রানি ভানুসিংহীর ব্লগে প্রথম পোস্ট করা কবিতার নাম ‘আমার ফুলবাগানের ফুলগুলিকে।’
আমার ফুলবাগানের ফুলগুলিকে বাঁধবো না আজ তোড়ায়—
রং-বেরঙের সুতোগুলো থাক্,
থাক পড়ে ওই জরির ঝালর।।
শুনে ঘরের লোকে বলে,
যদি না বাঁধো জড়িয়ে জড়িয়ে
ওদের ধরবো কী করে—
ফুলদানিতে সাজাবো কোন উপায়ে?’
আমি বলি,
‘আজকে ওরা ছুটি-পাওয়া নটী,
ওদের উচ্চহাসি অসংযত,
ওদের এলোমেলো হেলাদোলা
বকুলবনে অপরাহ্ণে,
চৈত্রমাসের পড়ন্ত রৌদ্রে।
আজ দেখো ওদের যেমন-তেমন খেলা,
শোনো ওদের যখন-তখন কলধ্বনি,
তাই নিয়ে খুশি থাকো।’
বন্ধু বললো,
‘এলাম তোমার ঘরে
ভরা পেয়ালার তৃষ্ণা নিয়ে।
তুমি খেপার মতো বললে,
আজকের মতো ভেঙে ফেলেছি
ছন্দের সেই পুরোনো পেয়ালাখানা!
আতিথ্যের ত্রুটি ঘটাও কেন?’
আমি বলি, ‘চলো-না ঝরনাতলায়,
ধারা সেখানে ছুটছে আপন খেয়ালে—
কোথাও মোটা, কোথাও সরু।
কোথাও পড়ছে শিখর থেকে শিখরে,
কোথাও লুকোলো গুহার মধ্যে।
তার মাঝে মাঝে মোটা পাথর
পথ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে বর্বরের মতো,
মাঝে মাঝে গাছের শিকড়
কাঙালের মতো ছড়িয়েছে আঙুলগুলো—
কাকে ধরতে চায় ওই জলের ঝিকিমিকির মধ্যে!’
সভার লোকে বললো,
‘এ যে তোমার আবাঁধা বেণির বাণী—
বন্দিনী সে গেলো কোথায়?’
আমি বলি, ‘তাকে তুমি পারবে না আজ চিনতে;
তার সাতনলী হারে আজ ঝলক নেই,
চমক দিচ্ছে না চুনি-বসানো কঙ্কণে।’
ওরা বললো, ‘তবে মিছে কেন?
কী পাব ওর কাছ থেকে?’
আমি বলি, ‘যা পাওয়া যায় গাছের ফুলে
ডালে-পালায় সব মিলিয়ে।
পাতার ভিতর থেকে তার রং দেখা যায় এখানে সেখানে,
গন্ধ পাওয়া যায় হাওয়ার ঝাপটায়।
চার দিকের খোলা বাতাসে দেয় একটুখানি নেশা লাগিয়ে।
মুঠোয় করে ধরবার জন্যে সে নয়,
তার অসাজানো আটপহুরে পরিচয়কে
অনাসক্ত হয়ে মানবার জন্যে
তার আপন স্থানে।’
এ কালে রমণীগণের মধ্যে সাহিত্যচর্চাকারিণীর সংখ্যা একান্তই অপ্রতুল। এটা সকলেই জানেন যে সাহিত্য ও কলা শিক্ষিতা নারীকে যতটা না আকর্ষণীয় করে তোলে, তার চেয়ে বেশি করে লোভনীয়, এবং তারও চেয়ে বড়ো তাৎপর্য এই যে এ গুণগুলো তাকে করে তোলে অনন্যসাধারণা; এটা রানি ভানুসিংহী ভালো করেই জানেন। আরো জানেন, এজন্যই তাঁর বাগানের ফুলগুলিকে নিয়ে লেখা কবিতায় বর্তমানের কবিকুল বিশেষ দৃষ্টি দেবেন।
কবিতাটি ব্লগে প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গে সচরাচর প্রমীলা ব্লগারদের ক্ষেত্রে যা হয়, ঠিক তাই ঘটলো। তামাম ব্লগার, কবিতা বোঝুন আর না-ই বোঝুন, ঝাঁকে ঝাঁকে এসে মুহূর্তে শ-খানেক কমেন্টে প্রশংসার বন্যা বইয়ে দিল। এ দেখে দেমাকি এবং আঁতেল গোত্রীয় ব্লগারগণ বরাবরই ঈর্ষায় জ্বলেপুড়ে মরেন, কারণ তাদের ‘ক্লাসিক কবিতাপোস্টে’ কোনো কমেন্ট নেই— মরুভভুমির মতো তা খাঁ-খাঁ করে।
প্রমথ চৌধুরী কবিতাটা বার কয়েক মনোযোগ দিয়ে পড়েও কিছু উদ্ধার করতে না পেরে লিখলেন: বাঃ! জটিল হো গিয়া!
পূর্ণেন্দু পত্রী কবিতাটা পড়ে হাসলেন। তারপর লিখলেন: কবিতা খুব সহজলভ্য বস্তু নয় মহাশয়া। আমরা তো আপনাদের জন্য কবিতা লিখছি, তা থেকে কিছু কিছু পড়তে হবে তো, নইলে কবিতা আসবে কেন?
বুদ্ধদেব বসু ঘুম থেকে উঠেই পিসি অন করে ব্লগে ঢুকলেন চোখ ডলতে ডলতে। তিনি খুব বিরক্ত হলেন। লিখলেন: কী লিখেছেন? মাথামুণ্ডু কিছু হয়েছে বলে মনে হয় আপনার? আমাদেরকে নিষ্কৃতি দিন, দয়া করে ব্লগে এসব ছাইপাশ পোস্ট করবেন না। আমি কবিতার বিপ্লব ঘটাতে যাচ্ছি। রবীন্দ্রনাথকে ঢেকে ফেলবো।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বেজার হলেন না। লিখলেন: বাক্যগুলো আরো প্রাঞ্জল করে লিখুন। আপনার দ্বারা হলেও হতে পারে।
শক্তি চট্টোপাধ্যায় : রমণীরা যুগে যুগে সাহিত্য রচনা করেছেন। কিন্তু তাঁদের লেখায় কোনো সাহিত্যমূল্য নেই। তথাপি তাঁরা এত নাম কুড়ালেন, তাঁর কারণ কিছু লুলকবি তাঁদেরকে ‘বাহবা’ দিতে দিতে গাছের আগায় উঠিয়ে দিয়েছেন। কবিতা লিখা আপনার দ্বারা অসম্ভব। তবে পরামর্শ দিই আপনাকে, রবীন্দ্রনাথ আর কাজী নজরুলের লেখাগুলো বেশি করে পড়ুন।
এমন সময় জীবনানন্দের প্রবেশ: কবিতা না বুঝলেই তাকে আবর্জনা বলার পক্ষপাতী আমি নই। রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় তাঁকেও লোকেরা অনেক খোঁচা দিত। আপনারা তো আমার কবিতাকে কবিতাই বলতে চান না। তবে, রানি ভানুসিংহীর এই কবিতাটা আমার কাছে খুব ভালো লেগেছে। অভিনন্দন মহাশয়া।
হুমায়ুন আজাদ: ব্লগে ‘কবিতা লিখবার সহজ উপায়’ শীর্ষক সিরিজ লিখতে যাচ্ছি শীঘ্রই। আপনাদের কথা মাথায় রেখেই এ কাজটা করতে যাচ্ছি যাতে আপনারা উপকৃত হতে পারেন। আর আপনার এ কবিতাটি সম্পর্কে কিছু বলছি না এ মুহূর্তে— তবে এক কথায় বলতে গেলে এটাই বলবো, আপনার হাত বড্ড কাঁচা।
তখন রবীন্দ্রনাথের আত্মা ব্লগে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। হঠাৎ তাঁর চোখ পড়ে ‘আমার বাগানের ফুলগুলিকে’ নামক একটা কবিতার উপর। তিনি দেখেন ‘রানি ভানুসিংহী’ নামক জনৈকা ব্লগার এ কবিতাটাকে তাঁর নিজের ব্লগে স্বনামে পোস্ট করেছেন। তিনি হাসবেন, নাকি কাঁদবেন, এ কথা ভাবতে ভাবতে যখন হাটে হাঁড়ি ভাঙার উদ্দেশ্যে লগিন করে একটা কমেন্ট লিখে ‘সাবমিট’ করলেন, অমনি ব্লগে ‘চিরাচরিত’ ‘বাগ-বিষয়ক’ ম্যালফাংশান শুরু হয়ে গেলো। তিনি যতবার কমেন্ট সাবমিট করলেন, কেবলই ‘৫০২’সমেত ‘সার্ভার বিজি’ লিখা উঠে আসতে লাগলো। অবশেষে ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে নিজের সুবিশাল সাহিত্যভাণ্ডার থেকে ‘একটামাত্র কবিতা খোয়া গেলে কোনো বিরাট ক্ষতি হয় না’ মর্মে নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ব্লগ ছেড়ে চিরতরে হারিয়ে গেলেন।
২৯ আগস্ট ২০১৩
।
।
।
ধাঁধা
আন্দাজ করুন তো, কে এই রানি ভানুসিংহী! এই গল্পে আর কোনো রহস্য আছে কি? এ পর্যন্ত কেউ সেই রহস্যের ধারেকাছেও যান নি, বলা যেতে পারে, যেতে পারেন নি
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৭ রাত ১০:৫৯