তৃণা আমাদের স্কুলবান্ধবী। ওর গায়ের রং শ্যামলা, হালকাপাতলা শরীর। ক্লাসে এবং স্কুলে সুন্দরী মেয়ের সংখ্যা নেহায়েত কম ছিল না। কিন্তু তৃণা যেরকম সুন্দরী ছিল, তার বর্ণনা শুধু এভাবেই দেয়া সম্ভব- ও যে-যুবকের দিকে তাকায় সে মুহূর্তে ঘায়েল হয়ে যায়; যে-যুবক ওর দিকে তাকায়, সে সুন্দরত্বের একটা নতুন সংজ্ঞা অনুভব করে।
সপ্তম শ্রেণীতে ওঠার পর আমরা ছেলেমেয়েরা একসাথে ক্লাস করতে শুরু করি। আমাদের চোখের সামনে একটা নতুন ভুবন খুলে গেলো। এতোদিন দূর থেকে মেয়েদের দেখেছি, ওদের ওড়না উড়তে দেখেছি; এখন ওরা আমাদের নিশ্বাসের খুব কাছে এসে বাহু ঘেঁষে বসে; ওদের শরীরের ঘ্রাণ পাই; ওরা একটু সামনে ঝুঁকে পড়লে আমরা সারসের মতো ঘাড় উঁচু করে ওদের কামিজের ফাঁক গলিয়ে দৃষ্টি ছুঁড়ে দিই ওদের অতি কচি উদ্ভিন্ন স্তনের দিকে; এক ঝলক দেখে ফেললে অনির্বচনীয় শান্তি পাই, আর মনের ভেতর নেশা তীব্রতর হতে থাকে- আহা, যদি একটুসখানি ছুঁয়ে দেখা যেতো!
তৃণার চাহনিতে তীব্র ধার ছিল। যথারীতি ঘায়েল হয়ে গেলাম। আমি খুব বর্ণচোরা আর মুখচোরা। শুধু ভাবি আর মনে মনে খাই। আমি ভীতুর ডিম। তৃণা আমার দিকে তাকালেই আমি চোখ নামিয়ে ফেলি, আর মনে মনে ওর ভেতরে ঢুকে যেতে থাকি। এর চেয়ে আরামপ্রদ ও সহজতর পন্থা আমার জানা ছিল না।
তখন ইঁচড় আরেকটু পেকেছে- ১০ম শ্রেণীতে উঠবার পর একদিন। মেয়েরা তৃণাকে বেঞ্চিতে এককোণে করে রেখেছে, আর তৃণার মুখমণ্ডল অন্ধকার।
কী হয়েছে! দারুণ করুণ সরস খবর! খবরটা শুনে খুব কষ্ট পেলাম। তৃণা এমন একটা কাজ করলো! সে আরেকটা ছেলেকে চোখটিপ মারতে পারে, আমি মন খারাপ করবো না। কারো প্রেমে পড়তে পারে, সে কোনো ছেলেকে প্রেমপত্র লিখতে পারে, বা ছেলেরা তাকে, আমি মন খারাপ করবো কোন্ দোষে! আরেকটা ছেলের হাত ধরাধরি করে সে হাঁটতে পারে দিগম্বর রাস্তায়, সিনেমায় যেতে পারে- হলঘরে অন্ধকারে সাথের ছেলেটা ওর বুকে হাত রাখলে, কিংবা উরুতে, কিংবা চুমু বিনিময় করলে কিছুটা কষ্ট আমার লাগতেই পারে, তাও খুব স্বাভাবিক সমস্যা;
কিন্তু তৃণা এ কাজ কীভাবে করলো? ও কারো সাথে হোটেলে রাত কাটিয়েছে, আর রাতভর তাকে সঙ্গম দিয়েছে- আমার কলজে খাবলে কেটে নিয়ে গেলেও কি এতোখানি কষ্ট আমি পেতাম?
- না।
আমাদের, অর্থাৎ ছেলেমেয়েদের একচেটিয়া দাবির মুখে তৃণা কাঁদতে কাঁদতে ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল।
তৃণা অনেকদিন ক্লাসে আসে নি; বছর খানেক তো হবেই। আর এ সময়ে আমার ভেতরে নিরন্তর দহন অনুভব করেছি।
এসএসসির কিছু আগে তৃণা চুপি চুপি একটা চিরকুট পাঠিয়েছিল।
‘তুই বললেই আমি পরীক্ষাটা দিতে পারি।
আর খোদার কসম, আমি নির্দোষ।’
তৃণা ভালো ছাত্রী ছিল না কোনোদিনই। এসএসসির রেজাল্টও খুব ভালো হয় নি। পরীক্ষা চলবার সময় ওর সাথে দুয়েকবার চোখাচোখি হয়েছিল- আমি জানি না তখন আমি কোথায় ছিলাম।
এরপর কতোদিন চলে গেছে- তৃণার কথা মনে হলেই গুটিবসন্তের ঘা-গুলো দগদগে হয়ে উঠতো।
চিরতা একদিন বললো, তৃণার কথা মনে পড়ে? ও আজ ফোন করেছিল।
আমি এক ফুৎকারে উতলা হয়ে পড়লাম। তৃণাকে আমার চাই-ই।
তার ৩দিন পর তৃণার ফোন।
তৃণার কণ্ঠস্বর ওর লাবণ্যের মতো মিষ্টি নয় আজকাল! চিরতা ওর চেয়ে ঢের গুছিয়ে কথা বলে, কণ্ঠে অমৃতের মধু।
তৃণার সাথে কথা চলতে থাকে। অবিরাম। আমি যে কথাটা বলতে চাই সেটা মাথায় রেখে এগুতে থাকি। কিন্তু সেটা বলার উপযুক্ত শব্দগুচ্ছ ও পটভূমি মেলে না।
কথাবার্তা এখনই শেষ হয়ে যাবে, এমন সময়...
‘আচ্ছা শোন্!’
‘কী!’
নাহ্, যে কথাটি বলতে চাই পেটের ভেতর সেটা প্রচণ্ড মোচড় দিচ্ছে, কিন্তু মুখ ফুটে তা বের হয় না; বলি অন্য কথা...
‘তোর ছেলেমেয়ে ক’জন?’
‘মেয়ে নাই। দুই ছেলে। তোর?’
‘ছেলে নাই। দুই মেয়ে। তোর জামাই কী করে?’
‘বেকার। তোর বউ নাকি খুব সুন্দরী?’
‘খুউব। খুউব। কিন্তু শোন্...’
‘কী?’
তৃণাকে বলতে পারি না- আমি তোকে চাই, এখনই। আমি এখন তীব্র কঠিন ও মজবুত; আমি তোকে ভেঙেচুরে গুঁড়ো গুঁড়ো করবো।
‘ছিঃ, তোর না বউ আছে! এতো সুন্দরী বউ!’
‘গোল্লায় যাক, শুধু একটা দিনের জন্য ভুলে যেতে চাই আমার আর কেউ নেই তুই ছাড়া।’
১০ সেকেন্ডের স্বপ্নের ভেতর তীব্র বাসনায় আমি শাণিত হতে থাকি। ঘুম ভাঙলে সারাক্ষণ ঐ কথাটাই পবনে পবনে ভাসতে থাকে।
‘ঠিক আছে, একবারের বেশি না। আর চিরতাকে বলবি না কিন্তু।’ শেষাবধি তৃণা যেদিন এ কথাটি বললো, চিরতার বাসাতেই হিরোশিমার বিস্ফোরণ ঘটানোর জন্য একচিলতে পারমাণবিক বোমা সঙ্গে নিয়ে ছুটতে থাকলাম।
অবিরাম কড়া নেড়েই যাচ্ছি। নাহ্, কড়া নয়, কলিংবেল টিপছি। চিরতার দরজায় দাঁড়িয়ে। এ বাসায় এর আগে কতো এসেছি! চিরতা আমাকে কোনোদিন প্রেম সাধে নি; নির্জন ঘরে যখন ওর ডানায় ডানায় ঘষাঘষি করে কবিতা পড়েছি, মাঝে মাঝে ওর স্তন জুড়ে কিছু লালচে দাগসহ বৃন্ত দেখতে পেতাম- আমার খুব ইচ্ছে হতো, আর ও শুধু কবিতাই বুঝতো; আজ এ বাসায় একটি অনুপম সঙ্গম রচিত হবে। মাত্র একবার। আজ আমি সব ভুলে যাবো- আমার সুন্দরীতমা বউয়ের মুখ আর তার প্রেমামৃতির স্বাদ; আজ সংসারের কথা মনে রাখলে সঙ্গমের স্বাদই ভুলে যাবো।
কতোক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি কে জানে! আমি শুধু একমনে বেল টিপেই যাচ্ছি।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে নভেম্বর, ২০১২ সকাল ১০:১২