রুমা ইদের শপিং করছে। ব্যস্ত শপিং মল। সময় নিয়ে একেকটা শপিং মলে যায়। মায়ের জন্য, তিন বোনের জন্য, ভাগ্নে-ভাগ্নি, ভাতিজা-ভাতিজি সবার জন্য কেনাকাটা না করে তার শান্তি নেই। ইদের মরশুমে সবাইকে গিফট করা তার পবিত্র কর্তব্য। ভাইবোনেরা তাকে সবার উপরে স্থান দিয়ে থাকে।
কেনাকাটা শেষে বাসায় ফেরার পথে উৎস বলে, মা-বাবার জন্য কিছু কেনার দরকার না? রুমা লজ্জিত হয়। মৃদু ভর্ৎসনা করে বলে, বড্ড ভুলোমনা তুমি। একটু মনে করিয়ে দিবে না?
আবার মার্কেটে ফিরে যায়। সারাদিনের ধকলে শরীর খুব ক্লান্ত। বেশি দুরে নয়, ঢাকা কলেজের উলটো দিকের মার্কেটে ঢোকে তারা। রুমার জন্য আরও কিছু লজ্জার বিষয় ছিল। টাকা প্রায় শেষের দিকে। এ টাকায় ভালো কিছু পাওয়া সম্ভব নয়। কী করা যায়, রুমা মনে মনে ভাবতে থাকে। বুড়ো মানুষ। তারা তো আর নতুন জামা পরে বাচ্চাদের মতো নাচানাচি করবে না। শরীর ঢাকতে পারলেই যথেষ্ট। তা ছাড়া, তাদের জামা তো আছেই। গত বছর শ্বশুরকে কিনে দেয়া পাঞ্জাবিটা এখনও ঝকঝকে নতুনের মতো। শুধু শাশুড়ির জন্য একটা কাপড় না কিনলেই নয়। তাকে আনেকদিন কোনো পরনের কাপড় দেয়া হয় নি।
২
বসুন্ধরা শপিং মল। ইদের শপিং করতে এসেছে সালেহা। একের পর এক দোকান ঘুরে জামাকাপড়, কসমেটিকস, ইত্যাদি কিনলো। তারপর পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়ে আসরের একটু পরে সে বাসায় ফিরলো। ইফতারি বানালো, যথাসময়ে ইফতার করলো তারপর শাশুড়িকে নিয়ে কেনাকাটা দেখতে বসলো।
দেবর, ননদ, সবার পোশাক দেখানোর পর সবচেয়ে অভিজাত ও দামি শাড়িটা শাশুড়ির হাতে দিয়ে বললো, 'মা, এটা হলো আপনার। পছন্দ হয়েছে কিনা বলুন। পছন্দ না হলে পালটে আনা যাবে।'
মিসেস রুমা বেগম কাপড়টি হাতে নিয়ে বউয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। সে একটু অস্বস্তি বোধ করে।
'তোমার মায়ের জন্য কিনো নাই?' অস্ফুট স্বরে রুমা বেগম বলে। সালেহা শুনতে পায় না। সে বলে, 'কী মা, তাকিয়ে আছেন কেন? পছন্দ হয় নি?'
রুমা বেগমের গলা ধরে আসে। সে যখন কথাগুলো বলতে থাকে, তার কণ্ঠ কাঁপতে থাকে। 'তোমার মা আর বাবার কাপড় কই?' সালেহা ফিক করে হেসে দেয়। বলে, 'কী যে বলেন না মা, আমার মা আর বাবা তো আপনিই। নাকি আমাকে পরের মেয়ে মনে করেন?'
রুমা বেগম মাথা নীচু করে থাকে। সালেহা বলতে থাকে, 'আমার ভাইয়েরা আছে না? আমার চার ভাই যে কাপড়-চোপড় কিনবে, তার উপর আমার মা আর বাবা জাজিম বানিয়ে শুতে পারবে।'
রুমা বেগমের চোখ ভিজে ওঠে। সে বউয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে কিছু একটা বলবে সেই শক্তি খুঁজে পায় না।
৩
গল্পের দ্বিতীয় অংশটুকু নিছক কল্পনা, যাকে উইশফুল থিঙ্কিং বলা যেতে পারে। আদতে নতুন অধ্যায়ে নিয়মানুযায়ী যা হবার কথা ছিল, হয়েছিল ঠিক তাই।
ছেলেকে বিয়ে করানোর পর রুমা বেগমের জীবনটা পালটে যেতে থাকলো। কোনোকিছুই তার নিজের ইচ্ছেতে বা নিজের ইচ্ছেমতো হয় না। নিজের ছেলে মায়ের নাম ভুলে যেতে বসেছে। স্ত্রৈণ বলতে যা বোঝায়, ছেলেটা পুরোপুরি তা হয়ে গেছে।
ইদের কাপড়চোপড় কিনে আনার পর নিজের ভাইবোনদের জন্য ভাগ-বাটোয়ারা শেষে শাশুড়ির হাতে একটা অতি সাধারণ মানের পরনের কাপড় ধরিয়ে দিয়ে বললো, 'মা, কাপড়টা কিন্তু খুব দামি। ইদের দিন পরবেন।'
রুমা বেগমের যদি সেই তেজ আর শক্তি থাকতো, তাহলে এই কাপড়খানা সালেহার মুখ বরাবর ছুঁড়ে মেরে বলতো, 'আমি কি তোর কাজের বুয়া যে, আমাকে তোর খয়রাতি কাপড় পরতে হবে?'
জীবনচক্র এমনই। এ চক্র ছিন্ন করে নতুন অধ্যায় সৃষ্টি করবে এমন সদাশয়া কে আছে?