আমার অনেক দিনের ইচ্ছে, একজন ফেইসবুকার ও ব্লগারকে নিয়ে একটা গল্প লিখবো। সময়ের অভাবে গল্পটা লিখতে না পারলেও মনে মনে এর প্লট গুছিয়ে রেখেছি।
সে একজন মেয়ে হবে। অতএব, গল্পের নায়িকা সেই মেয়েটি।
মেয়েটি দেখতে খুব সুন্দর। শাড়ি পরে, কখনোবা সেলোয়ার কামিজ। সুন্দর কণ্ঠ। রবীন্দ্র সঙ্গীত তার প্রিয় হলেও খালি গলায় গাওয়া মডার্ন ফোক গানে সে অনন্য। ভালো কবিতা লেখে। গল্পগুলোও অসাধারণ। কিন্তু তার প্রকাশিত বইটি জেন্ডার বৈষম্যের উপর কয়েকটি গবেষণাধর্মী আর্টিকেলের সংকলন।
সে ভালো রাঁধে; সুন্দর করে খোঁপাও বাঁধে সে। সে নৃত্যকলা শিখেছে। একটা সংগঠনে সে ছেলেদের আবৃত্তি শেখায়।
তার একটা শিল্পী মন আছে। অর্থাৎ, সে আঁকে। হস্তশিল্পেও তার প্রশংসনীয় নৈপুণ্য দেখা যায়। পরিপাটি ঘরটি সুদৃশ্য আসবাবে ছিমছাম সাজিয়ে রাখে। ফেইসবুক ও ব্লগে তার সাজানো-গোছানো ঘর-গেরস্থির ছবি দেখে আমরা চমৎকৃত হই।
দেশভ্রমণ তার শখ। প্রতি তিনমাসে অন্তত দুবার সে দেশের বাইরে যায়; বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়াতে তার খুব ভালো লাগে। বন্ধুরা তাকে আদর করে ‘লেডি বতুতা’ ডাকে। প্রাচীন ঐতিহ্যের প্রতি তার তীব্র আকর্ষণ রয়েছে; এবং এর উপর সে উন্নত মানের প্রচুর আর্টিকেল লিখেছে, যা হৃদয়গ্রাহী ও তথ্যপূর্ণ।
ফেইসবুক ও ব্লগভুবনে সে শীর্ষস্থানীয় সেলিব্রেটি। ব্লগে তার একেকটা পোস্ট ন্যূনতম ৫৫০০ বার পঠিত হয়। একেকটা পোস্টে অন্তত ৩০০টি কমেন্ট পড়ে।
তার আরেকটি বড় পরিচয় আছে। সে বাংলাদেশের একটা বিখ্যাত বাংলা ব্লগের মহামান্য এ্যাডমিনিস্ট্রেটর। অনেকের ধারণা, এ কারণেই সে খুব দ্রুত জগৎবিখ্যাত সেলিব্রেটিতে পরিণত হয়েছে।
ফেইসবুকে বিভিন্ন সোশ্যাল মুভমেন্টে তার সাফল্য ঈর্ষণীয়। রুগীদের জন্য রক্ত সংগ্রহ ও রক্তদান কর্মসূচিতে সে অচিরেই গিনেস বুক অফ রেকর্ডে নাম অনর্ভুক্ত করাতে সক্ষম হবে বলে সকলের ধারণা।
ফেইসবুকে সে কবিতা লেখে, রম্য লেখে, রাজনীতির বিষয় নিয়ে মতামত বা সমালোচনা লেখে। তিন শব্দের একটা স্টেটাসেও মুহূর্তের মধ্যে কয়েক হাজার ‘লাইক’, কমেন্ট ও ‘শেয়ার’ হয়। প্রতি ১০টা স্টেটাসে তার ২-৩টা ছবি থাকবেই। ছবিগুলোতে কখনো সে একা, কখনো মা বা বোনের সাথে। তার বেশিরভাগ ছবি সাদাকালো। সে কপালে টিপ পরে। তার চুলো কোকড়ানো নয়। হাত ভরা রঙিন ও ঝলমলে চুড়ি।
মেয়েটির সাথে আমার কীভাবে পরিচয় হলো গল্পে তার একটা ইন্টারেস্টিং বর্ণনা থাকবে। ভার্সিটির বারান্দা দিয়ে দ্রুত ছুটে চলা দুজন বিপরীতমুখি নায়কনায়িকা পরস্পরের ধাক্কা খায়। হাত হতে মাটিতে বই ছিটকে পড়ে। ‘স্যরি, ইট’স মাই ফল্ট’ বলে দুজনে নীচু হয়ে বই তুলতে গেলে মাথায় টক্কর লাগে। পুনর্বার ‘স্যরি’ বলে ওঠে দুজনেই। ... হ্যাঁ, এটা আমাদের সিনেমার গতানুগতিক দৃশ্য। এ দৃশ্য দেখে সিনেমা হলে আমরা অনেক আনন্দিত ও বিনোদিত হতাম তরুণ বয়সে। ভার্চুয়াল জগতে মেয়েটির সাথে প্রথম পরিচয়ের একটা ‘সাংঘাতিক’ ঘটনা ঘটাতে হবে। সাংঘাতিক ঘটনা মেয়েদের মনে দাগ ফেলে সবচেয়ে বেশি। এ থেকেই গল্পের ভিতর মেয়েটার সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা দ্রুত বাড়তে থাকবে।
মেয়েটার স্টেটাসে গিয়ে বলা যায়- তোমার চেহারা এতো কালো কেন? তুমি কি পেত্নি? এ কথায় মেয়েটা মারমুখি হবে। ঝগড়া বাঁধিয়ে দিবে। আকারে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিবে সে এ যুগের অড্রে হেপবার্ন কিংবা কবরী সারোয়ার। তারপর আমাকে বলতে হবে- ‘আপনাকে একটু চেতালাম আর কী! আপনি আসলে অনেক বুদ্ধিমতী। বৈজয়ন্তী বালার মতো।’ এরূপ অদ্ভুত তুলনা বা উপমায় সে আহ্লাদে গলে যাবে। এরপর তার সাথে চ্যাট হবে।
আচ্ছা, এটা তেমন আকর্ষণীয় কোনো ঘটনা হয় বলে কি আপনারা মনে করছেন?
তাহলে এটা বাদ। অন্যভাবে বলি।
ব্লগে তার কবিতার উপর নাতিদীর্ঘ একটা লেকচার দিয়ে বললাম। ‘তুমি কচি খুকি। ভালো লিখছো। চর্চা চালিয়ে যাও, ভবিষ্যতে তসলিমা নাসরিনকে ছাড়িয়ে যাবে। আমিন।’ ... মেয়ে অগ্নিমূর্তি হয়ে উঠলো। ‘আমাকে একটা বেশ্যার সাথে তুলনা করলা? আজকে তোমার একদিন কী আমার একদিন...’ তারপর বাহাস শুরু হলো। শেষ পর্যন্ত আমাকে নাকানি-চুবানি খাইয়ে নিবৃত্ত হলো মেয়ে। এরপর মেয়েটা আমাকে এড়িয়ে চলতে থাকবে, অবজ্ঞা বা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করবে। কিন্তু একদিন উত্তুরে হাওয়া থেমে যাবে, মনোরম দখ্নে বাতাস বইতে শুরু করবে। বেয়াদব নায়কের তেলেসমাতি দেখে নায়িকারা যেভাবে গলে যায়, ভুল করে আমার ব্লগে ঢুকে পড়ে আমার একটা কবিতা পড়ে ‘কবিনি’ সেভাবেই গলে গেলো আর কী!
যেভাবে চাচ্ছি, ঠিক সেভাবে জমছে না। উপরের কাহিনিগুলো বানোয়াট, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। সত্যিকারে মেয়েটার সাথে যেভাবে পরিচয় ঘটেছিল, লিখতে হবে সেটাই।
একটা মিউজিক ভিডিও’র জন্য সুন্দরী মেয়ে খুঁজছিলাম। আশা করেছিলাম ঝাঁকে ঝাঁকে মেয়েদের ছবি এসে ইনবক্স হ্যাং করে ফেলবে। সারাদিন বাদে মাত্র তিনটি মেয়ের গোটা সাতেক স্টিল পিকচার জমা হলো।
শ- আকর্ষণীয় চেহারা।
ত- কবিতার মতো মেয়েটি।
র- চেহারায় অহঙ্কারের ছাপ, তবে চোখ সরানো যায় না।
আমি সময় নিয়ে তিন জনের সাথেই বিস্তারিত চ্যাট করলাম। তিনজনের মধ্যেই কমন যে বৈশিষ্ট্য আমাকে আকর্ষণ করলো তা হলো তাদের অতি অল্প সময়ে কাউকে আপন করে নিতে পারার ক্ষমতা। চ্যাট করতে করতে মনে হলো এরা যেন আমার অনেক দিনের চেনা। আরও আগে কেন ওদের সাথে পরিচয় হয় নি এ নিয়ে আফসোসে আমার বুকটা ‘ফাইট্ট্যা’ যেতে চাইলো।
ধীরে ধীরে একটা মেয়ের সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা হলো। ঠিক প্রেমের জন্য এই ঘনিষ্ঠতা নয়, এমন এক সম্পর্কে আমি জড়িয়ে যেতে থাকলাম যাকে কোনোভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায় না।
সে আমাকে খালি গলায় গাওয়া তার অনেকগুলো গানের লিংক দিল। আমি অভিভূত হলাম। খালি গলায় গাওয়া গানে যে এত মাধুর্য, এ প্রথম আমি তার গান শুনে বুঝলাম। তার কাছে আমার বায়না ছিল, আমার পছন্দের একটা গান খালি গলায় গেয়ে শোনাতে হবে।
কেন পিরিতি বাড়াইলারে বন্ধু
ছেড়ে যাইবা যদি
কেমনে রাখিব তোর মন
আমার আপন ঘরে বাঁধিরে বন্ধু
একদিন হঠাৎ ইনবক্সে তার গানের লিংক। খালি গলায় গাওয়া। তখন নিরালা দুপুর। বিরান, খাঁ-খাঁ মাঠের নিস্তব্ধতার মতো আমার সমস্ত ঘরদোর ঝিম ধরে বসেছিল। আমি শূন্যের উপর বসে নিগূঢ় মনে শুনতে থাকলাম তার গান।
পাড়া-পড়শি বাদী আমার
বাদী কালনো নদী
মরম-জ্বালা সইতে নারি
দিবানিশি কাঁদিরে বন্ধু
ছেড়ে যাইবা যদি
আমি খুব বেশি করে তার গানের প্রেমে পড়লাম। আমি তার প্রেমে পড়ে গেলাম। আমি প্রেমে পড়লাম। আমি চোখ মুদে বসে আছি। আমার সামনে দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে, একগোছা চুল বুকের উপর ছেড়ে দিয়ে যে মহীয়সী নারী দরাজ ও ধীর কণ্ঠে অবিরাম গান গেয়ে যাচ্ছে, আমি তার গান ও রূপমুগ্ধ প্রেমিক। আমি আর কিছু চাই না, মহীয়সী, শুধু তব গান চাই, নিভৃত অন্তর্ধামে সুরসুধাময় তোমাকে চাই।
সম্বিৎ ফিরে পেয়ে হেসে উঠি। হায়, সত্যি সত্যি আমি প্রেমে পড়ে গেছি যে।
আর ঐদিকে? ঐদিকে মেয়েটাও আমার প্রেমে পড়ে গেছে। সে একদিন জানালো আমাকে সে দেখতে চায়। আমাকে দেখার তৃষ্ণায় সে ছটফট করছে। একদিন আমাকে ঢাকায় যেতে বললে ‘আমার সময় নেই’ ভান করলাম, যাতে সে মনে করে আমি অতোটা সহজলভ্য নই। নানা কাজে রাতদিন ব্যস্ত থাকি বলে ব্লগ বা ফেইসবুকে তেমন সময় দিতে পারি না; এ নিয়ে মাঝে মাঝে ফেইসবুকে স্টেটাস দিই। ‘এভাবে ডুমুরের ফুল হইয়া যাও কেন? স্টেটাসে তোমার লাইক/কমেন্ট না পেলে আমার স্টেটাসটাই পানসে মনে হয়। অন্তত আমার স্টেটাস পড়বা, কেমন?’ মেয়েটা আমাকে অনুরোধ ও অনুশাসন করে।
একদিন দেখা করতে ঢাকায় যেতে হবে বৈকি।
মেয়েটা একটা প্রাইভেট ভার্সিটির টিচার।
নাহ, একটা কলেজের টিচার।
নাহ, একটা ডাকসাইটে ইংলিশ স্কুলের টিচার হলে বেশি ভালো হয়। সে ভালো ইংরেজি লেখে। চ্যাটিঙের সময় খুব ফাস্ট লেখে। আমি ফাস্ট পড়তে পারলেও ফাস্ট রিপ্লাই দিতে পারি না।
মাস্টারনির স্কুলে যেদিন যাবো সেদিন সে একটা নাচের ক্লাসে রিহার্সেল করাতে থাকবে। ও, সে কিন্তু কলাবরিষ্ঠা। এমন কোনো কাজ বা কলা নেই, যাতে তার দখল নেই।
এখানে আরেকটু ভাববার আছে। গল্পটা বিয়োগান্ত করবো, নাকি মিলনাত্মক?
আমরা ট্র্যাজেডিই সবচেয়ে বেশি পছন্দ করি। এটা মেয়েটার বাণী। তাই গল্পটা ট্র্যাজেডি করতে হবে।
মেয়েটা ওয়েটিংরুমে এসে আমাকে দেখে উচ্ছ্বসিত হবে এবং ‘ইদ মুবারাক’ বলে আলিঙ্গন করবে।
ওহহো, আমাদের দেশে তো পুরুষ আর নারীতে কোনো আলিঙ্গনের রেওয়াজ নেই, অতএব এই সিকোয়েল বাদ।
মেয়েটা এসে চেয়ারে বসতে বসতে বলবে, ‘জি, আমার কাছে এসেছেন? আপনার পরিচয়?’
‘আমারে চিনলা না? আমার নাম সোনামিঞা, তোমার ফেবু ফ্রেন্ড।’
মেয়েটা ধীরে ধীরে চোখ কপালে তুলে বলবে, ‘আপনাকে ঠিক চিনতে পারলাম না। কোথা থেকে এসেছেন?’
‘খালি হাসির কথা কও ক্যান? আমি ফেবু থেকে আসছি।’
‘ফেবু কী জিনিস?’
‘ধুর ছাই। খালি শয়তানি করতেছ। ফেবুউউউ ... ফেবুউ। মানে ফেইসবুক।’
‘ও ফেইসবুক? আচ্ছা বলেন ভাই।’
‘আমার তো আজই আসার কথা, তাই না? সক্কালেও তো তুমি কনফার্ম করলা।’
মেয়েটা শেষ পর্যন্ত ক্রাশ না খেয়ে আমার কথায় টাসকি খাবে।
‘স্যরি, আপনার কথা বুঝতে পারছি না ভাই। আজকে তাহলে আসুন, কেমন?’ এই বলে উঠে হনহন করে চলে গেলো। যাবার সময় ওয়েটিং রুমের বুয়াকে মৃদু ভাষায় ভর্তসনা করলো, ‘যেনতেন কেউ দেখা করতে চাইলেই কি দৌড়ে গিয়ে ডাকতে হবে? তোমরা বোঝো না কিছু?’
মেয়েটার সর্বশেষ কথায় আমার হৃৎপিণ্ডে রক্তক্ষরণ শুরু হবে। আমি ট্র্যাজিক হিরোদের মতো টলতে টলতে ওখান থেকে বেরিয়ে আসবো।
ফেইসবুক ও ব্লগে একসঙ্গে গল্পটির শুভমুক্তি ঘটবে। তাহমিনা রীমা এবং রহস্যময়ী কন্যা নামক দুজন মেয়ের প্রত্যেকেই ভাববে যে গল্পটা তাদের নিয়ে লেখা। তারা ইনবক্সে লিখবে :
‘ভাইয়া, গল্পে এতো তথ্যবিভ্রাট কেন? আমি টিপ পরি ঠিকই, কিন্তু কোনোদিন সাদাকালো ছবি পোস্ট করি না। আমার হাত ভরা চুড়ি থাকে এটা সত্য হলেও আমার চুল কোকড়ানো নয়- এটা মিথ্যা।’
‘আপনি সত্যের সাথে মিথ্যাকে মিশিয়ে ফেলেছেন। আমি গান গাই, তবে নৃত্যকলা শিখি নাই। আমি কবিতা লিখি, কিন্তু রান্নাবান্নার রেসিপি দিই না। আমার সাদাকালো ছবিতে আমার বেবিটার কথা কিন্তু লিখেন নি!’
এ ছাড়া অন্যান্য ফেইসবুক ফ্রেন্ডও কমেন্ট এবং ইনবক্সে লিখবেন :
‘সবটুকু পড়ে এটা পানির মতো পরিষ্কার হলো যে, এ গল্পের নায়িকা ‘নীলপরী’ ছাড়া আর কেউ নয়।’
‘মেহজাবিন নুন। ঠিক বলেছি?’
‘আপনি মিয়া চুপাহুয়া রুস্তম। তলে তলে যে এতোদূর, তা ঝানতাম নাহ।’
গল্পে সমাপ্তির অংশ আসলে এটাও হবে না। পুরো প্লটটা যা পড়লেন, ঘটনা ঘটতে থাকবে আরও অন্যরকমভাবে।
বাস্তবে যা যা ঘটেছে, গল্পে হুবহু তাই বলে দেয়া হবে। তখন মেয়েটিকে চিনতে কারো এক সেকেন্ডের বেশি সময় লাগবে না। তবে অত্যাশ্চর্য ব্যাপার যেটি হবে তা হলো, এ গল্পটির রচনাশৈলি কেবল দু-একজন মেধাবী পাঠক ছাড়া সবারই মাথার অনেক অনেক উপর দিয়ে উড়ে যাবে।
বলুন তো, মেয়েটি কে?
২০ জুলাই ২০১৫
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা আগস্ট, ২০১৫ বিকাল ৪:৪৬