজালেম দখল করে ত্রিশহাজারেরও বেশী মুসলিম নারী-শিশু-বৃদ্ধ সহ সবাইকে এমনভাবে গলাকাটা করে জবাই করছে যে জেরুজালেমের অলি গলি হাঁটু পর্যন্ত ডুবে গেছে রক্তে! আচ্ছা সে না হয় হলো, কিন্তু ইতালীর সিলিসি দিয়ে যেভাবে বানের পানির মত ইসলামিক ন’লেজ ইউরোপে এসে ঢুকলো সব পুরাই গিলে ফেলে কীভাবে বেমালুম গাপ্ করে বসে আছে! এইট হান্ড্রেড সেঞ্চুরিতে স্পেনে মুসলিমদের ‘স্কুল অব টলিডো’ তে যেভাবে মুসলিম স্কলাররা প্রাচীন গ্রীক-রোমান সভ্যতার টেক্সগুলোকে পুনরুদ্ধার করছে, এবং বিনা দ্বিধায় সেইগুলা আবার খ্রীষ্টান-ইহুদী স্কলার-যারা মুসলিমদের স্কুলে পড়ালেখা করতো- তাদের সাথে শেয়ার করছে, তাদেরকে এক্সেস দিছে মুসলিমদের জ্ঞানে; এইগুলা সব কোথায় গেলো?! সে সময়ের আউটস্ট্যান্ডিং মুসলিম চিকিৎসক ইবনে সিনা (যাকে ওয়েস্ট বিকৃত করছে এভিসেনা নামে) সে কোথায়? তার এবং তার সমসাময়িক অন্যান্য মুসলিম চিকিৎসকদের মেডিক্যাল-রিলেটেড বেসিক থিউরীগুলা কোথায়?!
পড়তে পড়তে অনেক কষ্টে খুঁজে একজায়গায় একটু খানি ইহুদীদের কথা লেখা আছে দেখি।১৩৪৬ সালে চায়না আর রাশিয়া’র ট্রেড রুটস থেকে ছড়ায়ে পরা প্লেগে হাজার হাজার মানুষ মারা গেলেও ইহুদীরা অনেকটুকু বেঁচে ছিল কারন ধর্মীয় কারণে তাদেরকে সপ্তাহে অন্ততঃ একদিন হাতমুখ পরিস্কার করতে হতো পানি দিয়ে। তাইলে এই ১৩৪৬ এর আরো ছয়শ’ বছর আগে যে আরবের মুসলিমরা মরুভূমিতে থেকেও- যেখানে একফোঁটা পানি কিনা মহামূল্যবান- প্রতিদিন পাঁচবার যে হাত মুখ ধুইতো অযু করার সময়- সেই কথা কেন মেডিসিনের হিস্ট্রীতে নাই?!
প্রতিবার আমি যখন ক্লাসে ঢুকি, অদ্ভূদ একটা অনুভূতি হয়। কারন যখন আমি কথা বলি ক্লাসের পঁচিশ-ত্রিশটা চোখকে দেখি আমি, অবাক হয়ে তাকায়ে আছে, শুনতেছে, কেউ কেউ নোট নিচ্ছে। আমার সুপারভাইজার একবার বলছিল যে টীচিং প্রফেশানের একটা যাদু আছে। একবার শুরু করলে এই প্রফেশান চেইঞ্জ করা অনেকটা অসম্ভব। সে যাদু আমি টের পাই ক্লাসে। সোশিউলজিতে একটা চ্যাপ্টার আছে, জ্ঞান কীভাবে পানির মত উপর থেকে নীচের দিকে প্রবাহিত হয়, যাকে বলে ‘ন’লেজ ট্রান্সমিশান’। আমি ক্লাসে কথা বলার সময় নিজেকে জ্ঞানের এই ধারাবাহিক ভাবে প্রবাহিত হওয়ার স্রোতে হাবুডুবু খাইতে দেখি, অদ্ভূদ একটা অনুভূতি সুরসুর করে মাথার ভিতর- এই পোলাপাইনগুলো আমার কথা শুনতেছে, জ্ঞান প্রবাহিত হচ্ছে। এরা যাই শুনুকনা কেনো, শুনেই কিন্তু ফেলে দিতে পারবেনা। জীবনের প্রাসংগিক কোনো না কোনো ক্ষেত্রে বলা যায়না, আমার কোনো কথা ক্লিকও করতে পারে!- এটাই টীচিং’র যাদু। কিন্তু সে যাদু এখন কেমন প্রেশার লাগে মাথার উপর। মনে হয় কেউ যেন মাথার উপর একটা প্রেশার কুকার বসায়ে দিছে আর সেই প্রেশার কুকার একটু পর পর হিইশশশশশশশশশশশ করতে করতেটীচিং’র রেস্পন্সিবিলিটি মনে করায়ে দিচ্ছে।
তৌহিদ বাথরুম থেকে বের হইছে। ঐরুম থেকে ডাক দিচ্ছে, ‘ভাবী, ক্ষিদা লাগছেতো! নাস্তা করবেন না?’……… কালকে দুই ক্লাসে পঁচিশ আর সাতাশ মোট বায়ান্নটা চোখের সামনে দাড়াঁয়ে আমি কী বলবো? ওদের বইয়ের কথা? নাকি অলিখিত ইতিহাসের কথা? …… ওদেরকে যদি বলি তোমাদের বই এমনকি তোমাদের মেইন লেকচারার পর্যন্ত মেডিসিনের হিস্ট্রীতে বিশাল একটা অধ্যায়কে লুকায়ে রাখছে, আর সে অধ্যায় মুসলিম মেডিকাল ডেভেলপমেন্টের অধ্যায়; কী হতে পারে? উর্ধ্বতনদের কানে গেলে জবাবদিহী করতে হবে, ফাইট করতে হবে। উলটা হয়তো দেখা যাবে মাথা গরম করে চার্জই করে বসবো তাদেরকে জ্ঞানচুরির অপরাধে। তখন আবার বেয়াদ্দপীর জন্যে টীচারগিরি চলে যাবে।……… আমরা কত বেশী সমাজের বিভিন্ন ‘ইন্সটিট্যুশান’র কাছে জিম্মী, ভাবতে ভাবতে আমার হতাশা দ্বিগুন থেকে ত্রিগুন হয়।
আস্তে আস্তে হতাশা থেকে মেযায খারাপ হয়। শালার মুসলিমদের সমস্যা কী? ওয়েস্ট না হয় বুঝলাম ওরা আমাদেরকে শত্রুর দৃষ্টিতে দেখে। আরেক কাবিল হান্টিংটন সাহেব ‘দ্য ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশান’র মত ফক্কামার্কা থিউরী দিয়ে সে শত্রুতায় বলতে গেলে আগুনে ঘি ঢালছে। আচ্ছা, সেওতো ওয়েস্টের মানুষ। তারা তো এইগুলা করবেই। কিন্তু মুসলিমদের সমস্যা কোথায়?? তাদের মধ্যে কেনো কোনো ওয়ার্ল্ড ফেমাস ইসলামিক সোশিওলজিস্ট বের হয়ে আসেনা যারা কিনা ইতিহাসের এইসব অলিখিত অধ্যায়কে লিখবে? জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায়, কই, আমিতো তেমন কোনো মুসলিম ফিগার দেখিনা। যাও এক দুইটা ফিগার আছে তাও সেই ঐ যুদ্ধা-যুদ্ধিতেই। আবুল কালাম আজাদ সাহেব, আর পাকিস্তানের ওনার নাম কী যেন। ধুর ভুলে গেছি। মানুষের রক্ত পান করার একটা মজা আছে, সে মজা পাইছে আমাদের তথাকথিত মওলানারা, যারা জিহাদের একটাই ব্যখ্যা জানে, ‘ধরে ধরে তলোয়ার দিয়ে মাইরে সব শেষ করে ফেল্’! বাচ্চাদের একটা ইংলিশ মুভি দেখছিলাম যেখানে একটা যাদুর বই আছে। পাঠক বইটা খুলে যে পৃষ্ঠা পড়া শুরু করবে, চোখের পলকে সে পৃষ্ঠার সময় আর দুনিয়ায় চলে যাবে। মুসলিমদের অবস্থা হইছে সেইরকম। কোরানশরীফ খুলে জিহাদের লাইন যেখানে আছে সেইখানে সবচেয়ে শক্ত আঠা ‘এলিফেন্ট সুপার গ্লু’ দিয়ে আটকে গেছে পুরা জাতি!
আসলে জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় মুসলিম ফিগার আসবে কোথা থেকে? তাহলে ‘ফতোয়া’র শাখায় যে অভাব দেখা দিবে! সেদিন এক ফরোয়ার্ড মেইল পাইলাম এক আরব ‘ফতোয়াবাজ’ মওলানা’র লেকচারের লিংক। পুরা লেকচারে মাওলানা (অন্য কারো মাওলানা হইতে পারে, আমার না। কারন মাওলানার এক অর্থ ‘আমাদের অভিভাবক’)সাহেব ব্যখ্যা দিলেন, স্ত্রীকে মারলে কতটুকু মারা যাবে। কীভাবে মারতে হবে। কয় আংগুল মারা যাবে। কয় আংগুল দাগ দেখা গেলে ঠিক আছে, আর না হলে ঠিক নাই। আবার সবার শেষে বলে ‘গাধাকেও তো তোমরা সেইভাবে মারোনা যেভাবে স্ত্রীকে মারো। সাবধান গাধা তো গাধা, স্ত্রী কিন্তু মানুষ, আল্লাহ’র বান্দী’। ল্যাপটপের স্ক্রীনের ভিতর দিয়ে হাত ঢুকায়ে যদি কারো গলা টিপে দেয়ার টেকনলজি আবিষ্কার হতো, আমি একদম নিশ্চিত ঐ মওলানার গলায় আমার পাঁচ না দশ আংগুলের ছাপ বসে যেতো। (স্ত্রী প্রহারের ভূল ব্যখ্যার বিশ্লেষন করতে গেলে আজকে আর এই লেখা শেষ হবেনা!)
মুসলিমরা, তোমরা বাছারা ফতোয়া নিয়েই ব্যস্ত থাকো। হ্যা, এইটা খুবই দরকারী যে বউকে কয় আংগুল পিটানো যাবে। তারচেয়ে বেশী দরকারী মেয়েরা হাতে মেন্দী লাগাইলে তারউপর হাত মোজা পড়তে হবে কি হবেনা। আরে দাঁড়াও বাছা, আরো আছে। জেনানা মানুষ, থুক্কু মেয়েমানুষদেরকে তো পুরা শরীরে কালো বোরকা দিয়ে ঢাকাইতে হবেই, চোখের ওখানে যে নেটটা দেয় ঐ নেটটা আসলে কতটুকু পাতলা হইতে পারবে- এটাও খুবই চিন্তার বিষয়। তোমরা বাছারা নারীজাতিকে ফতোয়া দিয়ে দিয়ে উদ্ধার করতে থাকো। আমি যাই।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই এপ্রিল, ২০১০ সকাল ৭:০৩