আমাকে যদি কেউ প্রশ্ন করে, 'জীবনে পড়া শ্রেষ্ঠ উপন্যাস কোনটি?'
উত্তরটা দিতে বেশ কষ্ট হবে। এক কথায় এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়াটা অসম্ভব কঠিন একটি ব্যাপার।
প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে আমার মনে অনেকগুলো উপন্যাসের নাম চলে আসবে। সেই নামের তালিকাটাও মোটামোটি দীর্ঘ। সেই দীর্ঘ তালিকার প্রথমদিকে একটি নাম থাকবে। সেই নামটি হলো 'দূরবীন'।
'দূরবীন' পড়া শুরু করার আগে ভারী মলাটের বইটা নিয়ে বেশ কয়েকবার নাড়াচাড়া করেছিলাম। এতো বড় একটি বই পড়ব কিনা সেটা নিয়ে খুব দ্বিধায় ছিলাম। সেটা অনেক আগের কথা। তখন চাইলেই এতো সহজে অনলাইন থেকে রিভিউ পাওয়া যেতো না।
দ্বিধা নিয়েই বইটা পড়া শুরু করলাম। তারপর আমাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
বইটা পড়ে শেষ করার পর আমার মধ্যে অন্যরকম ভালো লাগার এক অভিব্যাক্তি সৃষ্টি হয়েছিল। মনের একটা অংশ আমাকে প্রশ্ন করছিল, 'বইটা আগে কেন পড়লাম না?' মনের আরেকটা অংশ বলছিল 'এতো সুন্দর একটা উপন্যাস পড়ে শেষ করে ফেললাম! এখন কি পড়ব? উপন্যাসটা তো শেষ হয়ে গেলো।'
একজন পাঠককে পরিপূর্ণভাবে তৃপ্ত করার মতো বই খুব কম আছে। এই বইটা পড়ে আমি পরিপূর্ণ তৃপ্তি পেয়েছিলাম। বইটা পড়ার আগে 'দুরবীন' শব্দটি আমাকে প্রভাবিত করত না। আর পড়ার পর 'দূরবীন' শব্দটি আমার ভিতরে অদ্ভূদ এক অনুভূতি সৃষ্টি করে।
শীর্ষেন্দু মুখপাধ্যায়ের অদ্ভূতুড়ে সিরিজের বইগুলো আগেই পড়েছিলাম। তার লেখার ভক্ত ছিলাম আগে থেকেই। তবে 'দূরবীন' পড়ার মাধ্যমে লেখককে অন্যরকমভাবে চিনেছি। তার স্থানটা আরো অনেক উপরে চলে গিয়েছে। 'দূরবীন' শীর্ষেন্দু মুখপাধ্যায়কে অনন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে।
সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকায় দু-বছরেরও বেশি সময় ধরে ধারাবাহিকভাবে বেরিয়েছিল ‘দূরবীন' উপন্যাসটি। এটি টানা দুই বছর দেশ পত্রিকায় পাঠক চাহিদার শীর্ষে ছিল।
'দূরবীন' একসূত্রে গাঁধা তিন প্রজন্মের গল্প। গল্পগুলোকে প্রথমে বিচ্ছিন্ন মনে হলেও শেষ পর্যন্ত গল্পগুলো একটি বিন্দুতে গিয়েই মিলিত হয়েছে। অনেক বেশি সবালীল বর্ণনা ও গল্পের গতি পাঠককে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আচ্ছন্ন করে রাখবে। ভালোবাসার মনস্তাত্মিক দিকগুলো অতি সূক্ষ্মভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
দুরবীন উপন্যাসের তিন প্রজন্মের তিন পুরুষ হেমকান্ত, কৃষ্ণকান্ত ও ধ্রুব। যেহেতু এটা তিন প্রজন্মের গল্প, তাই এটি তিনটি সময়েরও গল্প। ভারতবর্ষের রাজনৈতিক অনেক বিষয়য়াবলি স্বাভাবিকভাবেই উঠে এসেছে গল্পের বিভিন্ন অংশে।
রাগ, প্রেম, বৈরাগ্য মিলিয়ে ধ্রুব-রেমির অদ্ভূদ সম্পর্ক পাঠককে চুম্বকের মতো আকর্ষন করবে। এই ব্যাপারটাকে লিখে প্রকাশ করে বুঝানো প্রায় অসম্ভব একটি কাজ। ভালোবাসার অন্যরকম কিছু দিক রয়েছে এখানে। ভালোবসা এতো সুন্দর হয় সেটা খুব জটিলভাবেই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ধ্রুব-রেমির গল্প উপন্যাসের সবচেয়ে আকর্ষনীয় বিষয়।
শুরুর মতো উপন্যাসের শেষটাও অসাধারন। পাঠক পরিপূর্ণভাবে তৃপ্ত হবে সমাপ্তিতে এসে। তারপর গল্পটা শেষ হবার পরেও মাথাটা গল্পের ভিতর থেকে বের হয়ে আসতে চাইবে না। পাঠকের মনকে প্রভাবিত করার অদ্ভূদ এক ক্ষমতা রয়েছে এই উপন্যাসটির।
কেউ কেউ দ্বিতীয়বার পড়বে, তৃতীয়বার পড়বে, চতুর্থবার পড়বে। কিছুদিন পর পর নির্মল অবসরে আবার পড়তে ইচ্ছে হবে। 'দূরবীন' পড়ার পর এটি পাঠকের একান্ত প্রিয় একটি উপন্যাসে পরিনত হবে।
শুধু তিন প্রজন্মের তিন পুরুষের ব্যক্তিগত কাহিনীর জন্যই নয়, এ-উপন্যাসের বিশাল প্রেক্ষাপট আর ঘটনার বিচিত্র ও আকর্ষনীয় শাখা এবং এর প্রেক্ষাপটে স্বদেশী আন্দোলন, দেশভাগ ও স্বাধীনতা পরবর্তী উত্তাল সময়ের এক তাৎপর্যময় উপস্থাপনার জন্যও ‘দূরবীন’ চিহ্নিত হবে অবিস্মরণীয় সৃষ্টিরূপে।
'দূরবীন' সম্পর্কে যতো বেশিই বলা হোক না কেন, তাও খুব কম হয়ে যাবে। 'দুরবীন' উপন্যাসটিকে উপস্থাপন করার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো পুরো 'দূরবীন' উপন্যাসটি উপস্থাপন করা। অন্য কোনো পদ্ধতিতে এই উপন্যাসটিকে কখনোই পরিপূর্ণভাবে উপস্থাপন করা সম্ভব না।
শীর্ষেন্দু মুখপাধ্যায়ের অনবদ্য এক সৃষ্টি, বাংলা সাহিত্যের অমূল্য এক সম্পদ, পাঠক নন্দিন 'দূরবীন' উপন্যাসটি প্রতিটি পাঠকের পড়া উচিত।