দু’টা চেরাগ দু’দিকে নিয়ে মুন্নি, সম্রাট, ফরহাদ আর আমি লুডু খেলতে বসি। সম্রাট কিছুতেই ঘর খেলবেনা, তাই সাপ খেলা। কিন্তু দশ মিনিটেই লুডু খেলা মাথায়! ওরা তিনজনই যখন নব্বই’র ঘরে, সাপের খাদ্য হতে হতে আমি তখনো বিশ পেরুতে পারিনি! সাপ খেললেই কেন যেন আমাকে সবসময় বড় সাপগুলোই পায়! চেরাগের আলোয় সাপগুলোকেও কেমন জীবন্ত দেখায়। সাপ কি সর্বভূখ? কে জানে……
ফরহাদ দান চুরি করেছে! কিন্তু ধরা খেয়েও স্বীকার করছেনা। সবার সম্মিলিত হৈ চৈ এর মধ্যেই আমার সাতাশ’র ঘরে বসে থাকা গুটি মুন্নির বিরাশি’র ঘরের গুটির সাথে চেইঞ্জ করে ফেললাম। ফরহাদের সাথে কোনো রকম একটা মিটমাট করে মুন্নি দাল চালতে গিয়েই…… ‘চোররর! আপুকে ধরো!’
আমি এক দৌঁড়ে ততক্ষনে ফুপুর আঁচলের তলে!
খেলায় জিততে না পারলে অন্তত খেলা ভেঙ্গে দিয়ে চলে আসাই মনে হয় সবচে সহজতর।
রাতে শাহানার সাথে নুরু ফুপুর বাড়ি। আমার অন্যতম প্রিয় জায়গা। বাড়ির উঠোন পেরিয়ে বাধঁ এবং বাঁধের উপর দাঁড়ালেই সাগর। এদিকের বীচ আইসোলেটেড। এটা যেন আমাদের বাড়ির সমুদ্র।
নিজেদের একটা সমুদ্র থাকে ক’জন মানুষের?
খুব ভোরে শাহানাকে জোর করে ঘুম থেকে তুলে ডেকে নিয়ে এলাম বাঁধের উপর। ভীষন শীত। সাথে হালকা কুয়াশা। সাগর শান্ত। পানির পরে পানি। তারোপরে পানি।
যতদূর চোখ যায় সাগরের গাঢ় নীলিমায়
সকাল বেলার রোদ পাখি হয়ে যায়……
কে বলেছিল? জীবনানন্দ?
আপাতত আমাদের সমুদ্রে আমিই জীবনানন্দ হয়ে যাই।
আকাশ, সমুদ্র আর আমি……. শাহানা চাদর মুড়ি দিয়ে শুধু দুইটা চোখ বের করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সমুদ্রের পাশে রাত দিন থেকে থেকে ও কিছুতেই বুঝেনা আমি সমুদ্রের কাছে আসার জন্যে এমন পাগল হয়ে যাই কেন।
কান আর মাথা আরো ভাল করে ঢেকে নিয়ে আবার তাকায় আমার দিকে।
জিজ্ঞেস করে-‘কী দেখ?’
‘সমুদ্র’
‘দেখার কী হইল এইটা?’
‘মনের চোখ খোলো। তুমিও দেখবা’।
‘হ, কাম কাজ নাই’।
আমি চুপ।
‘তোমরা শহরের মানুষ সব আজাইরা। সমুদ্রের পাশে আইসে তাকায়ে থাকো ঘন্টার পর ঘন্টা। লাভটা হয় কি? এখানে থাকবার বললে তো আবার থাকোনা!’
আমি কিছু বলিনা, যদিও বুকের গহীন থেকে বলতে ইচ্ছা করে- আমাকে রেখে দে শাহানা! বিশ্বাস কর, আমি থেকে যাব!
কিন্তু আমি কিছু বলিনা।
বালুতে পা ঘষে ঘষে হাঁটি। বালুতে নকশা হয়ে যায়। একটু দূরে গিয়ে সেই নকশাই মুগ্ধ হয়ে দেখি। রোদ উঠে।
বাঁধের উপর থেকে মোজাম্মেল ডাকছে। ফুপু পিঠা বানিয়েছে।
ফিরে এসে উনুনের তাপের কাছে বসি।
ভাঁপা পিঠা।
ফুঁপু যত্ন করে খাওয়ায়। খেতে খেতেই বলে- ‘পাগলামী করেই জীবন পার করবা? বড় হবানা?’
আমার কথা বলতে ইচ্ছা করেনা। গরম গরম ভাঁপা পিঠা একটু একটু করে ভেংগে মুখে দেই আর মাথা উঁচু করে বাঁধের উপর দিয়ে সমুদ্র দেখতে চেষ্টা করি।
‘কথা বলনা ক্যান। ফুপু খারাপ তো বলিনাই। জীবনটা গাংগের নাও না। যেমনে ভাসাইলা তেমনে ভাসবো না। বানের পানিতে না ডুবলে মানুষে ফুটা করে ডুবাই দিবে'।
আমার মুখ ভর্তি ভাঁপা পিঠা।
ফুপুর দর্শনের সাথে উনুনের ভাঁপ আমাকে উষ্ণ করে তুলে। একবার ইচ্ছা হয় বলি -বক বক করো নাতো ফুপু!
বলা হয়না। কাছের মানুষদের স্নেহের অত্যাচার মাথা পেতে নেয়াই নিয়ম।
ঠান্ডা এক ঝলক বাতাস উনুনের ছাই উড়িয়ে নিতে চায়। ফুপু ব্যাস্ত হয়ে পড়ে। আমি নিশ্চিন্ত মনে আরেকটা ভাঁপা পিঠা হাতে নিয়ে উষ্ণতার ছোঁয়া পেতে চেষ্টা করি……
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জুলাই, ২০০৮ ভোর ৬:৫৯