আজ বৃহস্পতিবার, অর্ধছুটির দিন। দুটোর মধ্যে অফিস ছুটি করে হান্নান মিয়া বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিয়েছিল। আর তখনই হালিম সাহেব তাকে ধরে বসলেন, ‘আজ আমার বাসায় আপনাকে লাঞ্চ করে যেতে হবে।’
হান্নান মিয়াকে হালিম সাহেবের বাসায় যেতে হচ্ছে। বলতে গেলে হালিম সাহেব এক প্রকার জোর করেই তাকে তাঁর বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছেন।
হালিম সাহেব একজন উচ্চমান সহকারি, অর্থাৎ একজন উচ্চ গ্রেডের করণিক। হান্নান মিয়া হালিম সাহেবের অধস্তন একজন নিম্নমান সহকারি, অর্থাৎ নিম্ন গ্রেডের অফিস করণিক। তাঁরা দুজন এক অফিসে বসেন। হান্নান মিয়া অত্যন্ত ভদ্র, কর্মঠ ও বিশ্বস্ত করণিক। সে কখনো কাজে ফাঁকি দেয় না, ফলে অফিসে সবার মুখে মুখে তার প্রশংসা। তার মতো একজন করণিককে অধস্তন হিসাবে পেয়ে হালিম সাহেবও বেশ নিশ্চিন্ত ও নিরুপদ্রূপ, এবং গর্বিতও। কারণ হান্নান মিয়ার জন্যই তিনি সকল কাজ সময় মত বড় সাহেবের নিকট উপস্থাপন করতে সক্ষম হোন; এতে তাঁর পারদর্শিতা ও দক্ষতা প্রমাণিত হয়।
একত্রে একই অফিসে পাশাপাশি বসে কাজ করতে করতে তাঁদের মধ্যে খুব হৃদ্যতা গড়ে উঠেছে। হালিম সাহেব মাঝে মধ্যেই হান্নান মিয়াকে তাঁর বাসায় চা-নাস্তা খাওয়াতে নিয়ে আসেন; কখনো সখনো বিভিন্ন উৎসব-উপলক্ষে দাওয়াতও করে থাকেন। হালিম সাহেবের বাসায় গল্প-গুজবে বহুদিন অনেক মধুর সময় কাটিয়েছে হান্নান মিয়া।
আজকাল হালিম সাহেব তাকে বাসায় যাওয়ার কথা বললেই হান্নান মিয়ার চোখে বড্ড লজ্জা জেগে ওঠে। কেউ যদি তাকে দশদিন খাওয়ায় তার উচিৎ অন্তত একদিন খাওয়ানো। হান্নান মিয়ার বহুদিনের ইচ্ছে হালিম সাহেবকে তার বাসায় দাওয়াত করে একবেলা খাওয়ায়, কিন্তু অদ্যাবধি তা সম্ভব হয়ে ওঠে নি।
আজকে হান্নান মিয়ার বাসায় ফেরার একটু তাড়া ছিল। সেটি তেমন আর কিছু না, আগামী পরশু তার ছেলের পরীক্ষা শুরু, বাসায় ফিরে ছেলেটাকে পড়াবে বলেই সে একটু তড়িঘড়ি করে ফেরার আয়োজন করছিল। আর তখনই হালিম সাহেব তাকে ধরে বসলেন, আজকে তাঁর বাসায় যেতেই হবে।
হালিম সাহেবের বাসায় আজ ছোটোখাটো একটা উৎসবের মত হবে। সেটিও অবশ্য বড় কিছু নয়। তাঁর মেয়ে-জামাই বহুদিন পর বেড়াতে এসেছে। জামাইয়ের আবার ইলিশ পোলাওয়ের প্রতি দারুণ লোভ। যতবার বেড়াতে আসে ততবারই সে ইলিশ পোলাও খাবে। তার শাশুড়ির মত নাকি অন্য কেউ এত চমৎকার ইলিশ পোলাও রান্না করতে পারে না। রান্নার সময় থেকে সে শাশুড়ির সাথে রান্নাঘরে এটা-সেটা এগিয়ে দিতে থাকে, নুন চাখে, ঝাল চাখে।
জামাইটি কিশোরগঞ্জে থাকে। কিশোরগঞ্জে পদ্মার ইলিশ পাওয়া যায় না। সে নিজেই গতকাল কাওরান বাজার থেকে বিশাল আকারের একজোড়া ইলিশ মাছ কিনে এনেছে। এত বড় ইলিশ পদ্মার ইলিশ না হয়ে যায় না। মাছ কেটে গামলা ভর্তি করে যখন হালিম সাহেবের স্ত্রী সাবেরা বেগম তাঁকে মাছ দেখিয়েছিলেন, হালিম সাহেবের তখন জিহ্বার মাথায় পানি এসে গিয়েছিল।
বাড়িতে ইলিশ পোলাও রান্না হবে আর হালিম সাহেব তাঁর সহকর্মীকে দাওয়াত করে খাওয়াবেন না তা হতে পারে না। তাঁরা দুজন এক কক্ষে পাশাপাশি বসেন। তাঁদের মধ্যে কত কথা হয়, ব্যক্তিগত কথা; পরিবার নিয়ে, সংসার নিয়ে কথা। হান্নান মিয়া তাঁর অধস্তন করণিক হলেও তাঁদের সম্পর্ক এমন পর্যায়ে যে তাঁরা সর্বদা পরস্পরের প্রতি অবিচ্ছেদ্য বন্ধুত্বের টান অনুভব করেন। এমন বন্ধু মানুষকে ফেলে হালিম সাহেবের পেটে ইলিশ পোলাও ঢুকবে না।
হান্নান মিয়ার জন্য তাঁর বড় মায়া হয়। বেচারা বড় ছা-পোষা। সামান্য বেতনের কেরানি, এ দিয়েই তার বড় মেয়ের কলেজ, মেজ মেয়ের স্কুলখরচ চালাতে হয়। ছোটোটি ছেলে, প্রাইমারি স্কুলে পড়ে বলে খুব একটা খরচ পড়ে না। হালিম সাহেবের বেতন হান্নান মিয়ার চেয়ে খুব একটা বেশি না হলেও তাঁর সংসারে টানাটানি তেমন একটা নেই বললেই চলে। বেতনের টাকায় তাঁকে চাল কিনতে হয় না। দেশের বাড়িতে তাঁর যে পৈত্রিক জমিজমা আছে তা থেকে প্রাপ্ত ধানেই বছরের খাওয়াখরচ চলে যায়।
আজ সকাল থেকেই আকাশ মেঘলা ছিল। মেঘলা দিনে খিচুড়ির চেয়ে উপযুক্ত কোনো খাবার হয় না। খিচুড়ি এবং ইলিশ পোলাও সমগোত্রীয়, তবে ইলিশ পোলাওয়ের মর্যাদা খুব ওপরে। কারণ ইলিশ পোলাও ইলিশ মাছ দিয়ে রাঁধতে হয়। ইলিশ মাছ হলো মাছের রাজা।
পথ চলতে চলতে হালিম সাহেব আল্লাহকে খুব ধন্যবাদ জানালেন। কারণ আজকে ইলিশ পোলাও খাওয়ার আবহাওয়াটা আল্লাহ্ তাঁদের জন্য উপযুক্ত করে দিয়েছেন। আকাশ যদি মেঘলা না হতো কাউকে কি দোষারোপ করা যেত? আল্লাহ্ সর্বদাই তাঁর বান্দাদেরকে ভালো অবস্থায় খাওয়াতে চান।
ঘরে ঢুকতেই ইলিশ পোলাওয়ের মৌ মৌ গন্ধে হান্নান মিয়ার বুক ভরে উঠলো। কেমন নেশা জাগানো একটা গন্ধ, ভুরভুর করে নাকের ভিতর দিয়ে বহুদূর পর্যন্ত ঢুকে যাচ্ছে ।
হান্নান মিয়াকে ছোটো ড্রইং রুমটিতে বসিয়ে হালিম সাহেব ভিতরে গিয়ে স্ত্রীর সাথে ছোটো ছোটো কয়েক শব্দে কথা বলতে থাকলেন, সম্ভবত একজন অতিথি-আগমনের কথাই বলছিলেন।
হান্নান মিয়া পোলাওয়ের গন্ধে ভিতরে ভিতরে মাতাল হয়ে ওঠে। ইলিশ পোলাওয়ের গন্ধ এমন নেশাজাগানো হয়? হান্নান মিয়ার অবশ্য ইলিশ পোলাওয়ের প্রতি তেমন লোভ নেই, অন্যান্য সাধারণ খাবারের মতই এটা তার কাছে একটা অতি সাধারণ খাবার। কিন্তু আজকের গন্ধটা থেকে তার মনে হচ্ছে এটা যেন কোনো এক অতি উপাদেয় বেহেশ্তী খাবার। সে বার বার বিস্মিত হচ্ছে, আবার সে ভাবছে এটা পোলাও না হয়ে অন্য কোনো খাবারও হতে পারে যা সে এর আগে খায় নি বা এর নামও শোনে নি। তার মনে অবশ্য কিঞ্চিৎ সন্দেহের উদ্রেকও হলো, হালিম সাহেব ইলিশ পোলাওয়ের কথা বলেছিলেন তো, নাকি অন্য কোনো খাবারের নাম উচ্চারণ করেছিলেন? পরে তার মনে হলো, না, হালিম সাহেব স্পষ্টত ইলিশ মাছের কথাই বলেছিলেন; বলেছিলেন যে তাঁর জামাই ইলিশ পোলাও খাওয়ার জন্য গতকাল কাওরান বাজার থেকে ইলিশ কিনে এনেছে।
সাবেরা ভাবী এসে সহাস্যে দরজায় দাঁড়ালেন। দরাজ গলায় বলে উঠলেন, ‘কী সৌভাগ্য আমার। খুব খুশি হয়েছি। আসেন, খাওয়ার টেবিলে এসে বসেন।’
হান্নান মিয়া খানিকটা লজ্জিত আর সংকুচিত ভাবে ডাইনিং টেবিলে এসে হালিম সাহেবের ডানের চেয়ারটাতে বসলো।
হান্নান মিয়ার যেন ঘোর লেগে গেলো। তার বাসায় কদাচিৎ ইলিশ পোলাও রান্না হয় বটে, কিন্তু এত ঘ্রাণ সে কখনো পায় নি। সত্যি বলতে কী ইলিশ পোলাওয়ের মধ্যে যে বিশেষ একটা স্বাদ ও আকর্ষণ আছে তা হান্নান মিয়া আগে জানতো না। তাই এর প্রতি তার তেমন কোনো লোভও ছিল না। হতে পারে তার বাড়িতে যে পোলাও রান্না হতো তা কখনো পদ্মার ইলিশ দিয়ে রান্না হতো না, কারণ পদ্মার ইলিশ কেনার সামর্থ তার কখনো তেমন একটা ছিল না। অবশ্য আরো একটা কারণ থাকতে পারে, তা হলো তার স্ত্রী মরিয়ম হয়তো ঠিক মত ইলিশ পোলাও রান্না করতে পারে না। কিন্তু তা হয় কী করে? মরিয়মের মত পাকা রাঁধুনি সে আজ পর্যন্ত কাউকে দেখে নি। তবে একটা কথা স্বীকার করতেই হবে, সাবেরা ভাবীও দারুণ রাঁধুনি। তা না হলে কি ঘ্রাণে ঘর ভরে যেত? অবশ্য খাওয়ার পরই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছা সম্ভব হবে, শুধু কি ঘ্রাণ, নাকি এর স্বাদটাও অভিনব!
হালিম সাহেব আর হান্নান মিয়া বসে গল্প করছেন, এমন সময় টেবিলের ওপর গামলা ভর্তি পোলাও এনে রাখলেন সাবেরা ভাবী। গামলার ওপর থেকে ঢাকনা খুলতেই একরাশ ধোঁয়া উড়ে এসে নাকে লাগলো। হান্নান মিয়া ভিতরে ভিতরে উন্মাদ বনে গেলো। মুহূর্তের জন্য তার লালায়িত চোখ গামলায় গিয়ে স্থির হয়, মুহূর্তেই লজ্জা পেয়ে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে গল্পে মনোযোগী হয়।
সাবেরা ভাবী খুব যত্ন করে বেড়ে দুজনকে খাওয়াতে লাগলেন। এমন মজাদার খাবার আর হয় না, এর স্বাদটা সত্যিই একেবারে অভিনব। হান্নান মিয়ার ইচ্ছে করতে লাগলো সে গোগ্রাসে গিলে খায়। কিন্তু পারছে না। এ বাসায় সে মেহমান। অপরের বাসায় যথাযথ ভদ্রভাবে খেতে হয়। নিজের বাসায় শুয়ে শুয়ে, হেঁটে হেঁটে খাওয়া যায়, দুহাতে চেটকে নাকেমুখে মাখিয়ে খেলেও বাইরের কেউ দেখার নেই, কিছু বলারও নেই। সেটা যদিও ভদ্রভাবে খাওয়া নয়, কিন্তু বড্ড আরামের সহিত খাওয়া হয়।
হান্নান মিয়া ভদ্রভাবে খাচ্ছে আর ভাবছে ভাবীজান খুব পাকা রাঁধুনি। নইলে কি পোলাও এত সুস্বাদু হয়? হান্নান মিয়া ভাবলো সে জীবনে এর চেয়ে ভালো কোনো খাবারই খায় নি।
পোলাওয়ের সবচাইতে মজাদার জিনিশটা হলো মাছ। ইলিশ মাছ। হান্নান মিয়ার কাছে মনে হলো এরূপ পদ্মার ইলিশ সে বহু বছর আগে খেয়েছিল। তার বাড়ি পদ্মার কূল ঘেঁষে, নারিশা গ্রামে। জেলেরা সারারাত পদ্মায় মাছ ধরে সকালে তীরে এসে মাছ বিক্রি করতো। হান্নান মিয়ার বাবা মাঝে মাঝে ওখান থেকে ইলিশ মাছ কিনতেন। বড় বড় ইলিশ মাছ ধরতো জেলেরা! হান্নান মিয়ার বাবা কোনোদিন বড় ইলিশ কিনতে পেতেন না। তার বাবার তেমন সামর্থ ছিল না।
আজ বহুদিন পর হান্নান মিয়া পদ্মার ইলিশ খাচ্ছে। আজকাল পদ্মার ইলিশ পাওয়া খুব ভাগ্যের ব্যাপার। মাছ কিনতে গেলে সব বিক্রেতাই বলে তার ইলিশ পদ্মার ইলিশ। আসলে মাছ খাওয়ার পরই বোঝা যায় ওটা পদ্মার, নাকি বার্মার।
খুব মজা করে খাচ্ছে হান্নান মিয়া। ভাবী তাকে বড় এক টুকরো গাদার মাছ দিয়েছেন। গাদার মাছ হান্নান মিয়ার খুব পছন্দ। তার মা তাকে সর্বদা গাদার মাছটা দিতেন।
পাতের অর্ধেক পোলাও শেষ হতেই হান্নান মিয়ার পাতের মাছটা শেষ হয়ে গেল। সে মাথা নিচু করে খাচ্ছিল, এমন সময় ভাবী আরেক টুকরো মাছ তার পাতে তুলে দিল। হান্নান মিয়া বাম হাত বাড়িয়ে ঠেকানোর চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তার আগেই পাতে মাছ পড়ে যায়। কী আশ্চর্য, এবারের মাছটাও পিঠের গাদার মাছ, একেবারে আলিশান সাইজের টুকরো। সে ভেবে পাচ্ছে না যে ভাবীজান কেন তাকে এত বড় গাদার মাছ দিচ্ছেন। আসলে নারী মাত্রই মায়ের জাত, তাঁরা যখন কাউকে খাওয়ান একেবারে নিজের সন্তানের মত আদর করে খাওয়ান। ভাবীজানের প্রতি শ্রদ্ধায় তার চোখে পানি চলে আসার উপক্রম হয়; অনেক কষ্টে এবং কৌশলে সে পরিস্থিতি আয়ত্তে রাখে।
হান্নান মিয়া খুব লজ্জা পেলো। কারণ, তার দ্বিতীয় মাছটাও শেষ, এটা ভাবীর নজরে এলেই তিনি হয়তো আরেক টুকরো মাছ তার পাতে তুলে দেবেন, এটা ভাবীর জন্য সাধারণ ভদ্রতা। তাতে তাঁদের কারো না কারো ভাগ থেকে একটা কিংবা দুটা মাছ কম পড়ে যাবে। সে মনে মনে আল্লাহকে বলতে লাগলো, আল্লাহ্, তুমি এমন একটা লজ্জাকর পরিস্থিতি সামলে ওঠার পথ দেখাও।
হালিম সাহেবের বড় মেয়ে তার মাকে ডেকে উঠলে ভাবী ওদিকে চলে গেলেন। মেয়েজামাই বেডরুমে খাচ্ছে আর টিভিতে সিনেমা দেখছে। জামাইর ছোটোবোন আর ভাগ্নেও তাদের সাথে মেঝেতে পাটি বিছিয়ে একত্রে খেতে বসেছে। হান্নান মিয়া না থাকলে হয়তো বাসার সবাই এই ছোট ডাইনিং টেবিলে বসেই খেত। সে এসে পড়ায় তারা আলাদা ঘরে আলাদা ভাবে খাচ্ছে। এর অবশ্য আলাদা মজা আছে, সব পরিবারের ছেলেমেয়েরাই এমনটি করে থাকে। তাঁদের ছেলেটির অবশ্য কোনো নির্দিষ্ট স্থান নেই। সে প্লেট হাতে কখনো দাঁড়িয়ে, কখনো বোন-দুলাভাইদের সাথে বেডরুমে, কখনো বা ড্রইং রুমে গিয়ে হেঁটে হেঁটে খাচ্ছে। আবার নিজের ইচ্ছেমত কখনো গামলা থেকে, কখনো বা রান্নাঘরে গিয়ে নিজের হাতে বেড়ে খাচ্ছে। তবে হান্নান মিয়া লক্ষ করলো, পোলাওয়ের চেয়ে মাছই সে বেশি সাবাড় করে দিচ্ছে।
পাতের পোলাও প্রায় শেষের পথে। হান্নান মিয়া মনে মনে দারুণ লজ্জিত হলো। মাছ খেয়ে তার তৃপ্তি মেটে নি। আসলে এমন মাছ খেয়ে কারো কখনো তৃপ্তি মিটতে পারে না। তার মনের কোনে অতি ছোট্ট একটা আশার সঞ্চার হওয়া মাত্রই সে লজ্জাটা পেয়ে বসেছে। সে শতভাগ নিশ্চিত, ভাবীজান যদি সত্যি সত্যি তাকে আরেক টুকরো মাছ তুলে দিতেন, তবু সে সেই মাছটি পাতে না নিয়ে জোর করে হলেও ফিরিয়ে দিত। তার পরেও তার মনের গহীন কোণে অতি ক্ষীণ একটি আশা সূক্ষ্ম বেদনার মত ভেসে রইল, ভাবীজান যদি আরেক টুকরো মাছ পাতে বেড়ে দিতেন!
যা হোক, মনের মধ্যে আরেক টুকরো মাছের জন্য সামান্য অতৃপ্তি নিয়েই খুব তৃপ্তি সহকারে হান্নান মিয়া পোলাও খেলো।
বাড়িতে এসে স্ত্রী মরিয়মকে ইলিশ পোলাও খাওয়ার কথা খুব গর্বের সাথে জানালো হান্নান মিয়া। তার ইচ্ছে অতি শীঘ্রই বাড়িতে ইলিশ পোলাও রান্না হয়। সে আজ যে অপূর্ব পোলাও খেয়ে এসেছে, তার ছেলেমেয়েরা কোনোদিন তা স্বপ্নেও চেখে দেখে নি। ওদেরকে অমন ইলিশ পোলাও না খাওয়াতে পারলে পৃথিবীর একটা অমৃত খাবার থেকে ওরা সারাজীবন বঞ্চিত থাকবে। বাবা হয়ে এমন একটা খাবার খাওয়ানো তার পবিত্র কর্তব্য। স্ত্রী মরিয়মও কি কোনোদিন তা খেয়ে দেখেছে? যদিও সে ইলিশ পোলাও রাঁধতে পারে, কিন্তু সেও বোধ হয় এমন জিনিশ ইহজীবনে খেয়ে দেখে নি। স্বামী হয়ে স্ত্রীকে ভালোমন্দ খাওয়ানো খুব ছওয়াবের কাজ।
সব শুনে মরিয়ম বললো, ইলিশ পোলাও রান্না করাটা এমন কোনো কঠিন কাজ না। কঠিন কাজ হলো খাঁটি ইলিশ মাছ পাওয়া।
মরিয়ম ঠিকই বলেছে। কিন্তু খাঁটি ইলিশ কীভাবে, কোথায় পাই? হান্নান মিয়া ভাবনায় পড়ে যায়। বাজার থেকে মাঝে মধ্যে যেসব ইলিশ কেনা হয় তা নিতান্তই ছোটো সাইজের মাছ, রান্নার পর মাছের নাম বলে না দিলে স্বাদ থেকে বলার সাধ্যই নেই যে এটা ইলিশ মাছ। তবে বড় মাছগুলো খুবই দামি, দাম থেকেই বোঝা যায় ওগুলো পদ্মার ইলিশ। কিন্তু হান্নান মিয়ার পদ্মার ইলিশ কেনার সামর্থ নেই।
হান্নান মিয়া অবশ্য একটা ব্যবস্থা করে ফেললো। আসলে ইচ্ছে থাকলেই উপায় হয়। কিছু কম-প্রয়োজনীয় এবং কিছু অপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী বাদ দিয়ে সে টাকা বাঁচালো। এবং তাতে এক কেজি ওজনের একটা ইলিশ মাছ কেনার ব্যবস্থা হয়ে গেলো।
আজ ছুটির দিন। হান্নান মিয়ার বাড়িতে দুপুরে ইলিশ পোলাও রান্না হচ্ছে। বউ রান্না করছে। হান্নান মিয়া ঘন ঘন কিচেনে গিয়ে দেখাশোনা করছে। গন্ধে মৌ মৌ করছে সারা ঘর। তার তিন ছেলেমেয়েও রান্নাঘরের চারপাশে ঘুরঘুর করছে।
হান্নান মিয়া বেশ খুশি, কারণ মাছটা যে প্রকৃতই পদ্মার ইলিশ তা গন্ধ থেকেই বোঝা যাচ্ছে। এত দাম দিয়ে কেনা মাছ কি যেনতেন মাছ হয়? পদ্মার ইলিশের মাহাত্ম্যই আলাদা।
হান্নান মিয়ার ইচ্ছে হয়েছিল হালিম সাহেবকে নিমন্ত্রণ করে। কিন্তু তার ঘরদোরের অবস্থা ভালো নেই। এ অবস্থায় কাউকে দাওয়াত করলে হান্নান মিয়া নিজে যেমন লজ্জা পাবে, নিমন্ত্রিত ব্যক্তিও আরো বেশি লজ্জা পাবেন।
ছেলেমেয়েদের নিয়ে পরম তৃপ্তির সাথে হান্নান মিয়া ইলিশ পোলাও খাচ্ছে। তাদের সাথে আরো দুজন মেহমান আছে। একজন মেজ মেয়ের বান্ধবী লায়লা, আরেকজন ছেলের বন্ধু রিপন। ওদের কাছে ইলিশ পোলাও খাওয়ার উৎসবটা অত্যন্ত আনন্দদায়ক ও উপভোগ্য, তাই বন্ধু-বান্ধবীদেরকে নিয়ে একসাথে আনন্দ করে ওরা পোলাও খাচ্ছে। লায়লা মেয়েটি খুব মায়াবী ও লক্ষ্মী, হান্নান মিয়াকে সে কাকু বলে ডাকে। আজকালকার স্টাইল অনুযায়ী আংকেল ডাকার কথা, কিন্তু সে কাকু ডাকে। মনে হয় এই মেয়েটিও তার নিজের মেয়ে। হান্নান মিয়ার দুঃখ তার বাসায় হালিম সাহেবের বাসার মত আলাদা বেডরুম বা টেলিভিশন নেই, থাকলে ছেলেমেয়েরা মেহমানদেরকে নিয়ে আলাদা রুমে বসে খেতে খেতে টেলিভিশনে সিনেমা দেখতে পারতো।
রিপন ছেলেটি তার ছেলে হোসেনের মতই চঞ্চল। চঞ্চল ছেলেটি এটাকে নিজের বাড়ির মত মনে করছে এবং হোসেনের সাথে পাল্লা দিয়ে খুব দাপাদাপি করে খাচ্ছে।
মরিয়ম হান্নান মিয়াকে যথারীতি গাদার মাছটি দিয়েছে। সে অবশ্য জানে যে গাদাই তার প্রিয় মাছ। মাছ মুখে দিয়ে হান্নান মিয়া নিশ্চিত হতে পেরেছে সে ঠিক ঠিক পদ্মার ইলিশই কিনতে পেরেছিল। আসলে ভাগ্য ভালো না হলে কপালে পদ্মার ইলিশ মাছ জোটে না। হান্নান মিয়া ভেবে কূল পায় না আল্লাহ্ পদ্মার ইলিশে এত মজা কেন দিয়েছেন।
হান্নান মিয়া খাচ্ছে আর ফাঁকে ফাঁকে ছেলেমেয়ে ও স্ত্রী এবং আগত মেহমানদ্বয়ের সাথে ইলিশ মাছ সংক্রান্ত দু-চারটে কথা বলছে।
মরিয়মের রান্না হালিম সাহেবের স্ত্রীর রান্নার চেয়েও অধিকতর সুস্বাদু হয়েছে। কারো রান্নাই কম নয়, তারপরও যদি ইলিশ পোলাও রান্নার প্রতিযোগিতা হতো, যেখানে তার স্ত্রী মরিয়ম আর হালিম সাহেবের স্ত্রী সাবেরা বেগম দুই প্রতিযোগিনী, আর বিচারক সে নিজে- তাহলে সে সাবেরা ভাবীকে ১০ এর মধ্যে ১০ দিত এবং মরিয়মকে দিত ১০ এর মধ্যে ১৫ , অতিরিক্ত ৫ নম্বর তার জন্য বোনাস।
হান্নান মিয়ার পাতের মাছটি শেষ হয়ে গেছে। মরিয়ম সবাইকে তদারকি করছে। হান্নান মিয়া জানে তার পাতের দিকে তাকিয়ে থালা খালি দেখলেই মরিয়ম তাকে আরেক টুকরো মাছ তুলে দিবে।
কিন্তু মরিয়ম হান্নান মিয়ার পাতের দিকে তাকাচ্ছে না। নিজের বাড়ি, নিজের স্ত্রী, তবু সে মরিয়মকে মুখ ফুটে বলতে পারছে না, বউ, আরেক টুকরো মাছ দাও তো।
হান্নান মিয়া একবার আড়চোখে গামলার দিকে তাকালো। তাতে এখনো বেশ কয়েক টুকরো মাছ পড়ে আছে, কোলের আর গাদার মাছ মিলিয়ে।
প্রথমে বড় মেয়ে আবদার করলো, ‘মা, আরেক টুকরো মাছ দাও।’ মরিয়ম তাকে আরেক টুকরো মাছ দিল। এরপর মেজ মেয়ে, ছেলে এবং রিপনও আরো মাছের জন্য হাঁক দিল। শুধু নিজের ছেলেমেয়েদের পাতে তো আর মাছ তুলে দেয়া যায় না, মরিয়ম একে একে মেহমান সহ সবার পাতেই মাছ তুলে দিল। শেষমেষ ছেলেটি আবারো বলে উঠলো, ‘মা, আরো মাছ দাও।‘ রিপন খেতে খেতে হাঁপিয়ে উঠেছিল। সেও বললো, ‘আন্টি, আরেক টুকরা মাছ...।’
গামলায় আর মাছ নেই। মরিয়ম রান্নাঘরে চলে গেল। ফিরে এসে হোসেন এবং রিপনের পাতে মাছ তুলে দিতেই ওরা দুজনে বিরক্ত সহকারে গুনগুন করে উঠলো, ‘ভাঙ্গা মাছ কেন?’
মরিয়ম খুব লজ্জা পায়। মেয়ের বান্ধবী হলেও সে তো এ বাসায় মেহমানই। মেহমানদের সামনে এ অবস্থায় লজ্জা পাওয়ারই কথা। সে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে চুপিচুপি বলে, ‘আর মাছ নাই বাবা। ভাঙ্গাটাই খাও। একটা মাছ না? একটা মাছে আর কয় টুকরা মাছ হয়? খাও বাবা, খাও।’
হান্নান মিয়ার মন খারাপ হয়ে গেল। সে নিজে তো তবু এক টুকরো মাছ খেয়েছে, কিন্তু মরিয়ম? হতভাগিনীর ভাগ্যে তা-ও জুটলো না।
হান্নান মিয়া অবশ্য মনে মনে ভাবলো, আরেকদিন ইলিশ পোলাও খেতে হবে। সেবার মাত্র একটিই নয়, যত কষ্টই হোক, দুটি ইলিশ কিনতে হবে, যাতে অন্তত মরিয়মও এক টুকরো খেতে পায়। আর ছোটো ছেলেটা যাতে মাছ খেতে খেতে অভক্ত হয়ে বলে ওঠে, ‘মা, এত মাছ আমার ভালো লাগে না। আমাকে অন্য কিছু দাও।’
** ২০০৪
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই এপ্রিল, ২০১২ সন্ধ্যা ৭:৪৯