ভোর ছয়টা।
‘শেষ পর্যন্ত যাচ্ছিসই তাহলে?’
‘এত চিন্তা করছিস কেন? বড়ভাইয়া যাচ্ছেতো সাথে’।
‘তাতো বুঝলাম, কিন্তু এভাবে হরতালের মধ্যে যাওয়াটা ঠিক হচ্ছেনা’।
‘ধ্যূৎ, এতো চিন্তা করিস নাতো!’
‘নিজের খেয়াল রাখিস’।
‘রাখব’।
‘ভাল থাকিস’।
‘ওকে বাবা! ভাল থাকব!’
সানি মানা করেছিল হরতালে ঢাকা যেতে। কিন্তু নো ওয়ে, দুইবার টিকেট চেইঞ্জ করা হয়েছে অলরেডি। তৃ্তীয়বারেও হরতাল! এদিকে বন্ধও ফুরিয়ে আসছে। এখনি না গেলে আরে বাসায় যাওয়াই হবেনা এ বন্ধে।
সকাল সাতটা পাঁচ।
পাঁচমিনিট দেরীতে ট্রেন চলতে শুরু করেছে। আমাদের জাতিগত বৈশিষ্ট। অন্ততঃ একমিনিট হলেও দেরীতো করতেই হবে! যাত্রার শুরুতেই ওয়ার্নিং- “সম্মানিত যাত্রীবৃন্দ, নিরাপত্তার সুবিধার্থে আপনার পাশের জানালার শাটার বন্ধ করে দিন”। ছোটকাল থেকে দেখে শিখেছি ‘যে নীতিকথা শুন্ছ, ঠিক তার উল্টোটা কর’। ‘নো পার্কিং’ এর জায়গায় ঠেলে ঠেলে গাড়ি রাখা, ‘এখানে পস্রাব করা নিষেধ’ লেখা দেয়াল বরাবর পস্রাব করা আমাদের জনসাধারণের প্রিয় অভ্যাস্। তাই আমিও ওয়ার্নিং এক কান দিয়ে শুনে আরেক কান দিয়ে বের করে দিলাম। আরাম করে বসে ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখতে দেখতে হঠাৎ করে খেয়াল হল, সকালে বের হওয়ার আগে তাড়াহুড়ায় নাস্তা করতে ভুলে গেছি! এখনি পেট খালি খালি লাগছে!
সকাল সাতটা চল্লিশ।
যথারীতি যাত্রীদের মধ্যে শুরু হয়ে গেছে হরতাল বিতর্ক। আমাদের দু’সিট পরেই মধ্যবয়সী এক ভদ্রলোক নেতাদের মত হাত উঁচিয়ে বলছেন, ‘আরে ভাই, সরকার দেশ চালাতে না পারলে বিরোধী দলের হরতাল না ডেকে উপায় আছে?’
‘সেকি কথা! দেশ আবার থেমে থাকলো কখন? এই যে আমাদের ট্রেন চলছে, আমরা ঢাকার দিকে যাচ্ছি, দেশ না চললে এসব চলছে কীভাবে ভাই?’
‘আরে রাখেন মিয়া এসব তর্কাতর্কি। সরকার আর বিরোধীদল, দুটাই একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। গতবারতো বিরোধীদল সরকারে ছিল। তখন কেমন বাঁশ মেরেছে জনগনকে এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলেন?’
‘আসল কথা হচ্ছে………’
জমে উঠল তর্ক। বাইরে তাকিয়ে আছি। একজন বিদেশী বন্ধু বলেছিল- ইউ গাইজ ইউরসেলফ্ আর কিলিং ইউর কান্ট্রি! বন্ধু তুমি ঠিকই বলেছিলে।এরচেয়ে বড় সত্য বুঝি আর কিছু নেই।আমরা নেতাদেরকে নিয়ে তর্ক করি, তাদের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করি, আবার আমরাই এইসব কুলাংগার নেতাদেরকে ক্ষমতায় পাঠাই।
বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে চিন্তা হতাশাজনক। খালি পেটে হতাশা জমে গিয়ে আমার আবার ঘুম পেতে লাগলো!
সকাল দশটা পনের।
এইমাত্র ঘুম ভাংগলো পুলিশের ধমক্ খেয়ে।‘শাটার খোলা রেখেছেন কেন? বোমা মারলে বুঝবেন!’
ইচ্ছা হল জিজ্ঞেস করি ‘আপনারা থাকতে এরা বোমা মারার সাহস পায় কোথা থেকে?’ কিন্তু ইচ্ছা পূরণ করা হলনা।কারন পুলিশটার রামছাগলের মত গম্ভীর চেহারা দেখে মনে হল রেগে গেলে অদৃশ্য শিং দিয়ে গুঁতা মারতে পারে!
ঘুম পুরোপুরি চোখ থেকে চলে যাওয়ার পর টের পেলাম ট্রেন থেমে আছে! ট্রেনের ভিতর আবছা অন্ধকার।কারন সব জানালা বন্ধ। বড়ভাইয়াও আমার মত ঘুম ভেংগে উঠেছে মাত্র। আমরা দু’জনেই হতভম্ব।ট্রেন এ্যাটাক্ করেছে নাকি?!
সকাল দশটা আঠার।
ট্রেন এ্যাটাক্ করেছে। রেললাইনের স্লিপার তুলে ফেলেছে পিকেটাররা। এক একজন এক একরকম খবর দিচ্ছে। কিন্তু বাইরে আসলে কী হচ্ছে বুঝার উপায় নেই।জানালা খুলতে গেলেই যাত্রীরা সবাই হৈ হৈ শুরু করছে, যেন খোলার সাথে সাথে বোমা বিড়ালের মত ‘হাঁউ’ করে লাফ্ দিয়ে ঢুকে পড়বে!
বাচ্চারা ভয়ে কান্নাকাটি শুরু করেছে। বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা!
সকাল দশটা একুশ।
নতূন গুজব, পিকেটাররা ইঞ্জিনরুম আর এসি কম্পার্টমেন্টে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে! দ্রুত আতংক ছড়াচ্ছে। টের পাচ্ছি আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেছে। সবাই জোর বলাবলি করছে গতকালের আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় আহত আওয়ামী নেতা মারা গেছে, তাই এত কঠোর পিকেটিং। অনেকেই ভয়ে নেমে যাচ্ছে ট্রেন থেকে। আমরা এখনো নামিনি। বড়ভাইয়া জানাল দিয়ে পরিস্থিতি বুঝার চেষ্টা করছে। আমরা প্রায় শেষের দিকের বগিতে।ট্রেনের সামনের দিক থেকে ঘন কালো ধোঁয়া উঠে ভরে যাচ্ছে চারপাশ। ট্রেন ভৈরব্ ব্রীজের পাশে অনেকটা উঁচু পাহাড়ী জায়গার উপর দাঁড়িয়ে আছে। আগুন ছড়াচ্ছে। হুড়োহুড়ি করে নেমে যাচ্ছি সবাই। এখন কী হবে?!
সকাল দশটা ঊনত্রিশ।
কাছেই পুলিশ ফাঁড়ি। দৌঁড়াদৌঁড়ি করে সবাই পুলিশ ফাঁড়িতে এসে দাঁড়িয়েছি। এখান থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে আগুনের ভয়াবহ কেরামতি! ভল্কে ভল্কে উঠে যাচ্ছে কালো ধোঁয়ার কুন্ডুলী। নেতায় নেতায় ক্ষমতা নিয়ে কাড়াকাড়ি, নষ্ট হয় জনগণের সম্পত্তি। কী মানে আছে এসবের?
দাঁড়িয়ে আছি পুলিশ ফাঁড়িতে, কিন্তু একটা পুলিশের নামগন্ধ নেই! শুনলাম একটু আগেই পিকেটারদের তাড়া খেয়ে পালিয়েছে পুলিশ। আশ্চর্য হলাম না। না পালালেই বরং আশ্চর্য হতাম। খেয়াল হল, ট্রেনের ভিতর জানালার শাটার বন্ধ করার পরে সেই রামছাগলও উধাও হয়ে গিয়েছিল। একেই বলে সোনার দেশের সোনার পুলিশ!
সকাল দশটা একচল্লিশ।
অনিশ্চিত্ দাঁড়িয়ে আছি সবাই। প্রচন্ড গরমে ঘামে জবজব করছে সবার গায়ের কাপড়। এরই মধ্যে হঠাৎ একটু দূরে চিৎকার, হৈ চৈ! আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখে বড়ভাইয়া দেখতে গেল ব্যাপারটা কী। ফিরে এসে বলল- এইমাত্র একটা ছেলের মোবাইল চুরি হয়ে গেছে! বড়ভাইয়ার কথা শেষ হতে না হতেই আরেকজনের ব্যাগ! সবাই যার যার জিনিষ দ্রুত সামলে নিতে লাগলো।
আমি হতবাক্ হই। দুঃশ্চিন্তার সাথে যুক্ত হয় মন খারাপ। আসলেই কি মানুষগুলো দিনদিন মৌ্লিক মানবিকতা হারিয়ে ফেলছে? একজনের বিপদে আরেকজনের পাশে এসে দাঁড়ানোর দিন সত্যিই ফুরিয়ে গেছে?
তাহলে ভবিষ্যতের মানুষগুলো বাঁচবে কী করে?!
সকাল এগারটা বার।
এখনো কেও কোনো ডিসিশান নিতে পারছেনা কী করবে। সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি। ক্ষুধাও লেগেছে খুব! পা টনটন্ করছে।মোবাইলেও নেটওয়ার্ক নেই! এমন সময় পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ফ্যামিলির কথোপকথনঃ
স্বামীঃ কতবার মানা করলাম এই পরিস্থিতিতে বের হতে। শুনছ আমার কথা? এবার বুঝ!
স্ত্রীঃ মাথা গরম করছ কেন? বিপদে কি আমরা একা পড়ছি?
স্বামীঃ হুঁ! একেই বলে স্ত্রী-বুদ্ধি!
স্ত্রীঃ পিন মারবানা বললাম। তোমার সাথে এখন ঝগড়া করতে চাইনা।
স্বামীঃ হ্যা, ভালো কথা বললেওতো তোমার মনে হয় ঝগড়া করছি!
ওদের ঝগড়া চলছে। বুঝলাম, যে কোনো পরিস্থিতিতে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপাতে যারা ওস্তাদ, এই ভদ্রলোক সেইসব পরগাছা শ্রেনীর একজন।
মনযোগ অন্যদিকে ফিরালাম।
একটা বাচ্চা খেলছে নিজে নিজে। এই পরিস্থিতে বাচচাটা বেশ মজা পেয়েছে! ওর মা ধরে রাখতে পারছেনা ওকে। মাকে ফাঁকি দিতে পেরে বাচ্চাটার সেকি খুশী!
বাচ্চাটাকে দেখছি, তখনি পিছন থেকে কানে এল,
‘মামা, এভাবে কতক্ষন?!’
‘চুপ কর্! ঘ্যান ঘ্যান করবিনা। সব দোষ তোর মায়ের। এত করে বললাম আমার সাথে কানাডা যাইতে, তোর মা শুনছে আমার কথা? দেশ ছেড়ে যাবেনা, এখন দেখ দেশ কেমন লাগে? এইটা একটা দেশ??’
খারাপ হয়ে থাকা মনটা আরো খারাপ হয়ে গেল।
এইযে শিশুটা খেলছে, ও যখন বড় হবে, দেখবে কী ভীষন অরাজকতা চলছে দেশ জুড়ে, তখন এ শিশুও হয়তো বলবে তার মাকে ‘চল মা,দেশের বাইরে চলে যাই’।
তখন কি খুব অন্যায় হবে?
কিন্তু সবাই যদি এভাবে চলে যায়, তাহলে কে পরিবর্তন করবে এইসব অনিয়মের? বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাক্ততেই নিজেকে স্বান্তনা দিতে চেষ্টা করি। না, এ শিশু হয়তো ঐ মামার মত হবেনা। হয়তো এ শিশুই তার মাকে বলবে, ‘অনুমতি দে মা, যুদ্ধে যাই’। দেশ গড়ার যুদ্ধ। এ শিশু থেকেই হয়তো আমরা পেয়ে যাব বাংলাদেশের মাহাথির। পৃথীবি তখন বিপুল বিষ্ময়ে দেখবে, মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশ!
পূনশচঃ অনেক ঘটনা-দূর্ঘটনার মধ্য দিয়ে আমি আর বড়ভাইয়া ঢাকা পৌঁছি পরদিন সকাল দশটায়!