সাইফ ১ দিন পরই বাসায় ফিরে এসেছে।
(বিস্তারিত লিখছি ধীরে ধীরে। সাইফের বাসা থেকে রাগ করে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা আমার বুকে একটা দীর্ঘ ক্ষতের সৃষ্টি করেছে। তাছাড়া একটু ব্যস্ত আছি আপাতত। তাই ফেইসবুক বা ব্লগে তেমন আসা হচ্ছে না ইদানীং। আশা করছি শীঘ্র নিয়মিত হবো।)
ধন্যবাদ জিসান শা ইকরাম। আপনার পরামর্শটি কৃতজ্ঞ চিত্তে গ্রহণ করে সাইফের ফিরে আসার কথাটা শুরুতে দিয়ে দিলাম।
সাইফ আল মাহমুদ বাসা থেকে রাগ করে পালিয়ে গেছে।
১৩ জুলাই সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় রাগ করে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। সারা রাত খুঁজেছি, এখনো খুঁজছি। বাসা কুমিল্লার টিপরাবাজার এলাকা। সেনানিবাস ইস্পাহানি পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজে ১০ম শ্রেণীতে পড়ে।
বন্ধুরা, আমি ওর বাবা। কুমিল্লা শহরে থাকবার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। দয়া করে এই মেসেজটি আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন।
আমার মোবাইল : ০১৭৪৬৮৮৯০৭৯
ওর পরনে কালো প্যান্ট কালো টি-শার্ট ছিল। লম্বা ৬ ফুট। গায়ের রং শ্যামলা।
_______________________________________________
সাইফ বাসা থেকে বের হয়ে যাবার পর
(ডায়েরি)
সাইফ যখন রাগ করে বাসা থেকে বের হয়ে যাচ্ছিল, তখন আমারও অনেক রাগ ছিল শরীরে, এবং ওর মা আমাকে উদ্দেশ্য করে ক্ষুব্ধ স্বরে বলছিল, ও এখন গাড়ির নিচে মাথা দিয়া মরবার জন্য যাইতেছে। আমি এ কথার গুরুত্ব না দিয়ে ভাবলাম, এটা ওর মায়ের আশংকা, সাইফ মরতে যাবে কেন? ও বরং আমার দৃষ্টি থেকে একটু দূরে যাচ্ছে, হয়তো বাগানে গিয়ে দোলনায় বসবে, অথবা রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করবে; যখন ও ভাববে আমার রাগ পড়ে গেছে, তখন আলগোছে ঘরে এসে ঢুকবে।
লায়লা, সাইফের মা একটু পরই বাসা থেকে বের হয়ে গেলো। তার শরীর ভালো না কয়েক মাস ধরে। সে মিনিট সাতেকের মতো বাইরে, আশোপশে আছে এমন মনে হলো না। আমি দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হই। একটু পর আমিও বাইরে চলে আসি। দরজা থেকে দশ গজ দূরে ছোটো রাস্তা। রাস্তার পশ্চিম-পূর্বে তাকিয়ে লায়লাকে দেখতে পেলাম না। সিকিউরিটি গার্ডের লোকটাকেও দেখছি না। আমি কোন্ দিকে যাবো ভেবে ঠিক করতে পারছিলাম না। এমন সময় লায়লাকে পূর্ব দিক থেকে হেঁটে আসতে দেখলাম। তার পেছনে সিকিউরিটি গার্ডের লোক। কাঁপা গলায় বললাম, 'পাইছো?' লায়লা রাগত স্বরে জবাব দেয়, 'সে মরবার গেছে। তারে কই পামু?' বলে হন হন করে বাসার ভেতর চলে গেলো। সিকিউরিটি গার্ডকে জিজ্ঞাসা করি সাইফকে যেতে দেখেছে কিনা। সে জানালো ম্যাডাম তাকে আগেই বলেছিল ভাইয়াকে ধরে আনতে, কিন্তু ভাইয়াকে রাস্তায় পাওয়া যায় নি। তবে তেমাথার গার্ড তাকে বাজারের দিকে যেতে দেখেছে। আমি তেমাথায় যেয়ে আরো কয়েকজনকে জিজ্ঞাসা করি নিশ্চিত হবার জন্য, সাইফ সত্যিই বাজারের দিকে গেছে, নাকি অন্যদিকে। কিন্তু তেমাথার গার্ড ছাড়া আর কেউ কোনো তথ্য দিতে পারলো না, এবং আমি মোটামুটি নিশ্চিত হলাম সাইফ বাজারের দিকেই গেছে। ওর পকেটে ৫০০ টাকার একটা নোট আছে। সে সপ্তাহ খানেক আগে সায়েদাবাদে তার মেঝ মামার বাসায় গিয়েছিল। ৫০০ টাকা পকেটে থাকায় তার একটা শক্তি ও আত্মবিশ্বাস হয়েছে, তাই সে ঢাকায় রওনা দিয়েছে। টিপরা বাজার থেকে ঢাকার সর্বশেষ বাস রাত ৯টায় ছেড়ে যায়, তখন সবে সন্ধ্যা ৭টা।
ইস্পাহানি পাবলিক স্কুল ও কলেজের প্রিন্সিপালের বড় ছেলে নির্ঝরের সাথে সাম্প্রতিক কালে সাইফের সর্বাধিক ঘনিষ্ঠতা ও সখ্যতা লক্ষ করা গেছে। নির্ঝর গিটার বাজায়। সাইফের একটা গিটার আছে গত ১০ মাস ধরে। নির্ঝরের গিটার নেই, কিন্তু সাইফকে গিটার বাজানো শেখায়, সাইফকে বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে নিয়ে যায়, বড় ভাইয়ের মতো স্নেহ করে। কিছুদিন সে সাইফকে কেমিস্ট্রি পড়িয়েছে; পড়াশোনায় অমনোযগী সাইফকে অনেক সদুপদেশ দিয়ে থাকে নির্ঝর। সে সাইফের একজন বড়ভাই তুল্য ভালো বন্ধু। সন্ধ্যার কিছু পূর্বে ঘুম থেকে জেগে সাইফকে বাসায় না পেয়ে মোবাইলে কল দিলে সে জানিয়েছিল সে প্রিন্সিপালের বাসায় নির্ঝরের সাথে আছে। আমি তাকে বাসায় আসতে বললে সে মিনিট দশেকের মধ্যে বাসায় চলে আসে। সে আগামীবার এসএসসি পরীক্ষা দেবে। নির্ঝর এবার অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। ওর সাথে থেকে থেকে গিটার বাজানোর নেশায় পড়ে সাইফ মূল্যবান সময় নষ্ট করছে। ওর কাছে পড়ার নাম করে রাতের বেলা ওদের বাসায় গিয়ে কেমিস্ট্রি না পড়ে গিটার বাজানোর তালিমও নিয়ে থাকতে পারে। নির্ঝরের সাথে এতো সময় কাটানো আমার পছন্দ হচ্ছিল না। আমি দেশে ফিরেছি ৪ জুলাইয়ে, বাসায় এসেছি ১১ জুলাই বিকেলে, মাত্র দুদিন আগে। গতকাল বিকেল ৪টা থেকে রাত দেড়টা পর্যন্ত সে আমার কাছে পড়েছে। সাধারণ গণিতের একটা গুরুত্বপূর্ণ চ্যাপ্টার রাত ৮টা পর্যন্ত; এরপর বাংলা 'স্বাধীনতা তুমি' কবিতা ও 'দুই মুসাফির' গল্প পড়িয়েছি তাকে। 'দুই মুসাফির' সে কিছুই বোঝে নি ক্লাসে, এটা একটা জটিল গল্প মনে হয়েছে ওর কাছে। সে ৪র্থ শ্রেণী পর্যন্ত ইংলিশ মিডিয়ামে পড়েছে; এরপর আমার কর্মস্থলে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল না থাকায় ৫ম শ্রেণী থেকে বাংলা মিডিয়ামে পড়েছে; কুমিল্লা সেনানিবাসস্থ ইস্পাহানি পাবলিক স্কুল ও কলেজে পড়ছে ৮ম শ্রেণী থেকে। সে ৯ম শ্রেণীতে উঠবার পর বলেছিল ইংলিশ ভার্সনে পড়বে, কারণ, তার বাংলা পড়তে খুব সমস্যা হয়। অনেক বোঝানোর পরও সে বাংলা ভার্সনে পড়তে রাজি না হওয়ায় অবশেষে আমি রাজি হয়ে তাকে ৯ম শ্রেণীতে ইংলিশ ভার্সনে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলাম। সে বাংলা ভার্সনের চেয়ে ইংলিশ ভার্সনে অনেক ভালো করতে থাকলেও আমার প্রত্যাশা অনুযায়ী ফলাফল পাচ্ছিলাম না। সে বাংলা সাহিত্য, বিশেষ করে কবিতা একদম বোঝে না। কিন্তু কাল রাতে 'স্বাধীনতা তুমি' খুব দ্রুত শেষ করে, এবং আমি যারপরনাই খুশি হই। তাকে লাইন বাই লাইন 'দুই মুসাফির' বুঝিয়ে দিই। সে আমার রুম থেকে তার নিজ রুমে চলে যাবার সময় আমাকে কমপ্লিমেন্ট করে, 'আপনি খুব ভালো বাংলা পড়ান।' আমি কৌতুক করে বলি, 'তোমার কোন্ সাবজেক্টটা আমি কম ভালো পড়াই?' আমাদের সেই রাতটা খুব বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল। পড়ানোর পর তার রুমে গিয়ে বেশ কিছুক্ষণ তার সাথে ফান করি, কিছু উপদেশও দিই। তারপর ঘুমিয়ে পড়ি। সকালে স্কুলে যাবার আগে কেমিস্ট্রি ও ফিজিক্সের গ্রুপ কোচিং বাবদ ১০০০ টাকা চেয়ে নিয়ে গেলো, প্রতি সাবজেক্টে ৫০০ টাকা করে। কেমিস্ট্রিতে এক টিচারের কাছে মাস খানেক যাবত টিউশনি পড়ছে, কিন্তু তার ফি-এর অংক জানা নেই বলে সে টাকা দিতে পারি নি; তবে সাইফকে বললাম কতো দিতে হবে অন্য ছাত্রদের কাছ থেকে আজ জেনে এসো, ওটা কাল দিয়ে দেবো। বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে সাইফ স্কুল থেকে এসে তাড়াহুড়ো করে পোশাক পাল্টে কোচিঙের জন্য স্কুলে চলে যায়। ফিজিক্স টিচারের ৫০০ টাকা পরিশোধ করা হলেও কেমিস্ট্রি টিচারকে পাওয়া যায় নি বলে তাঁর প্রাপ্য ৫০০ টাকা সাইফের কাছে রয়ে গেছে। সাইফ কোচিঙে চলে যাবার পর থেকেই আমি অপেক্ষায় থাকি, ও ফিরে এলে পড়াতো বসবো। আমার কর্মব্যস্ততার জন্য সব সময় সাইফ আর ঐশীকে পড়াবার সুযোগ পাই না। ঐশীর চেয়ে সাইফ অনেক বেশি ব্রিলিয়ান্ট। কিন্তু ঐশী খুব শান্ত, ধৈর্য্যশীলা, অধ্যবসায়ী, পরিশ্রমী এবং পড়াশোনায় খুব মনোযোগী। সে নিয়মিত দিনের পড়া দিনে শেষ করে। ক্লাসে ৮ম শ্রেণীতে ওর রোল নম্বর ৪ ছিল, এবং ক্লাসে ফার্স্ট হবার জন্য সব সময়ই তার মনের মধ্যে একটা তীব্র জেদ ও আকাঙ্ক্ষা কাজ করতো সব সময়। সি নিশ্চিত জেএসসিতে জি+ পাবে ধারণা ছিল; কিন্তু কৃষি শিক্ষার জন্য সে জিপিএ ৪.৮৬ পেয়েছে। ওদের ক্লাসে ৪ জন এবার বৃত্তি পেয়েছে, ঐশী তাদের একজন (বি গ্রেডে পেয়েছে)। পড়াশোনার জন্য ঐশীকে কখনো বলতে হয় না; বরঞ্চ অধিক রাত জেগে যখন যে পড়তে থাকে, তখন আমি তাকে শুয়ে পড়তে বলি। ঐশীকে পড়িয়ে ওর প্রাইভেট টিউটরগণ খুব আনন্দ পান, কারণ, ওকে পড়াবার জন্য তাঁদেরকে কষ্ট করতে হয় না। ক্লাসে ঐশীর জনপ্রিয়তা অনেক বেশি; সে ৯ম শ্রেণীতে দু-বার স্টুডেন্ট অব দ্য মান্থ হয়েছে। ২য় বারের মতো পাবলিক ডিমান্ডে তাকে ক্লাস ক্যাপ্টেন হতে হয়েছে। ঐশী একজন আদর্শ ছাত্রী। ওদের পড়াশোনার অগ্রগতি কীরকম হচ্ছে নিজে না দেখা পর্যন্ত আমার স্বস্তি হয় না; তাই অনেক কষ্ট করে ওদেরকে পড়াবার যে সময়টুকু আমি বের করে নিই, তার পুরোটুকুই কাজে লাগাবার জন্য সব সময় চেষ্টা করি। ওরা দু-ভাইবোন প্রায়ই বলে, আমি একদিনে ওদেরকে যতোটুকু পড়াই ও বোঝাই, ক্লাসে দুই মাসেও এতোখানি সম্ভব নয়; বিশেষ করে অংক এবং ইংলিশ সেকেন্ড পেপারে ওরা আমার কোচিঙে ব্যাপকভাবে উপকৃত হয়। কিন্তু সাইফ পড়াশোনায় বড্ড অমনোযোগী। ইন্টারনেট, মোবাইল, কম্পিউটার, গান-বাজনা, ইত্যাদির পেছনে ওর দিনের বেশিরভাগ সময় পার হয়ে যায়। অনেক সময় পরের দিন যে একটা পরীক্ষা আছে সে-কথাটাও সে ভুলে গিয়ে দিব্যি মোবাইল বা পিসিতে মগ্ন হয়ে পড়ে থাকে, পরীক্ষার কথা মনে করিয়ে দেবার পর হঠাৎ টনক নড়ে, কিন্তু কিছুক্ষণ বই নাড়াচাড়া করলেও আবার ইন্টারনেটে ঢুকে পড়ে। এভাবে প্রায় প্রতিরাতেই ভোর ৩-৪টা বা আরো বেশি সময় পর্যন্ত সে রাত জেগে টই টই করতে থাকে, আর সকাল হলে অনেক সময় মাথা ব্যথা বা অন্য অজুহাতে স্কুল কামাই করে। এটা সাইফের একটা পুরোনো রোগ, এ থেকে ওকে বের করিয়ে আনবার জন্য যতো ধরনের পন্থা আছে সবই এ্যাপ্লাই করা হয়েছে। আমি গত এক বছর ধরে বিদেশে থাকা কালে ওর মা দিনে অন্তত দু-বার ওর পড়ালেখার ব্যাপারে আমার কাছে অভিযোগ করতো। মোবাইলে সাইফকে আমি খুব বোঝাতাম, নরম স্বরে, কখনো বা রাগ করে বলতাম- তুমি পরীক্ষায় ভালো না করলে তোমার সাথে আর কথা বলবো না। এভাবে একবার ও পরীক্ষায় খারাপ করলে আমি ওর সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিই, কিন্তু সাইফ তাতে কস্ট পাওয়ার বদলে রিলিফ ফিল করেছিল, ও আগের চেয়ে আরো বেশি অমনোযোগী হয়ে পড়েছিল। আমি কষ্ট পাচ্ছিলাম যে সাইফ কেন আমার সাথে কথা বলবার জন্য কোনোরূপ আকুতি প্রকাশ করলো না। এমন সময় ওর জন্ডিস হলে আমি নিজেই ঘাবড়ে যাই, ওর সাথে কথা বলি, প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিই; ওর মা নিজে অসুস্থ হওয়া সত্ত্বেও সাইফকে নিয়ে একা একা হাসপাতালে ছোটাছুটি করে করে। সে সময় ওর ১০ম শ্রেণীর ১ম সাময়িক পরীক্ষা চলছিল। জন্ডিস হবার কারণে সে পরীক্ষা দিতে পারে নি। ৩০ জুলাই থেকে ওর প্রিটেস্ট পরীক্ষা। ১ম সাময়িক পরীক্ষা দিতে পারে নি, তাই প্রিটেস্ট ও টেস্ট পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়ে ১ম সাময়িকের ঘাটতি পূরণ করতে হবে, তা না হলে এসএসসির জন্য তাকে এ্যালাউ করা হবে না। সাইফ যেন প্রিটেস্ট পরীক্ষায় খুব ভালো করতে পারে, সেজন্য আমি নিজে ওকে এ ক'দিন পড়াবার জন্য খুব উদগ্রীব ছিলাম।
সাড়ে ৩টার দিকে সাইফ কোচিঙে চলে যাবার পর থেকে ওর অপেক্ষায় থাকতে থাকতে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম ভাঙবার পর ওর খোঁজ নিয়ে জানলাম সে এখনো বাসায় ফিরে নি। মোবাইলে কল করে যখন শুনলাম সে নির্ঝরদের বাসায়, তখন থেকেই আমার রাগ হতে থাকে। সে বাসায় আসার পর তাকে জিজ্ঞাসা করি নির্ঝরদের বাসায় যাবার কারণ কী ছিল। সে জানায় তার আরো দুজন বন্ধু এসেছিল ও বাসায়, তাদের সাথে গল্প করছিলাম। এটা আড্ডা করে সময় নষ্ট করবার সময় নয়। তাকে বিভিন্ন ভাবে জেরা করতে থাকি ও পরামর্শ দিতে থাকি। আমি তাকে পড়ানোর জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম সে-কথা সাইফকে বলতে থাকি। কিন্তু সাইফ আমার সাথে তর্ক করতে থাকে। তাতে আমি অধৈর্য্য হয়ে পড়ি এবং খুব রেগে যাই। এক পর্যায়ে তার পিঠে দুটো থাপ্পড় দিই। লায়লা এতে রাগান্বিত হয়। ওকে ডাইনিং রুমে নিয়ে ভাত খেতে দেয়। সে সারাদিন খায় নি। না খেয়ে থাকার একটা বদ্ অভ্যাস আছে সাইফের। খেতে চায় না। তরকারি ভালো না হলে ওর খিদে চলে যায়। লায়লা ওকে ভাত বেড়ে দিচ্ছে আর আমাকে বকছে। আমি মুহূর্তে আমার ভুল বুঝতে পারি। ছেলেটাকে মারধোর করা ঠিক হয় নি। একটু লজ্জা লজ্জা ভাবও এসে পড়লো চোখে। আমি ড্রয়িং রুম থেকে উঠে ডাইনিং রুমে ওর সামনে গিয়ে বসলাম, ওর সাথে সহজ হবার জন্য, যাতে আমার কথাবার্তায় আমি ভুল করেছি তা ফুটে ওঠে, এবং এজন্য আমি দুঃখিত ও লজ্জিত তা যেন ও বুঝতে পারে। কিন্তু সে-সময় সাইফও খুব রেগে ছিল। আমার প্রতিটি কথায় সে তর্ক করছিল, আর বাবা-মা বা বড়দের সাথে তর্ক করা ভালো নয়, আমি এটা তাকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম। সাইফ তখন ভাতের প্লেট থেকে হাত উঠিয়ে নিয়েছে, লায়লা আমাকে বকছিল ওখান থেকে উঠে সরে যাওয়ার জন্য। আমি উঠে চলে যাবো, তার আগে বলছিলাম, যেখানেই যাও, আজানের আগে প্রতিদিন তোমাকে বাসায় দেখতে চাই। রাতের বেলা ঘরের বাইরে থাকা আমার পছন্দ নয়। এ-কথা বলতে বলতে আমি ডাইনিং রুম থেকে উঠে ড্রয়িং রুমে এসে বসলাম। বসে বললাম, তোমার প্রাইভেট টিউটর মাঝে মাঝে তোমার বিরুদ্ধে কমপ্লেইন করে তোমার বই-টই ঠিক থাকে না। তুমি বইপত্র গুছিয়ে রাখো না কেন? এর একটু পর ওর একটা মুখের শব্দ শুনলাম, রাগ করার, আর একটা তীক্ষ্ণ শব্দ কিছু একটা জোরে ছুঁড়ে মারার। তার একটু পরই সে ভাত না খেয়ে আমার সামনে দিয়ে বাইরে চলে গেলো। লায়লা আমাকে বকতে লাগলো, সারাদিন ছেলেটা কিছু খায় নাই। এখন খাইতে বসছিল, তাও খাইতে দিলা না। সে এখন চইলা যাইতেছে, রাস্তায় গাড়ির নিচে মাথা দিয়া মরবো।
আমি নিশ্চিত যে সাইফ বাজারের দিকে চলে গেছে, এবং প্রিন্সিপালের বাসা অন্যদিকে, তবু আমার মনে হলো ও হয়তো ও-বাসাতেই নির্ঝরের কাছে গিয়ে থাকতে পারে। আমি প্রিন্সিপালের বাসায় গিয়ে কলিং বেল টিপে দরজা খোলা পেয়ে ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে নির্ঝরকে ডাকতে থাকি। সে উপরের তলায় ছিল। আমার ডাকে সে ও তার ছোটো ভাই নিচে নেমে এলে জিজ্ঞাসা করি সাইফ এসেছে কিনা। ওরা জানায় বিকেলে এসেছিল, আপনি মোবাইলে কল করার পর বাসায় চলে গেছে। আমি স্বল্প কথায় ওদের খুলে বলি সাইফ রাগ করে বাসা থেকে বের হয়ে গেছে। আমি ওদের কাছে সাইফের ক্লোজেস্ট বন্ধুদের নাম জানতে চাই, এবং এ অবস্থায় কোথায় কোথায় সে গিয়ে থাকতে পারে সে-বিষয়ে ওদের মতামত জানতে চাই, এবং এ ব্যাপারে আমাকে সর্বপ্রকার সাহায্য করবার জন্য ওদের কাছে আকুতি জানাই। সাইফকে ১ মাস আগে ওর মা একটা মোবাইল কিনে দিয়েছে, আমার অগোচরে; পড়ালেখায় ক্ষতি হবে, কারণ, ইন্টারনেটের প্রতো ওর ঝোঁক খুব বেশি, এজন্য আমি মোবাইল কিনে দিতে সম্মত হবো না বলে লায়লা আমাকে এটা জানায় নি- সাইফ খুব মিনতি করেছিল মোবাইলের জন্য, আর ওর মা সে মিনতি উপেক্ষা করতে পারে নি। সাইফ বের হয়ে যাবার কালে ওর মোবাইলটি নিয়ে যায় নি। নির্ঝর আর ওর ছোটোভাই মিলে মোবাইলে সাইফের সব বন্ধুর সাথে কথা বলতে লাগলো। মেয়েদের মধ্যে সানজানার সাথে সাইফের অন্তরঙ্গতা একটু বেশি, কারণ, ৫ম শ্রেণীতে অন্য এক স্কুলে ওরা একসাথে পড়তো। আমি সানজানাকে ফোন করে জানতে চাই সাইফের খবর। সানজানা অবাক হয় ও দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়। সে খুব সম্ভবত ওদের আরো ক্লাসমেটদের কাছে ফোন করে। কারণ, আরো কয়েকটা ছেলে ও মেয়ে নির্ঝরের কাছে ফোন করে বিস্তারিত জানতে চাইল, আর ওরা জানিয়েছে সানজানার কাছ থেকে সাইফের পালিয়ে যাবার খবর জানতে পেরেছে। ইরম নামক এক ক্লাসমেটের সাথেও সাইফের খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল। ইরমকে ফোন করে জেনে নিলাম তোমার তো অনেক সময় একসাথে আড্ডা দিতে, জায়গাগুলোর নাম বলবে? ইরম বললো ক্যান্টনমেন্টের ভিতরে কুটীলামোড়া ও সুইমিং পুলের কাছে তারা বন্ধুরা অনেক আড্ডা দিয়েছে। নির্ঝর বললো, আঙ্কল, চলুন, আমরা কুটীলামোড়া আর সুমিংপুলে যাই। আমরা একটা গাড়ি নিলাম। প্রথমে কুটীলামোড়া যাবো। যাবার পথে এক জায়গায় গাড়ি থামালো নির্ঝর; বললো, ঐ মাঠের এক পাশে আমি আর সাইফ মাঝে মাঝে বসে গল্প করতাম। সন্ধ্যায় বৃষ্টি ছিল, আকাশ মেঘলা, অন্ধকার খুব তীব্র। ঘন অন্ধকারে আমরা সে জায়গা খুঁজলাম। এরপর গেলাম কুটীলামোড়া। কুটীলামোড়ার চারপাশ ঘন জঙ্গলে আচ্ছন্ন। আমি আর নির্ঝর কালো অন্ধকারে মোবাইলের আলোতে পথ দেখে কুটীলামোড়ার চারপাশ দেখলাম, আর খুব ভয় পেলাম- এই ভয়ঙ্কর জায়গায় ছেলেগুলো আড্ডা দিত কীভাবে? এরপর গেলাম সুইমিং পুল। ওখানে সুইমিং পুলের কাজের ছেলেরা আলো জ্বেলে পড়ছিল, নির্ঝর ওদেরকে ডাকতেই 'ভাইয়া' 'ভাইয়া' বলে ওরা ছুটে এলো। ছেলেগুলো সাইফকে চিনে, নির্ঝরের সাথেই তাকে ঘুরতে দেখেছে ওরা; নির্ঝর প্রিন্সিপালের ছেলে হওয়ায়, এবং খুব সৎ ও বিনয়ী এবং মিশুক স্বভাবের হওয়ায় তার ব্যাপক পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা রয়েছে এখানে। গাড়িতে চলতে চলতে নির্ঝর অনেকের কাছে ফোন করলো, অনেক ফোন এলোও, কিন্তু কেউ সাইফের কোনো তথ্য দিতে পারলো না।
নির্ঝর এরপর আমাকে ক্যান্টনমেন্টের গেইটের কাছে নিয়ে গেলো। মিলিটারি পুলিশদেরকে সাইফের বর্ণনা দিয়ে জানতে চাইলো তারা ৬ ফুট লম্বা, কালো প্যান্ট ও কাল টি-শার্ট পরা কোনো যুবককে গেইট দিয়ে যেতে দেখেছে কিনা। তাঁরা শুনে খুব আফসোস করলেন, এবং তাদের সবগুলো গেইটে এবং ক্যান্টনমেন্টের ভেতরের ভ্রাম্যমান টহলদলগুলোকে এ খবরটা জানিয়ে দিলেন, যদি এমনতরো কোনো যুবককে পাওয়া যায়, যেন খবর দেয়া হয়। হয়তো অন্ধকারের পথ ধরে ক্যান্টনমেন্টের ভিতরে রাস্তায় হাঁটছে সাইফ, সেটা মনে করে অনুমতি নিয়ে নির্ঝরকে সাথে করে সবগুলো সড়ক আমরা খুঁজে দেখলাম। যেখানে যাকে পেলাম, গাড়ি থামিয়ে তাদের সাথে কথা বললাম। সবশেষে স্কুলের গেইটে এলাম। হোস্টেলের ছাত্ররা তখন ক্লাসে বাধ্যতামূলক স্টাডিতে ব্যস্ত, কয়েকজন শিক্ষকও আছেন ওখানে। গেইটের দ্বারোয়ান সাইফকে চেনে। সে জানালো সাইফকে সে দেখে নি। রাতে কারণ ছাড়া এবং প্রিন্সিপালের অনুমতি ব্যতীত স্কুলে ঢুকবার কোনো নিয়ম নেই; নির্ঝর তবুও দ্বারোয়ানকে অনুরোধ করলো ভিতরে গিয়ে একটু দেখে আসার জন্য।
আমরা ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে গেলাম। নির্ঝর নিয়ে গেলো টিপরা বাজারের 'কাকলী' রেস্টুরেন্টে, যা ওভারব্রিজের গোড়ার দিকে অবস্থিত, যেখানে নির্ঝরের সাথে বেশ কয়েকবার সাইফ স্যুপ ও অন্যান্য খাবার খেয়েছে। কাকলীর লোকজন নির্ঝরকে চেনে। সাইফের বর্ণনা শুনে তারা বললো ঐরকম এক ছেলে আরো দুজন বন্ধু সহ রেস্টুরেন্টে এসেছিল, কিন্তু তা সন্ধ্যার বেশ আগে। আমরা হতাশ হয়ে আরেকটা ভালো মানের রেস্টুরেন্ট 'কে হোসেন'-এ গেলাম। ওখানেও সাইফ গেছে বলে কোনো সন্ধান পাওয়া গেলো না। এরপর গেলাম টিসা বাস কাউন্টারে- অবশ্য এর আগে লায়লা এ কাউন্টারে ঘুরে গেছে। কতো মানুষ বাসে উঠছে-নামছে, কারো পক্ষে কি কাউকে চিনে রাখা সম্ভব? 'মিয়ামী' রেস্টুরেন্টেও আমরা বেশ কয়েকবার খেয়েছি; ওখানে গেলাম। কিন্তু কোনো হদিশ পাওয়া গেলো না।
এর মধ্যে রাত বারোটা পার হয়ে গেছে। রাস্তার ধারে একটা বড় বাস ও মাইক্রোবাস দেখেছিলাম, এক্সিডেন্ট করেছিল। নির্ঝরকে নিয়ে ঘুরছি, হঠাৎ সে জানালো ঐ মাইক্রোবাসে তার আব্বু-আম্মু আসছিল; মাইক্রোবাসের সামান্য ডেন্ট হলেও তার মা-বাবার কিছু হয় নি। আমি এ খবর শুনে নির্ঝরকে ওদের বাসায় নামিয়ে দিয়ে আসি।
তারপর শহরের দিকে যেতে থাকি; যেতে যেতে রাস্তার দু-ধারে আমার চোখ; আবাসিক হোটেল ও রেস্টুরেন্ট সামনে পেলেই থামি ও খোঁজ-খবর নিই। রেল-লাইন পর্যন্ত গিয়ে গাড়ি থেকে নামলাম। রাস্তার দুই পাশে অনেক দূর পর্যন্ত হেঁটে গিয়ে সাইফকে খুঁজলাম- যদিইবা সে এক জায়গায় কাত হয়ে পড়ে ঘুমিয়ে গিয়ে থাকে, কিংবা হাঁটুর উপর মাথা গুঁজে বসে থাকে!
সাইফের ঘনিষ্ঠতম দুই বন্ধুর একজনের নাম উচ্ছ্বাস, অন্যজনের নাম আকাশ। অনেক চেষ্টার পর উচ্ছ্বাসের সাথে মোবাইলে যোগাযোগ হলেও আকাশের মোবাইল বন্ধ বলে কোনো যোগাযোগ হলো না। ওদের দুজনের বাসাই কুমিল্লা শহরে। আকাশদের বাড়িতে একটা বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়েছিল সাইফ কয়েক মাস আগে, ওর সাথে কয়েকবার ঘোরাঘুরিও করেছে শহরে। ওর মোবাইল বন্ধ কেন? সাইফ কি ওর ওখানে গেছে? সাইফের অনুরোধেই কি আকাশ মোবাইল বন্ধ রেখেছে, যাতে আমরা ওদের সাথে কোনো যোগাযোগ করতে না পারি? মনের কোণে এ আশাটুকু একটু ভরসা দিল।
ঢাকা সহ সবখানের সব আত্মীয়ের সাথে যোগাযোগ হলো। কারো সাথে সাইফের কোনো যোগাযোগ হয় নি।
বাসায় যখন ফিরে আসি, তখন রাত ৩টার মতো বাজে। লায়লার অসুস্থ শরীর। সে জেগে আছে। আমার পা চলে না। দম আটকে আসে। ড্রয়িং রুমে ঢুকে দরাম করে মাটিতে বসে পড়ি। আমার বুক ভেঙে যাচ্ছিল। মুহূর্তের জন্য যেন ওরা চোখের আড়াল না হয়, সেজন্য আমার ছিল এতো কড়াকড়ি। ঠিকমতো শুতে পেলো কিনা, ভালোমতো বিছানা পাতা হলো কিনা, ফ্যান ছাড়া হয়েছে কিনা, ঘরে বাতাস ঢুকছে কিনা, রাতে ঘুম ভাঙলেই ওদের ঘরে গিয়ে এসব দেখি। জানালা খুলে দিই, যাতে ভ্যাঁপসা গরম আটকে না থাকে। এতো আদরের সোনার মানিক, এখন সে কোথায় কোন্ রাস্তায় অনাথের মতো পড়ে আছে! কিছু কি খেয়েছে, নাকি না খেয়ে মরার মতো কোনো এক জায়গায় পড়ে ছিল, বেহুঁশ হয়ে এখন মরার মতো পড়ে আছে? নাকি সত্যিই গাড়ির নিচে মাথা দিয়ে সুইসাইড করলো? আমি কোনোমতেই নিজেকে শান্ত রাখতে পারছিলাম না।
উপরে লায়লাকে শুইয়ে দিয়ে ঘরের সমস্ত কোণাকাঞ্চি খুঁজে দেখলাম। তারপর নিচতলায় ড্রুইংরুমের ফ্লোরে শুয়ে পড়লাম। বাতাসে পর্দা একটু নড়ে উঠলেই লাফ দিয়ে উঠি, হয়তো সাইফ ফিরে এসেছে- জানালার কাছে যাই- চারদিক শূন্য, বুক হু-হু করে ওঠে।
একটু পর ল্যাপটপ অন করলাম। ওর ফেইসবুকের ফ্রেন্ডস লিস্টে আমি বা ঐশী (মেয়ে) নেই। ওর কাছে একটা মেইল করলাম। ওর ফ্রেন্ডস লিস্টে যারা ছিল সবার কাছে মেইল করলাম। তারপর শুয়ে পড়লাম। একটু পর পর ঘুম ভাঙে, আর জানালার কাছে যাই। সাড়ে পাঁচটায় বিছানা ছাড়লাম। বাসা থেকে বের হয়ে টিপরা বাজারে গেলাম। পুরো বাজারের আনাচে কানাচে ঘুরলাম। একটা সিএনজি নিলাম। বাস-কাউন্টারে এসে কয়েকজনের সাথে কথা বললাম। তারপর শহরের দিকে যেতে থাকলাম। এবারও যতো রেস্টুরেন্ট আর হোটেল চোখে পড়লো, খোঁজ নিলাম। আবারও রেল-লাইন পর্যন্ত গেলাম। উল্টো দিকে ঘুরে নিমসার বাজার পর্যন্ত এলাম। তারপর আবার ক্যান্টনমেন্টের ভিতরে ঢুকে কুটীলামোড়া গেলাম। সুইমিং পুলে গেলাম। তখন ৮টা বেজে গেছে। বাসায় ফিরে এসে ঐশীকে বললাম খুব জলদি কিছু খাবার জোগাড় করে দিতে। ও কিছু আম গুলিয়ে মুড়ি মাখিয়ে দিল (ও রান্নাবান্না পারে না এখনো)। আমি পকেটে বেশি করে কিছু টাকা নিলাম, হয়তো ঢাকা চলে যেতে হতে পারে, এ আশায়। আমি সিএনজি নিয়ে ইস্পাহানি পাবলিক স্কুলে এলাম। সিএনজি দাঁড় করিয়ে ভিতরে ঢুকে ভাইস প্রিন্সিপালের অফিসে ঢুকে সালাম জানিয়ে আমার পরিচয় দিলাম এবং সাইফের পালিয়ে যাবার ঘটনা বললাম। তিনি খুব মনোযোগ দিয়ে আমার বর্ণনা শুনে কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলেন, এরপর সাইফের ক্লাসের হাজিরা খাতা আনালেন, ওর ক্লাসের ক্লাস ক্যাপ্টেন সহ ৪ জন ছাত্রকে ডেকে আনলেন।
(অসমাপ্ত)