'ক'-তে তসলিমা নাসরিন খুব করুণ একটা স্মৃতিচারণ করেছেন বইমেলায় তাঁর প্রথম বই সম্পর্কে। ক'শ বই বিক্রি হয়েছিল, কারো কি মনে আছে? বা জানেন? প্লিজ মনে করতে থাকুন।
বইমেলায় নিজের বই বিক্রি হওয়া নিয়ে হা-হুতাশ করা বোকামি। বাংলাদেশে বই বিক্রির হার কোনোদিনই আশাব্যঞ্জক ছিল না; একটা গোপন ও র্যান্ডম সার্ভে করে দেখুন- আপনার পরিচিত প্রতি ১০জন লোক গত এক বছরে একেক জনে ক'টি করে বই পড়েছেন। দয়া করে অবাক হবেন না, চিত্রটা এরকমই। প্রমথ চৌধুরী, সৈয়দ মুজতবা আলী, প্রমুখ মহারথীদের শতাব্দী থেকেই বাংলাদেশে বই পড়া ও বই কেনার হালচিত্র এরকম।
আমি যখনই মনে করবো আমি একজন চ্যাম্পিয়ন লেখক বনে গেছি, সেদিন থেকেই আমার লেখার মান থমকে যাবে না শুধু, তা ডিক্লাইন করা শুরু করবে। বিনয় কী জিনিস, আমরা তা সহজেই ভুলে যাই। আমাদের মধ্যে খুব দ্রুত উবে যায় কৃতজ্ঞতাবোধ; কৃতজ্ঞতা কাকে বলে আমরা জানি না।
আমার কথাবার্তায় যখন ম্যাচিউরিটির বদলে চ্যাম্পিয়নগিরি প্রকাশ পাবে, তখন থেকেই আমি গুণী ও সিনিয়রদের স্নেহ ও ভালোবাসা এবং সান্নিধ্যবোধ হারাতে থাকবো।
বুকস্টলের সামনে দাঁড়িয়ে বন্ধু বা পরিচিত জনদের এ কথাটা বলতে আমার লজ্জা করা উচিত যে আমার একটা বই বেরিয়েছে। কিন্তু আমি ভাব দেখাই, আমি খুব বড় লেখক বনে গেছি। আমার কথায় পাকামি, ব্লগ ও ফেইসবুকে স্টেটাস লেখার সময় ভাবি না আমার ইঁচড়ে পাকামি প্রকাশ পাচ্ছে, গুণীরা দেখেন কীভাবে ধীরে ধীরে আমি প্রচারসর্বস্ব লেখক হয়ে যাচ্ছি, কোয়ালিটি রাইটার নয়।
আমার পাঠক ও ফ্রেন্ডলিস্ট বন্ধুদের আগে কিছু মধুর শব্দ যোগ করতে হবে : সহৃদয়, সুপ্রিয়, প্রিয়। সম্বোধন করে বলুন- 'সহৃয় পাঠকবন্ধুরা ...।' আপনার লেখায় সমাজচিত্র নেই, কিন্তু কথায় কথায় আপনি 'সমাজ'-এর উল্লেখ করেন- আপনার লেখা পড়ছি অনেক বছর ধরে, আপনি আদৌ এমন কোনো লেখক হয়ে ওঠেন নি, যিনি গুণগত মান অর্জন করতে পেরেছেন।
কিছু 'প্রসিদ্ধ' লেখকের মুখবন্ধ আমার বইয়ের ফ্ল্যাপে যুক্ত করে দিলেই আমি প্রসিদ্ধ হয়ে গেলাম না। আমার প্রসিদ্ধির ভিত্তি আমার লেখা।
'লোকে যারে বড় বলে বড় সেই হয়।' বহু প্রাচীন কথা। অথচ আমি সবসময় নিজেকে খুব 'বড়', 'প্রবীণ' মনে করছি; কিন্তু আমার বয়স আর লেখা এখনো নবীন, ইম্ম্যাচিউর। আমার লেখা শত শত নবীন লেখকদের কাতার থেকে সামান্য উপরে ওঠে নি। হুট করে দেশখ্যাত হতে চাওয়া খুব বেশি হয়ে যায়। লেখালেখি পেশা হিসাবে নেয়ার মতো ট্যালেন্টেড নবীন-প্রবীণ কোনো লেখক বর্তমানে বাংলাদেশে নেই; এই কালচার বাংলাদেশে গড়ে ওঠে নি; আমাদের পড়ার অভ্যাস না থাকার কারণে।
আপনার বই যদি পুরো বইমেলা জুড়ে ১০ কপি বিক্রি হয়, এটা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকুন। লেখক হিসাবে এখনো নাক টিপলে আপনার জন্মদুধ বের হয়, কিন্তু আপনি হুমায়ূন আহমেদ বা মুহম্মদ জাফর ইকবালকে ছুঁতে চাইছেন, এটা একটা আকাশছোঁয়া ইচ্ছে। প্রতিদিন বইমেলায় এসে ভাববেন আপনার বইয়ের শত শত কপি বিক্রি হবে, এটা মাছমাংস বা শাকসবজি, চালডাল না, যার ডালা সাজিয়ে বাজারের শুরুতে বেচতে বসেছেন, বাজার শেষে বিক্রি শেষ করে ঘরসংসারের চালডালতরকারি কিনে বাসায় ফিরবেন। আপনি একজন লেখক এবং লেখকরা মহৎ হবেন, এটা মনে রাখুন। এটা মনে না রাখলে আপনি সেই তথাকথিত 'সস্তা বাজারি লেখক।' কিন্তু সস্তা বাজারি লেখক হতেও আপনার অনেক সময় লাগবে।
আমরা লেখক হিসাবে দ্রুত খ্যাতি অর্জনের জন্য অনেক সহজ ও চতুর পন্থা অবলম্বন করি। আপনাকে অয়েলিং করে আপনার ছত্রছায়ায় আপনার দৈনিকে একটা সাময়িক এক্সপোজার পাব। কিন্তু আপনি দেখছেন, আমি ফাঁপা। বাকিরা চোখে আঙুল দিয়ে আমাকে দেখাচ্ছেন, আমি কী চালাকি করে তরতর করে উপরে যাবার রাস্তা খুঁজে বেড়াচ্ছি।
পুশ সেল না করলে যাঁরা আমার বই কিনবেন, তাঁরা আমার প্রকৃত পাঠক, প্রকৃত ক্রেতা ও আন্তরিক বন্ধু।
বইমেলায় গিয়ে তিনি স্টলের সামনে ঘোরাঘুরি করতেন, বুকশেলফের যে জায়গায় আগের দিন তিনি নিজের বইটা দেখে গিয়েছিলেন, সেদিকে তাকাতেন না ভয়ে, যদি দেখেন কেউ তাঁর বইটা ধরেন নি, হাতে নিয়ে নাড়েন নি, এমনকি প্রকাশকও বইটার ধুলো ঝেড়ে সরিয়ে রাখেন নি। এটা তাঁকে খুব কষ্ট দিবে। প্রথম বইমেলায় সর্বসাকুল্যে তাঁর একখানা বই বিক্রি হয়েছিল। নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন, এ গল্প তসলিমা নাসরিনের।
যাঁরা নিজে বড় হওয়ার জন্য বাংলার যুগশ্রষ্ঠাদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে কথা বলছেন, তা আপনাদের লেখা পড়লেই বোঝা যায়। মাইকেল, রবীন্দ্র, নজরুল, জসীম কোনোদিন কি বলেছেন- আমিই যুগের সেরা লেখক? এটা পাঠকের সৃষ্টি। পাঠকের মনের ভিতর যেতে হবে নিজের লেখার মান দিয়ে, কাউকে ঠেলে ফেলে নয়।
আমার প্রথম বই 'স্খলন' ২০০৩ সালের বইমেলায় ৫০০ কপি ছাপা হয়, ১০ কপির মতো বিক্রি হয়, ৪০০ কপির উপরে সৌজন্য কপি বিলি করি বাংলাদেশের প্রায় সব পাবলিক ও পরিচিত বড় লাইব্রেরিতে কুরিয়ার করে সৌজন্য কপি পাঠিয়েছি; কলিগ ও বন্ধুদের পাঠিয়েছি।
ছাত্রজীবনে আমার অকল্পনীয় অর্থকষ্ট ছিল, তাই কিনে বই পড়তে পারি নি। আমার ক্লাসমেট খবির আর জাহিদ আমাকে বই দিত; ওরা আমার লেখার সমঝদার ছিল। শফিক স্যার আমাকে লেখার জন্য খুব উৎসাহ দিতেন। উৎসাহ দিত ক্লাসমেট করিম আর শাহজাহান। করিম আমার কবিতার এতই অনুরাগী ছিল যে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ও আমার কবিতা আবৃত্তি করতো। ওর আবৃত্তি খুব ভালো। ও পড়েছে অনেক অনেক বেশি। বই বেচে টাকা কামাবো, এটা আমি তখন বা এখনো ভাবি না। আল্লাহ আমাকে টাকা কামাবার বৈধ বড় উৎস দিয়েছেন। সেই টাকা দিয়ে নিজের ১০টা বই ও ১৫টি সংখ্যা 'সবুজ অঙ্গন' লিটল ম্যাগাজিন ছেপেছি, নিজের টাকায় সৌজন্য সংখ্যা কুরিয়ার করেছি।
এত কিছুর পরও খবির, করিম, জাহিদ আর শাহজাহানের ঋণ কোনোদিন শোধ করতে পারবো না। একজন মহৎ লেখক হওয়ার চেয়ে ওদের মাহাত্ম্য অনেক গুণ বেশি। আমি যাঁদের কাছে ঋণী তাঁদের ঋণ কখনো শোধ করবো না; এই ঋণ আমাকে সারাজীবন 'বিনয়ী' করে রাখবে। মানুষের ঋণ স্বীকারের নাম কৃতজ্ঞতা। কৃতজ্ঞতা প্রকাশে আমি সুখ পাই।
আমার খুব চোখলজ্জা ছিল, কারো সামনে এটা বলা যে একুশে বইমেলায় আমার একটা বই বেরিয়েছে।
আপনি কি লেখককে চিনেন? তাঁকে জিজ্ঞাসা করুন তাঁর বইয়ের ব্যাপারে। তাঁর বইয়ের অন্তত একটা কপি কিনুন। ১৩০ টাকার বইয়ের মূল্য হলে লেখকের পকেটে ১৫০ টাকা গুঁজে দিন- এমনভাবে যাতে লেখক বিব্রত না হোন। আপনি হয়ত জানেন না, ৫ ফর্মার (১ ফর্মা = ১৬ পৃষ্ঠা) ৩০০ কপি নতুন বই ছাপবার জন্য একজন নতুন নবীন লেখককে প্রকাশকের পকেটে দিতে হয়েছে কমপক্ষে ৩৫ হাজার টাকা; আমাদের প্রকাশকরা সত্যিই খুব নির্দয়; তাঁরা প্রতি ফর্মায় ৭ হাজার টাকা করে নিবেন বই ছাপাবার জন্য (৩০০ কপিতে); বই বিক্রির সমুদয় টাকাও নিজের পকেটেই রাখবেন; এ টাকার রয়েলটি লেখককে হস্তান্তরের কথা তাঁরা ভুলে যাবেন বইমেলার নানাবিধ ব্যস্ততার কারণে। বুকস্টলের সামনে গিয়ে লেখকের একটা 'সৌজন্য কপি'র জন্য হা করে বিটকেলে হাসি হাসতে থাকবেন, জানেন না আয়নায় সেই প্রতিবিম্ব কতটা জঘন্য দেখায়।
সারা বছর জুড়ে আমাদের সৃজনশীল বইয়ের বাজার খুব খারাপ। প্রকাশকরা বই বিক্রি করে সারাবছরের মূলধন তোলেন নবীন লেখকদের বই প্রকাশ করে তাঁদের কাছ থেকে ছাপাখরচ তুলে ও তাঁদের বইয়ের বিক্রিলব্ধ টাকাও নিজেদের কাছে রেখে দিয়ে। নামিদামি লেখকদের বই ছাপতে হয় প্রকাশকদের নিজেদের টাকায়, সেই লেখকদের রয়েলটি দিতে হয়; তাঁদের রয়েছে জীবিকা নির্বাহ। এই টাকা আসে মূলত নবীন লেখকদের পকেট থেকে, আর তাঁদের বই বিক্রি করা অর্থ থেকে। সব প্রকাশনির অবস্থা যে এমন তা নয়, বড় বড় প্রকাশকরা মূলধন ও সম্মানে এমনিতেই শীর্ষে অবস্থান করছেন।
যে-সব লেখক বুক ফুলিয়ে বলেন, আমি নিজের খরচে বই ছাপি না, তাঁদের বেশিরভাগই অসত্য কথা বলেন। অনেক লেখক নিজেদের দাম বাড়ানোর জন্য এ ধরনের কথা বলে থাকেন। গোপনে খোঁজ নিয়ে দেখুন, তাঁরা কত আগে থেকে কিস্তিতে বইয়ের ছাপাখরচ প্রকাশককে পরিশোধ করে আসছেন। প্রকাশককে যদি বইয়ের ছাপাখরচ না দেন, প্রকাশনা-শিল্প ধংস হয়ে যাবে। সবসময় সবার সামনে অর্থহীন বড়াই করা উচিত নয়, বাস্তবতা ঢাকা পড়ে থাকে।
অনেকে খুব তেজ দেখিয়ে বলেন, আমি নিজের খরচে বই ছাপতে যাব কেন, আমি পত্রিকায় লিখেই লেখক হয়েছি। বর্তমানে দেশে-বিদেশে পত্রপত্রিকার অভাব নেই। আপনি সেখানে লেখা পাঠিয়ে ঘুমোতে থাকলে ভাগ্য খুব ভালো থাকলে মৃত্যুর আগে সেটি প্রকাশিত হতে পারে। সেটি প্রকাশিত হবার জন্য পত্রিকাঅলাদের সাথে আপনাকে নিরন্তর যোগাযোগ করতে হবে; তাঁদের তোষণ বা তৈলমর্দন করতে হবে। এর অর্থ হলো, পত্রিকায় আমার লেখা ছাপা হওয়ার অর্থ এই নয় যা সম্পাদক মহোদয় লেখার গুণে মনোনীত করেছেন; ওটি মনোনীত হয়েছে আপনার যোগাযোগ আর মর্দনের ফলে।
যাঁদের বই বের হচ্ছে, তাঁরা কমবেশি সবাই পত্রিকায় লিখেই লেখক হয়েছেন। দেশে এঁদের সংখ্যা অনেক। কিছু লেখক শৌখিন, যাঁরা পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়স্বজন ও কলিগদের জন্য বই ছাপেন। তাঁরা কোনো পত্রিকায় নাও লিখে থাকতে পারেন, কিংবা স্কুলকলেজ-ইউভার্সিটি বা নিজস্ব সংগঠনের বার্ষিক ম্যাগাজিনে দু-চারটি লেখা ছাপা হয়ে থাকতে পারে। তাঁরা নিজেদের অর্থ 'অপচয়' করে, প্রচুর সাজসজ্জা করে নিজেদের 'লেখকত্ব' প্রচার করেন। তাঁদের প্রচারের সীমানাও সীমিত। আপনি যদি জীবনে অনেকগুলো বই প্রকাশ করতে চান, আপনাকে ধীরে ধীরে ছাপাখরচ সঞ্চয় করতে হবে।
আপনি পত্রিকায় লিখেই লেখক হয়েছেন, এ পুঁজিকে সম্বল করে প্রকাশকের খরচে বই ছাপবার আশায় বসে থাকলে আপনার আশা কোনোদিন হয়ত পূরণই হবে না। দেশে এ রকম পুঁজিবাদীদের ইয়ত্তা নেই।
যে-সব প্রকাশক আপনার কাছ থেকে ছাপাখরচ না নিয়ে বই ছেপে দিচ্ছেন বলে আপনি সবাইকে দাপটে বলে বেড়াচ্ছেন, সেই 'গুজবে' কিছু তথ্যঘাটতি থাকতে পারে, যা হয় আপনি অথবা স্বয়ং প্রকাশক গোপন করে যাচ্ছেন।
আপনার লেখকবন্ধু আপনাকে দেখে চটজলদি ব্যাগ হতে বই বের করে একটা সৌজন্য কপি দিলেন। আপনি তাঁর কাছ থেকে চেয়ে আরো কয়েকটি কপি নিন। তারপর জোর করে তাঁর পকেটে বইয়ের দাম গুঁজে দিন। মনে রাখবেন, মুহম্মদ জাফর ইকবাল কোনোদিন বই নিয়ে আপনার সামনে দাঁড়াবেন না। আপনার অফিসেও আসবেন না। আমার জানা নেই, তাঁদেরও হয়ত এমন দিন অতীতে ছিল।
নিজের বই নিয়ে নিজেই বাণিজ্যে নামা হলো নির্লজ্জতা।
আপনি লেখক হয়ে থাকলে নিজের লজ্জাবোধ জাগ্রত করুন। পুশ সেল হলো নিকৃষ্টতম অভদ্রতা। ফুটপাতের ক্যানভাসারের মতো বুকস্টলের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের বই ক্যানভাস করা থেকে বিরত থাকুন। আপনি তো ভিখারি বা বেহায়া নন, তাই না?
এখন আমি একটু পাকামো করে বলি- যারা গল্প-উপন্যাসে বর্তমানে বাংলা সাহিত্যে জীবন্ত কিংবদন্তি, আমি মনে করি তাঁদের লেখার চেয়ে আমার লেখা কোনো অংশে কম নয়, আর যেসব কনটেম্পোরারি ও জুনিয়র রাইটার পাকনামি করে বেড়াচ্ছেন, তাঁদের ধরে ধরে আরো ১৫ বছর যে গল্প-উপন্যাস শেখাতে পারবো, তা তাঁরা ভুলে গেছেন। তাঁরা অকৃতজ্ঞ ও অবিনয়ী। এটা আমি আরো ১৫ বছর পরই বলতে পারতাম, কিন্তু আমি এখন জীবনকে টানছি, এখন এটা না বললে তাঁরা নিজের ভুল বুঝতে পারবেন না। তাঁরা বড়ও হতে পারবেন না। আমি তাঁদের শুভাকাঙ্ক্ষী।
'নিন্দুকেরে মন্দ বলি সবার চেয়ে বেশি'। রবীন্দ্রনাথ থেকে ধার করে আমার রচনা। আমি আমার লেখার একটা শব্দের সমালোচনা সহ্য করতে পারি না, দীর্ঘ প্রায় ৯ বছর ধরে ব্লগে দেখে আসছি, তার আগে আমার ক্ষুদ্র 'সবুজ অঙ্গনে' দেখেছি ৬ বছর।
আপনার ইনবক্স মেসেজ বা কমেন্টে আমার রিসপনস পড়েই কিন্তু আপনি বুঝে নিচ্ছেন আপনার সমালোচনা আমি আশা করি নি। আমার লেখার ভূরি ভূরি প্রশংসা করবেন, আমার আশা ছিল এটাই। এটাই আমার পণ্ডিতগিরি, কিন্তু পাণ্ডিত্য নয়। আমাকে টোকা দেয়া আপনার উদ্দেশ্য ছিল, আমি বুঝতে পারি নি। আমি ভালো ও মহৎ লেখক তো নইই, কতখানি বেয়াদব তা নাড়ি টিপে জেনে নিলেন।
আপনি আমার লেখার প্রশংসা করেছেন, এর অর্থ এই নয় যে আমি আপনার চেয়ে বড় লেখক হয়ে গেছি। এর অর্থ আপনি আমাকে স্নেহ বা সম্মান করছেন। বড় ছোটো পাঠকের বিচার।
হুট করে একটা লেখার লিংক কমেন্ট বক্স, ইনবক্স বা ভাইবারে পাঠানো হলো অভদ্রতা। লিংক দেয়ার আগে একটা প্রিলিউড দিন কী পাঠাচ্ছেন। একই জিনিস দ্বিতীয়বার পাঠানো হলো চরম অভদ্রতা।
কনটেম্পোরারি বা সিনিয়রদের ঘন ঘন ট্যাগ করা অনুচিত। এটা বিড়ম্বনা। আমি ভালো লেখক হলে এটাতে সিনিয়ররা এমনিতেই লাইক ও কমেন্ট করবেন। পলিটিক্যাল ও সেক্স ইস্যু ট্যাগ করার আগে ভাবুন, কাকে কী ট্যাগ করছেন।
যাঁকে এত ঘন ঘন ট্যাগ করছেন, তাঁর কটি লেখায় আপনি কমেন্ট করেন? ফেইসবুক হলো গিভ এড টেইক-এর দুনিয়া।
আপনার স্টেটাসে কারা কমেন্ট ও লাইক করছেন, তাঁদের প্রোফাইলটা দেখে নিন। তাঁরা বয়স বা যোগ্যতায় আপনার সিনিয়র হতে পারেন। আপনার কথায় আপনার ফেইসবুক ফ্রেন্ড মর্মাহত হতে পারেন কিনা কিছু লেখার আগে ভাবুন। এসব ভাবাভাবি করতে গেলে লেখার সময় হারাবেন- এসব যদি ভাবেন তাহলে দেশসেরা লেখক হয়ত হবেন, কিন্তু মহৎ ব্যক্তি হবেন না। আপনাকে আমি ছুঁড়ে ফেললাম ডাস্টবিনে।
আমরা খুব স্বার্থপর ও চতুর। যিনি পত্রিকার সম্পাদক, যিনি আমার লেখা ছাপবেন, দেখবেন, আমরা ফেইসবুকে তার পোস্টে নিয়মিত লাইক, কমেন্ট করছি; তাঁকে প্রশংসা করে স্টেটাস দিচ্ছি। আমাদের মূল্য তাঁর কাছে বিকিয়ে দিলে আমার লোকসান নেই। এদের আমি কুৎসিতমনা মনে করি।
সবার আগে আপনাকে ভালো ব্যক্তিত্ব হতে হবে। আপনার লেখা যত ভালোই হোক, যখন জানতে পারবো মানুষ হিসাবে আপনি লম্পট, ভণ্ড, নিকৃষ্ট, আপনার লেখালেখি আমি ত্যাগ করবো। ত্যাগ করবো আপনাকেও।
আমি পাণ্ডিত্য ও চ্যাম্পিয়নশিপের অনুগত; যাঁরা পণ্ডিতগিরি ও চ্যাম্পিয়নগিরি (সমর্থন) করেন, মনে করেন- এমন গল্প বা কবিতা লিখে ফেলেছেন যা বোঝার সাধ্য কারো নেই, আমার কাছে তাঁরা সর্বদা পরিত্যাজ্য।
আপনি যে কবিতা লিখলেন, তার মর্মোদ্ধার করতে কয়েকজন গবেষক বসে গেলেন। মর্মমূলে দেখা গেলো তা মূলত কিছু সাংকেতিক শব্দের গাঁথুনি, মহৎ কিছু নেই, এই লেখা আর 'আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে'র মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই; দুটোই সারবত্তাহীন। লেখা হোক প্রাঞ্জল, সরস। তার গভীরের মহৎ নির্যাসই মানবকল্যাণে কাজে লাগবে।
যাঁরা বলেন, ব্লগ ও ফেইসবুক ছেড়ে খুব সুখে আছেন, আর এ নিয়ে জ্ঞানগর্ভ পোস্ট দিচ্ছেন, তাঁরা আসলে ব্লগ বা ফেইসবুক ছাড়তে পারেন নি, অনলাইন জগৎ আপনাদের কুরে কুরে খাচ্ছে। যেদিন অনলাইন লাইফ ছাড়তে পারবেন, সেদিন এসব অর্থহীন পোস্ট না লিখে ছেলেমেয়ে, আত্মীয়স্বজন নিয়ে সুখী অফলাইন জীবন কাটাতে থাকবেন।
মাঝে মাঝে কিছু কড়া কথা শুনতে হয় নিজের বিবেককে জাগ্রত করার জন্য।
সবাই ভালো থাকবেন। শুভেচ্ছা সবাইকে।
এ লেখাটি যাঁরা শুধু নিজের অবস্থান থেকে পড়লেন, তাঁরা দয়া করে অপরের অবস্থান এবং নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকেও পড়ার অনুরোধ করছি।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ দুপুর ১২:৪৬