১। গভীরে
আগাছা ঠেলে যতোই বনের গভীরে যাবি
ততোই পক্ব-পুষ্ট ফল ও বৃক্ষ পাবি।
বুঝলে তবে ভিতরে যা
দেখে শুনে কী খাবি খা।
২। আকাঙ্ক্ষ
আমার প্রেম পাওয়া হয়ে গেছে, এবার তবে
যেতে পারিস যথাতথা, মহোৎসবে।
সবই তুই দিস, শুধু যত্ন করে
আমার জন্যে মনটারে তোর রাখিস ধরে।
৩। অন্তরবাসিনী
যারা ভুলে যায়
তারা যায় ভুলে সব
যেজন ভোলে না
সেজন ভোলে না কিছুই
নদীর বুকেও
জেগে ওঠে বালুচর
চরের গহীনে
চিরদিন কাঁদে নদীই।
৪। এক নিরুদ্দিষ্ট নদীর সঙ্গে
এক নিরুদ্দিষ্ট নদী নিরন্তর ধেয়ে যায় - গর্ভে তার লুকোনো ইতিহাস সুবর্ণ-করুণ
আমারে নিয়ে যাও নদী- বেভুলে শুধাই
প্রসারি দিঘল দু বাহু, নদী হেসে কয়- এসো
ধাবমান নদীসঙ্গে আমি ভাসমান; নদী মোর সকলি নিয়েছে- নেয় নি আমারে।
৫। বিদিশা
আমার তিনভাগ জল। দিয়েছো সহায়
অতি ক্ষুদ্র এককণা স্থল। আমি জানি না সন্তরণ; অথচ
বাঁচবার তরে আমায় দিয়েছো বৃহৎ এক জীবন।
কতোদূর! আর কতোদূর তোমার পথের প্রান্ত? কতোদূর
সন্তরণহীন ভেসে যাবো তোমার সমুদ্দুর?
৬। আমার বড় হওয়া
আমি আজও বড় হতে পারি নি
পেটের ভেতর তীব্র চারাগাছ ‘শুষে’ খায় বয়সের খির।
বাবার লাঙুলে হাতে ঝরে পড়ে অশীতিপর খসখসে আঙুল।
ঢেঁকি ও চালুনিতে এখনো যৌবনকাল বৃদ্ধা জননীর;
আমার নাবালেগ বয়স দ্বাদশে স্থির। বড় হতে পারি না।
৭। আজন্ম প্রেমিকা
সে প্রেম সাধে, গ্রহণ করে না
শরীর জড়িয়ে জীবন জড়িয়ে রাখে, ভুলে যায় সংসার
সে তার সন্ততির হাতে
ভবিষ্যত তুলে দিয়ে অনিকেত পাথারে নৌকো ভাসায়, অপূর্ব সঙ্গমে
অদৃশ্য শেকলে আমার নোঙর
বেঁধে রাখে রাঙা চরণে তার। সে আমার আজন্ম প্র্রেমিকা, সমগ্র সত্তার।
৮। কোকিলবৃক্ষ
আমার একটা কোকিলবৃক্ষ ছিল;
শিরায় শিরায় শব্দনদীর বান।
আমার ছিল হরিৎ চরের পাখি,
ধানকাউনের পাগলা দিনের গান।
আমার এখন কঙ্কালসার গাছে,
হিমবায়ু, আর দুঃখ ফুটে আছে।
৯। সন্ন্যাসী
একদিগন্ত ঝড় মুঠোয় পুরে ছুটছে সন্ন্যাসী
সম্মুখে অগৃহের বিভা, পেছনে শূন্য ছায়া
ভুলেছে সঙ্গমের স্বাদ, অস্তিত্বের মায়া, বুকে তার
উথালপাথাল সাগরের ঢেউরাশি
ছুটছে রাশভারী, অকাতর সন্ন্যাসী
১০। কৃষ্ণকলি, আমি তোরেই খুঁজি
(আকাশে একটি মেয়েকে ভাসতে দেখলাম)
মেয়েটা কালো, আর তাকে দেখেই মনে হলো
সে তোর মতো নয়- অবিকল তোরই ছবি যেন
অন্ধকারের ভাঁজে ভাঁজে খাঁজকাটা পুরোটা জমিন
প্লাবনে বিছানো শোক, জীর্ণ, মলিন
তার ডাগর চাহনির প্রকাণ্ড গভীরে
সমগ্র অতীত জাগালো ভোর
তারপর আরও গভীরে ঢুকে দেখি, কেউ নেই, শূন্য গৃহ তোর
১১। ঠাণ্ডা যুদ্ধ
তোমার তখন কিচ্ছু ছিল না
আমার দু’হাত শূন্য
তোমার তখন দুঃখ ছিল না
আমার ছিল না কান্না
তোমার এখন পূর্ণ দু’হাত
আমার দু’হাত ঋদ্ধ
তোমার ভুবন ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুর
আমার ভুবন বর্ষা
তোমার-আমার সন্ধিসকল
অগ্রন্থিত, রুদ্ধ
তোমার-আমার হিম মহাকাল
রক্তবিহীন যুদ্ধ
১২। পুরুষ ও পাখি
পাখিপুরুষরা পুরুষপাখির মতোই কালে কালে পাড়ি দেয় সমুদ্রের আকাশ
পুরুষপাখিরা ডানা ভেঙে উড়াল থেকে ভূমিস্মাৎ হয়েছে শোনা যায় না
পাখিপুরুষরাও মাঝে মাঝে শৌর্য্যবীর্যে নারীদের ছাড়িয়ে যায়; তথাপি
ডালপালাহাড়গোড় ভেঙে পানিগর্ভে মজ্জিত হওয়াই তাদের নিয়তি
১৩। বনস্পতি
তোমার সুমধুর ঘ্রাণ অনুপম জীবনের খুলে দেয় দ্বার
প্রত্যেক পদক্ষেপে
প্রতিদিন প্রগাঢ় প্রেম দাও সুস্নিগ্ধ আগুনের ভাঁজে
আমি এক অন্ধ শিকারি- আদিগন্ত চেয়ে রই তীব্র অপলক
অমিত প্রেম দাও, ভরপুর তুমুল যৌবনে সঙ্গম দিলে না আজও
১৪। রাখি
একবার ভেবে দেখো আকাশলীনা,
তোমার এতোটুকু মনে পড়ে কিনা-
মাইনী নদীর স্রোতে যেদিন দুপুরে ভাসিয়েছিলে চুল ও শরীর,
একঝাঁক উদ্ভ্রান্ত পাখি পলকে তাকিয়ে স্থির
পাক খেয়ে উড়ে গেলো পাহাড়ের মেঘে।
তখনো তোমাকে ডেকে ডেকে
অবিচল রোদে গান গায়, অথবা কাঁদে ঠিকানাবিহীন নিজ্ঝুম পাখি।
আমি তার আজও জানি না নাম; এবং ঠিকানা; অথচ দেখো, আমার মণিবন্ধে
নিয়ত উদ্ভাসে তার অনসূয়া ‘রাখি’।
১৫। লোকটা এই শহরেই থাকে...
তাঁর কোনো পরিচয় নেই; প্রয়োজন নেই ওসব সামাজিক ডামাডোলে; পুরোটা শহর তাঁর নামের শরীরে ভর করে বেঁচে থাকে আর রাতদিন বয়ে চলে বুড়িগঙ্গার ক্ষয়িষ্ণু আয়ুর সাথে পচন ও পতনের দিকে। লোকটা এই শহরেই থাকেন বটে, তাঁর সত্যিকার নামধাম আমরা জানি না; তাঁর আদিবাস কোথায়, কবে তিনি প্রথম এ শহরে রেখেছিলেন পা, কী উদ্দেশে, আমরা জানি না;
কী নাম লোকটার?
১৬। ২৫ বছরের মৃতদেহ
একদা আমি তাকে ভালোবাসতাম। তাকে কাল আবার নতুন করে ভালোবাসতে গেলে আন্তরিক হাসিযোগে আমাকে গ্রহণ করলো। অন্তরঙ্গ আতিথেয়তা শেষে সে বললো, তোমাকে অভিবাদন, আজ আমার ২৫তম মৃত্যুদিবস।
১৭। খুন ও খুনি
কে
অন্ধকারে ধরেছিল সাপ
সে
খুন করে, করে না সে পাপ
ফাঁসির কাষ্ঠে কে ঝোলায় আসামিকে?
জল্লাদ
কে তবে খুনি, জল্লাদ, নাকি জজ?
অপরাধ
১৮। অন্তর্যামী
বনের বাঘে খায় নি তারে, বাঘ ছিল তার মনে।
রোদের আলোয় যায় কি দেখা কী ব্যথা দংশনে?
কোথায় তাকে খুঁজবে বলো, কোন্ দেশে, কোন্ বনে?
কেউ জানে না কার মনে কার বসত সঙ্গোপনে।
১৯। চিরদুখী
যারা ভুলে গেছো, আরো ভুলে থাকো,
সুখ ভুলে যাওয়াতেই,
যেজন ভোলে না, তার মতো আর
চিরদুখী কেউ নেই।
তোমাকে ভুলিতে তোমার নামই
জপিতেছি দিনমান,
ভুলিতে পারি না, ছল করে শুধু
করি ভুলিবার ভান।
২০। মনে রাখে নি
পউষের শেষে প্রথম পাতারা ঝরে যায় যেমনি, তেমনি সরে গেছে পুরোনো বন্ধুরা
নতুন বছরের আগের রাতে
ওরা কতো সুগন্ধি ছড়াতো, হর্ষনদীর ফোয়ারা ফোটাতো
শংসাকাহিনী শোনাতো মুখর সকালদুপুরে
তারপর হেসেখেলে যেতে যেতে বলেছে কেবল ওদের কথাই
আমার কথাটি মনেও পড়ে নি
আমার কথাটি মনেও রাখে নি
২১। দেউলিয়ে
যাকে যা কিছু দেবার, সব দিয়ে
নিঃশেষে একদিন হয়ে যাই দেউলিয়ে।
তারপর শূন্য হাতে
ঘুরে বেড়াই নগরের বিষণ্ণ ফুটপাতে,
ফাঁকা রেললাইন ধরে, গাঁয়ের গোধূলি-ধূসর রাস্তায়,
নদীর পাড় ধরে হেঁটে চলি; কখনো ঘুরে-ফিরে ক্লান্ত রাত কেটে যায়
বস্তির দুর্গন্ধ ছেঁড়া কাঁথায়।
সহসা দেখি দারুণ সতেজ উল্লসিত মন আমার,
চিন্তা নেই, ভাবনা নেই, দুঃখ নেই, বিলকুল নেই কিছু হারাবার।
নেই যার একরত্তি ভিটেমাটি, টাকাকড়ি, দেবার কি কিছু আছে তার? কিছু নেই।
কাউকে কিছুই না-দিতে পারার কষ্টের মতো কষ্ট নেই আর কিছুতেই।
যাকে যা কিছু দেবার, সব দিয়ে
নিঃশেষে একদিন হয়ে যাই সুখী-দেউলিয়ে।
২২। বিবর্তন
বদলে যাচ্ছে মন, আবেগ-প্রকাশের রঙ
দিনে দিনে বদলে দেখো হচ্ছি কেমন সঙ
২৩। উপসংহার
কবিতা ফুটছে;
অনির্বাণ ঘুম থেকে উঠেছে।
শব্দরা ছুটছে।
কবিতার খাতাতেই জুটেছে।
ফুটনোট : এখানকার কোনো কোনো লেখা কোনো কোনো ব্লগে মন্তব্য করার কালে লেখা হয়ে থাকতে পারে; ঐসব ব্লগারের প্রতি কৃতজ্ঞতা।