পৃথিবীতে প্রায় সাড়ে চার হাজার ধর্ম ও মত রয়েছে।বিদ্যমান কোন একটি ধর্ম বা মতের পরিবারে কেউ জন্মগ্রহণ করে যখন এর বিপরীত চিন্তা করে, এর বিপরীত ধর্ম বা মত গ্রহণ করে, এর বিপরীত পথে চলে তখন তার এ অবস্থা হলো ভিন্ন চিন্তা ভিন্ন ধর্ম ভিন্ন মত ভিন্ন পথ।তার এ বিপরীত অবস্থা সঠিক অথবা বেঠিক হতে পারে।যদিও সে তার বিপরীত অবস্থানকে সঠিক মনে করে তৃপ্তি পায়।
ধর্ম বা মতের ক্ষেত্রে ভিন্ন চিন্তা, এর সংখ্যা বাড়িয়ে দেয়। ভিন্না চিন্তার ফলে মানুষ ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম বা মতের অনুসারী হয়ে ভিন্ন ভিন্ন পথে চলে।এরপর তারা পারস্পরিক সংঘাতে জড়িয়ে পৃথিবী অশান্তিময় করে তোলে।সঠিক ধর্ম বা মত সঠিকভাবে সনাক্ত হয়ে মানুষের মাঝে অভিন্নতা তৈরী হলে মানুষের পারস্পরিক অশান্তির পরিবেশ কমে যেতে পারে।নতুবা পরমত সহিষ্ণুতার মাধ্যমে মানুষের মাঝে শান্তির পরিবেশ তৈরী করতে হয়।
ধর্ম বা মতের ভিতর আবার বিভিন্ন মত রয়েছে।ধর্ম সমূহের ক্ষেত্রে ধর্ম বিরোধীদের মত হলো এগুলো মানুষের বানানো। অনেক ধর্মের লোকেরা নিজেদের ধর্মকে ঐশ্বরিক ধর্ম বলে বিশ্বাস করে কিন্তু ভিন্ন ধর্মকে তারা মানুষের বানানো বা আংশিক বানানো মনে করে।নিজের ধর্ম বা মতকে সঠিক, আর অন্যের ধর্ম বা মতকে বেঠিক মনে করা, বিশ্বাস করা বা বলার প্রবণতা মানুষের মাঝে ব্যাপক হারে বিদ্যমান। অসংখ্য ধর্ম ও মতের পারস্পরিক বাক বিতন্ডা ঝগড়া ঝামেলা যুদ্ধ হানাহানি মারামারিতে অনেক সময় মহা জটিল পরিস্থিতি তৈরী হয়। বিজ্ঞ জনেরা তখন ভাবেন কোন ধর্ম বা মত আসলে সঠিক। ভাবনার ফল হিসেবে তারা আবার বিভিন্ন মত প্রদান করে থাকেন। কিছু মানুষ আবার সে সব মতের অনুসারী হয় অথবা কিছু মানুষ সে সব মতের বিরোধীতা করে। এভাবে ধর্ম ও মতের সংখ্যা আরো বাড়ে। সেই সাথে জটিলতাও বেড়েই চলে।অনেকে আরো গবেষণা করে এবং নিজ মতের সঠিকতার প্রমাণ উপস্থাপনের চেষ্টা করে।
ঈশ্বর যদি না থাকেন তবে ঐশ্বরিক ধর্ম থাকার কথা নয়।অনকে মনে করে ঈশ্বর থাকলেও ঐশ্বরিক ধর্ম থাকার কথা নয়। কারণ ঈশ্বর এমন বড় মহা জগতের চালক হয়ে মানুষকে ধর্ম প্রদানের ভাবনা ভাবার কথা নয়। অথচ মোজেস বা মুসা (আ.), যীশু বা ঈসা (আ.)ও মোহাম্মদ (সা.) মানুষকে ঈশ্বর বা আল্লাহ প্রদত্ত ধর্ম বা জীবন যাপনের নিয়ম শিক্ষা দিয়েছেন।তার মানে তাদের ভাষায় ঈশ্বর বা আল্লাহ আছেন। মোহাম্মদ (সা.) বলেছেন, তিনি আল্লাহর সাথে কাছাকাছি বসে কথা বলেছেন। এ ক্ষেত্রে কাদের কথা সঠিক সে বিষয়ে মানুষের মাঝে ভাবান্তর দেখা দিয়েছে।
খ্রিস্ট ধর্ম পৃথিবীর প্রধান ধর্ম। তাদের মতে ঈশ্বরের স্ত্রী ও পুত্র রয়েছে। ইহুদী ধর্মেও ঈশ্বরের পুত্র রয়েছে। হিন্দু ধর্ম মতেও ভগবানের স্ত্রী পুত্র কন্যা স্বামী পিতা মাতা ইত্যদি সব রয়েছে।আর তাদের ভগবান সংখ্যায় অনেক।অবশ্য তাদের মধ্যে এক ভগবানের বহু রূপের বিশ্বাসও রয়েছে।বোদ্ধ ধর্মেও অনুরূপ মত, তবে তারা শুধু বোদ্ধকে ভগবান বলে।কিন্তু ইসলামে আল্লাহ এক এবং একা। তাঁর স্ত্রী পুত্র কন্যা স্বামী স্ত্রী পিতা মাতা বা অপর কোন আত্মীয় স্বজন কিচ্ছু নেই। এ দিক থেকে ইসলাম রয়েছে একেবারে আলাদা অবস্থানে। কোন কথা আসলে সঠিক তা’ নিশ্চিত হতে বিষয়টা পরখ করে দেখা দরকার।
কিছু ধর্ম বা মতের দৃষ্টিতে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। কিছু ধর্ম মতে মৃত্যুর পরেও জীবন রয়েছে। সে জীবনে ভাল থাকার জন্য তারা বিভিন্ন ভাল কাজ করে। তাদের দৃষ্টিতে এ জীবন ও সে জীবনের মালিক ঈশ্বর ভগবান বা আল্লাহর উপাসনা পুজা বা ইবাদত করে ঈশ্বর ভগবান বা আল্লাহকে সন্তুষ্ট করলে মৃত্যুর পরের জীবনে ভাল থাকা যাবে। বিশ্বাস/অবিশ্বাসের কারণে কেউ এক রকম করে আর অন্যরা অন্য রকম করে। এ ক্ষেত্রে সঠিক বিশ্বাস/অবিশ্বাস নির্ণয় করা দরকার।
অনেকের মতে জন্ম শুধু একবার নয় বরং জন্ম হয় বার বার। এক জন্মের কর্মফল অনেক সময় মানুষ অন্য জন্মে ভোগ করে। কারো মতে স্বর্গ-নরক, জান্নাত-জাহান্নাম নামক স্থানে মৃত্যুর পর মানুষ চিরস্থায়ীভাবে বসবাস করে বা করবে। এমন কোন চিরস্থায়ী স্থানে যদি থাকতেই হয় তবে তাতে ভাল থাকার চেষ্টা করা নিশ্চিতভাবে ভাল কাজ।
ঈশ্বর ভগবান বা আল্লাহ আছে বলে যারা বিশ্বাস করে তাদের কারো মতে ঈশ্বর ভগবান বা আল্লাহর আকার আছে। আর কারো মতে ঈশ্বর ভগবান বা আল্লাহর আকার নেই বরং ঈশ্বর ভগবান বা আল্লাহ নিরাকার।কারো মতে ঈশ্বর ভগবান বা আল্লাহ বিভিন্ন রূপ ধরে পৃথিবীতে আসেন, আর কারো মতে ঈশ্বর ভগবান বা আল্লাহ কোন রূপ ধরে পৃথিবীতে আসেন না বরং ঈশ্বর ভগবান বা আল্লাহ পৃথিবীতে তাঁর প্রতিনিধি প্রেরণ করেন। কারো মতে ঈশ্বর ভগবান বা আল্লাহ এক, আর কারো মতে ঈশ্বর ভগবান বা আল্লাহ অনেক।
কোন কোন ধর্ম আসল না হলেও কোন ধর্মই আসল নয় এটা বলা যায় না, বরং আমরা প্রমাণ করে দেখাব যে ইসলাম অন্তত নকল নয়। ইসলামের সঠিকতার অকাট্য প্রমাণ রয়েছে যা আমরা পর্যায়ক্রমে উপস্থাপন করব।ইসলাম ছাড়াও মানুষ যে সব ধর্ম বা মতের অনুসারী তারা সে সব ধর্ম বা মতের অনুসারী হয়ে উপকৃত হচ্ছে বলে দাবী করছে। সে জন্য নিজ ধর্ম বা মতের পিছনে মানুষ প্রচুর শ্রম ও অর্থ ব্যয় করছে। কিন্তু যুক্তির কথা হলো লাভবান হলেও পরস্পর বিপরীত ধর্ম বা মত এক সঙ্গে সঠিক হতে পারে না।উপকৃত হওয়ার পিছনে হয়ত ভিন্ন কারণ আছে। ভুল উৎসে হাত পেতেও কেউ পাচ্ছে এর কারণ হয়ত প্রকৃত দাতার দয়া।তিনি হয়ত ভুল ক্ষমা করে প্রাপ্তির চেষ্টাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। হতে পারে এ প্রাপ্তিও চিরস্থায়ী নয়।হয়ত এ প্রাপ্তি সাময়িক। কাজেই চাচ্ছি পাচ্ছি বলে তৃপ্তির ঢেকুর না তুলে সঠিক স্থানে হাত পাতা হচ্ছে কি না সেটাও অনুসন্ধান করে দেখা দরকার।
নিজ ধর্মকে সঠিক বললে প্রমাণসহ বলা দরকার। নতুবা অপর পক্ষকে চুপ করিয়ে রাখা যায় না। অপর পক্ষকে চুপ করিয়ে না রাখা গেলেই বাক বিতন্ডা শুরু হয়ে সংঘাতময় পরিস্থিতি তৈরী হয়। কাজেই যিনি যে ধর্ম বা মতের সঠিকতা দাবী করবেন তাঁর উচিৎ হবে সেটা প্রমাণসহকারে দাবী করা।
কেউ বলছেন সৃষ্টিকর্তা নেই। তিনি কোথায় খুঁজেছেন? মহাজগতের সবটা? তা’ না হয় কি করে বুঝলেন সৃষ্টিকর্তা নেই? অল্পস্থানে পাওয়া গেলে আছে বলা গেলেও সবস্থানে না পাওয়া ছাড়া নেই বলা যায় না।এ সহজ কথা না বুঝেই কেউ কেউ সৃষ্টিকর্তা নেই বলে চিৎকার করছে। যে স্থানে আছে সে স্থানে না খুঁজে যে স্থানে নেই সে স্থানে খুঁজে নেই বলা হলেও সেটা হবে অর্থহীন বলা।
ধর্ম বিরোধীতায় ইসলাম বিরোধীরা একটু বেশী অগ্রসর। ইসলামের বিরুদ্ধে ধর্মহীন ও ভিন্নধর্মের ইসলাম বিরোধীদের অভিযোগের অন্ত নেই।তারা ইসলাম কোরআন ও ইসলামের নবি মোহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে অনেক বাজে মন্তব্য করে মুসলমানদেরকে উত্তপ্তকরে তাদেরকে সংঘাতের দিকে ঠেলে দেয়। এরপর তারা উল্টা-পাল্টা কিছু করলে তাদেরকে জঙ্গী-সন্ত্রাসী খেতাব দেয়।ইদানিং এ বিষয়টা সারা বিশ্বজুড়ে প্রতিয়মান হচ্ছে।একটা চক্র গোটা মুসলিম জাতিকে সভ্যতার জন্য হুমকি হিসেবে সাব্যস্ত করছে।এরা মুসলমানদেরকে হেয় প্রতিপন্ন করতে গুহামানব আখ্যা দিয়ে থাকে।অথচ গুহার সাথে বেঠিকতার কোন সম্পর্ক আমি খুঁজে পাচ্ছিনা।
মুসলমানদের দূরবস্থার জন্য তারা নিজেরাও অনেকোংশে দায়ী।হজরত আলী (রা.) ও মুয়াবিয়ার (রা.) সংঘাতে জান্নাত লাভের জন্য হজরত আলীর (রা.) অনুসরনের বিকল্প নেই মর্মে একপক্ষ দাবী উত্থাপন করে। পরবর্তীতে সে পক্ষ তাদের মতের সমর্থনে বিভিন্ন হাদিস উপস্থাপন করে। যা মানতে অন্য পক্ষ অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে। তারা মহানবির (সা.) সব সাহাবায়ে কেরামের (রা.) অনুসরনের পক্ষে মত দেয়। যারা সব সাহাবায়ে কেরোমের (রা.) অনুসরনের পক্ষে মত দেয় তারা সুন্নী ও যারা আলীর (রা.) অনুসারী তারা শীয়া নাম ধারণ করে সংঘাতে লিপ্ত হয়।সব সাহাবার অনুসারীরা হজরত মুয়াবিয়া (রা.) ও হজরত আয়েশারও (রা.) অনুসারী। অথচ শীয়াদের এ দু’জনের অনুসরনে ঘোর আপত্তি রয়েছে বিধায় সুন্নী ও শীয়া পক্ষ কিছুতেই মিলতে পারছে না। এ নিয়ে বহু যুদ্ধ-বিগ্রহ হয়েছে এবং হচ্ছে।মাযহাব-লা মাযহাব, পীর মানা না মানা, মীলাদ করা না করা, মাজারের পক্ষ-বিপক্ষ ইত্যাদি বিষয়েও মুসলামানদের নিজেদের মধ্যে কোন্দলের শেষ নেই। এ সুযোগে ইসলাম বিরোধীরা আস্ত ইসলামকেই বাতিল ঘোষণা করে এর বিলুপ্তি কামনা করছে।
সঠিক ইসলাম বেঠিক হয়ে যাচ্ছে কোন্দলের গ্যাঁড়াকলে। সঠিকের মাঝে বেঠিক ঢুকে সঠিকটাকে বেঠিক করে দিচ্ছে।বেঠিকটাও সঠিক স্বীকৃতি পাচ্ছে সঠিকতা পরখ না করে দেখার কারণে। যেহেতু ইসলামে বিভিন্নতা ঢুকে পড়েছে সেহেতু এ বিভিন্নতার মাঝ হতে সঠিকতা খুঁজে বেরকরা দরকার। অনেক সময় দেখা যায় বিকল্প হিসেবে বিভিন্নতাও সঠিক থাকে।তারমানে বিভিন্নতার মাঝেও অভিন্নতা থাকতে পারে।তবে এক্কেবারে বিপরীত হলে অভিন্ন করার সুযোগ থাকে না।
ইসলাম নিয়ে আমার মাথা ঘামানোর দরকার পড়েছে, কারণ আমি ইসলামের অনুসারী। ইসলামের বিবিধ বিরোধীতায় আমাকে ভাবতে হয়েছে, আমি ইসলামে থেকে যাব না ছেড়ে যাব? অবশেষে দেখলাম ইসলাম আসলে সঠিক।লোকদের বোধগত ত্রুটির কারণে ইসলামে কিছু অপব্যখ্যার বিষয় যুক্ত হয়েছে।আর কারো অপব্যাখ্যার দায় মূলত ইসলামের নয়।কাজেই আমার ইসলাম ছেড়ে যাওয়ার দরকার নেই। বরং অন্যদেরকে ইসলামে আসার দাওয়াত দেওয়া দরকার।
জন্মসূত্রে সঠিক পথে থাকাকে অনেকে সৌভাগ্য বলছে। এদের সৌভাগ্য রোধ করার জন্য সঠিক পথে যারা আছে তাদের সন্তান জন্ম বন্ধ থাকা জরুরী কি? আর হয়ত কারো সঠিক পথের পথিকের সন্তান হওয়ার পিছনে যথাযথ কারণ রয়েছে, যা বিধাতা জানেন।এখন কারো সৌভাগ্যের জন্য অন্যেরা কি সৌভাগ্য অনুসন্ধানে বিরত থাকবে? মানুষের চিন্তা যে কত বিচিত্র ভাবলে অবাক হতে হয়।
ধর্ম বা মত থাকলেই সেটা সঠিক হতে হবে সেটা কোন জরুরী বিষয় নয়।জন্মসূত্রে আমি যে ধর্ম বা মতের অনুসারী সে ধর্ম বা মত সঠিক নাও হতে পারে, আবার সঠিক হতেও পারে।।অনুরূপ ভিন্ন ধর্ম ভিন্ন মত ভিন্ন পথেও সঠিকতা থাকতে পারে, আবার বেঠিকতাও থাকতে পারে। সেজন্য জরুরী বিষয় হলো সঠিক পথ খুঁজে বের করে সঠিক পথে চলতে হবে। আর আগে থেকেই সঠিক পথে থেকে থাকলে সঠিক পথে চলা অব্যাহত রাখতে হবে।আর বুদ্ধিমান মাত্রই বিপদ থেকে বাঁচার চেষ্টা করবে। বেকুবের মত বিপদে ঝাঁপদিয়ে এতে হাবুডুবু খেতে থাকা মোটেও সঠিক হতে পারে না। এজন্য অসংখ্য ধর্ম বা মত বিদ্যমান থাকলেও সুবোধ মানুষের কাজ সঠিকতার সন্ধান করা এবং সঠিক পথে চলার চেষ্টা করা।কারণ সঠিক পথেই শান্তি ও সঠিক পথেই বিপদ থেকে মুক্তি।
বিঃদ্রঃ ‘ইসলামের সঠিকতার অকাট্য প্রমাণ’ গ্রন্থের একটি অধ্যায় হিসেবে লেখাটি লেখা হয়েছে।
প্রাথমিক কথা
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই জানুয়ারি, ২০১৯ সকাল ১০:১৫