আমাদের পাখিগুলো উড়ে যেতে যেতে একবারও ফিরে তাকায় নি, আমরা ওদের জন্য কাঁদছিলাম
২০০৫ সালের এপ্রিল বা মে মাস। আমরা সৈয়দপুরে।
একদিন সৈয়দপুর শহরে ঢুকবার মুখেই পাখির দোকান দেখে পাইলট আর ঐশী বায়না ধরলো, ওদের অনেকগুলো পাখি চাই, ওরা পুষবে।
ওদের জন্য কয়েকটা পাখি ও পাখিদেরর জন্য একটা খাঁচা কিনলাম। পাইলট আর ঐশী খুশিতে আটখানা। আমি আর আমার স্ত্রীও ওদের সাথে পাখিদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।
কিন্তু খাঁচাটা খুব ছোট্ট। আমরা ছোট্ট খাঁচা ছেড়ে ঘরের একটা বারান্দাকেই খাঁচা বানিয়ে ফেললাম। মুনিয়া, লাভ বার্ড, ইত্যাদি বেশ ক’টা পাখি। আমি, ঐশী আর পাইলটকে নিয়ে পাখিদের পরিচর্যা করি। আমার পরিচর্যা এমন পর্যায়ে পৌঁছুলো যে, মনে হতে লাগলো, ঐশী বা পাইলটের জন্য নয়, আমার জন্যই পাখিগুলো শখ করে কিনেছি।
কিন্তু পাখিগুলো দিনে দিনে শুকিয়ে যাচ্ছিল, কারণ, ওরা কোনো খাবার খাচ্ছিল না। পাখিদের দোকান থেকে সব ধরনের খাবার আনলাম, কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না।
একদিন সকালে দেখি একটা পাখি মরে মাটিতে পড়ে আছে। আমার চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো। পাইলট আর ঐশীর চেহারাও কাঁদো-কাঁদো। পাখিগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে আমি অস্থির হয়ে পড়ি। কিন্তু হায়, তার পরের দিন আরও একটা পাখি মারা যায়। আমি কালবিলম্ব না করে পাখিগুলো বাইরে নিয়ে আকাশে উড়িয়ে দিই- ওরা দুর্বল ডানায় ভর করে খুব কষ্টে গাছের ডালে গিয়ে বসে। ওদের দিকে আমি চেয়ে থাকি- আমার বুক ছিঁড়ে যেতে থাকে। আমি বেশ কিছুক্ষণ ওদের চোখে চোখে রাখি। ভয় হচ্ছিল, যদি কোনো পাখি উড়তে না পেরে মাটিতে পড়ে যায়! এভাবে অনেকক্ষণ বসে থেকে আমি ঘরে ফিরে যাই- পাখিগুলো তখনও আশপাশের গাছগুলোতে বসে ছিল।
কেন যেন আমার মনে একটা সূক্ষ্ম আসা উঁকি দিচ্ছিল। পোষা প্রাণীরা মনিবের কাছে বার বার ফিরে আসে। বিড়ালের বেলায় এসব ঘটে থাকে। কুকুরের বেলায় ঘটে। অনেককে চিল, ঘুঘুপাখি পুষতে দেখি- ওরা মনিবের মাথায়, হাতে ভর করে মনিবের সাথে সাথে ঘুরতে থাকে। গাছে উড়ে যায়, আবার মনিবের কোলে ফিরে আসে। হাঁসমুরগিরা সকালে কুলায় ছেড়ে বের হয়, সন্ধ্যায় গৃহিনীর নীড়ে আপনআপনিই ফিরে আসে। আমাদের পাখিগুলোও হয়তো, হয়তোবা দিনশেষে ঘরে ফিরে আসলেও আসতে পারে। বারান্দার নেটের কাছে এসে ভিতরে ঢুকবার জন্য ওরা ডানা ঝাপটাবে- আমরা অধীর উল্লাসে ছুটে গিয়ে ওদেরকে বরণ করে নিয়ে আসবো।
ঘণ্টাখানেক পর ঘরের বাইরে এসে পাখিগুলোকে খুঁজি। ওরা নেই। ওরা সন্ধ্যায় আমাদের বারান্দায় ফিরে এসে ডানা ঝাপটালো না। ওরা চিরতরে ওদের রাজ্যে হারিয়ে গেছে।
পাখিগুলোকে এত যত্ন দিলাম, ওরা কীভাবে আমাকে ছেড়ে হারিয়ে যেতে পারলো? আমার হাত থেকে ছাড়া পেয়ে যখন ওরা উড়ে যাচ্ছিল, ‘হে বন্ধু, বিদায়’ স্বরূপ একবারও ওরা আমার দিকে ফিরে তাকালো না! হায় নিষ্ঠুর পাখি! হায় নিষ্ঠুর মুনিয়া!
পাখিদের জন্য আমার মন আজও কাঁদে।
১০ মার্চ ২০১৪
কৃতজ্ঞতা
আমার ধুলোপড়া চিঠি পোস্টের ১৪ নম্বর কমেন্টের উত্তরে আমি যা লিখি, তার সম্প্রসারিত রূপ এটি। এ কাহিনিটা আমার বুকে একটা ক্ষত সৃষ্টি করেছে। আমার আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, কলিগদের সাথে এটা অনেক শেয়ার করেছি। ফেইসবুক বা ব্লগের অন্য কোথাও এর আগে এ ঘটনাটার উল্লেখ করেছি, কিন্তু কবে, কোন্খানে তা মনে পড়ে না। কিন্তু সাম্প্রতিকতম প্রকাশ হলো আমার উল্লেখিত পোস্টটি, আর ঐ কমেন্টটি যিনি করেছিলেন তিনি আমাদের প্রিয় ব্লগার মাঈনউদ্দিন মইনুল। তাই মাঈনউদ্দিন ভাইয়ের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
চলো, জীবনকে খুঁড়ে দেখি
যখন রাত চিবিয়ে খাই, আর ঘুম গুঁড়ো করে পাথরে সোনাবীজ বুনি, একগুচ্ছ অলকের ঘ্রাণ সজীব পাথারে পাক খেতে খেতে অদৃশ্যে আছড়ে পড়ে- মনে হয়, চলো- জীবনকে খুঁড়ে দেখি, কোন্ মায়াময় আধারে নিত্য মন্থন শেষে কোথায় ফেলে যায় নিপুণ নির্যাস
জীবন- যতদূর চোখ যায়- আলো শেষ হতে হতে মিশে যায় নিগূঢ় অন্ধকারে- ঐখানে ধ্যানমগ্ন স্বপ্নভ্রমর, হয়তো এক উদাসীন কবির মতো সেও ভুলে গেছে- জীবনের নেই কোনো মানে- সে শুধু কাঁদাতেই জানে
চলো, এইবার জীবনকে খুঁড়ে দেখি- হীরে ও মুক্তোর খনি কোন্ গহিনে, কতখানি দূরে
১৩ মার্চ ২০১৪