অযত্ন অবহেলায় পুরাতন শেলফে পরে থাকা বইটি পড়ার জন্য কখনোই আগ্রহ অনুভব করিনি। কভার পেইজ খুব একটা আকর্ষণীয় না। অভ্যাসের বশে বইটি খুলে নাড়াচাড়া করেছি বেশ কয়েকবার। একদিন মনে হলো, বইটা একটু পড়ি। পৃষ্ঠাগুলো নিউজপৃন্ট হওয়ার কারণে পড়া শুরু করার আগেই আগ্রহ হারিয়ে ফেললাম।
ঘুমানোর পূর্বে গল্প বা উপন্যাসের বই পড়াটা আমার অভ্যাসে পরিনত হয়ে গিয়েছিল। পড়ার মতো নতুন কোনো বই না পেয়ে বাধ্য হয়েই 'আলোর পরশ ' নিয়ে বসলাম। প্রায় পাঁচ শতাধিক পৃষ্ঠার প্রকান্ড ভারী ময়লা মলাটের বইটা মোমবাতির আলোতে পড়া শুরু করলাম। প্রথম কয়েকটি পৃষ্ঠা পড়ার পর মনে হলো অনেক অনেক কঠিন ভাষা প্রয়োগ করা হয়েছে। সেই সময়ে ভাষাজ্ঞান সীমিত থাকায় পড়তে একটু অস্বস্তি হচ্ছিল। আরো কয়েকটি পৃষ্ঠা পড়ার পর প্রচন্ড আগ্রহ অনুভব করলাম। চৌদ্দ শত বছর পূর্বে আরবের আল জাবিল নামক একটি গ্রামের যুবক ও অতি রূপবতী এক যুবতীর অসাধারন দুষ্টামিভরা প্রেমের কথোপোকথনের মাধ্যমে ঘটনা শুরু। আমি মুগ্ধ হয়ে শুধু পড়তেই লাগলাম। প্রায় ৪৫-৫০ পৃষ্ঠা পড়ার পর মোমবাতি শেষ হয়ে এলো। প্রচন্ড কষ্ট পেলাম। অতৃপ্তি, উত্তেজনা এবং সকাল হওয়ার অাকঙ্খা নিয়ে ঘুমাতে গেলাম।
পরের দিন বইটা পড়ে শেষ করে ফেললাম। এতো আগ্রহ নিয়ে আমার জীবনে আমি কোনো বই পড়িনি। বইটা পড়ে শেষ করার পর মনে হয়েছিল, এটাই শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। এই বইটাকে অযত্নে ফেলে রাখার জন্য প্রচুর আফসোস হয়েছিল।
এই উপন্যাসটিতে আছে প্রেম, যুদ্ধ, ভ্রমন, ইতিহাস। একটি প্রেমের গল্প পড়তে পড়তে পাঠক এক অদ্ভূদ জগতে চলে যাবে। কখনো শিহরিত হবে। কখনো ভয়ে শরীর কেপে ওঠবে। কখনো মন পুলকিত হবে। সেই সাথে পাঠক অর্জণ করবে ঐতিহাসিক জ্ঞান। প্রক-ইসলামিক যুগের আরবের এক গ্রামের অনবদ্য প্রেম কাহিনী।
তবে এটাকে শুধুমাত্র প্রেমের উপন্যাস ভেবে থাকলে বিরাট ভুল হবে। শিহরন জাগানো প্রচুর উত্তেজনাকর অনেক বর্ণনা। পাহাড়, মরুভূমি পেরিয়ে জীবন সংগ্রামে বেচেঁ থাকার গল্প। গভীর ঘন জঙ্গলে হারিয়ে যাওয়ার গল্প। সাগর পারি দেওয়া দুর্দান্ত অভিযানের গল্প। আরবে মানুষের নির্মম বর্বরতা, কুসংস্কার এই উপন্যাসটিতে প্রতিফলিত হয়। আরো আছে আরবের বেদুইনদের যাযাবর জীবনের চিত্র ও অনেক অজানা বিষয়। কৃতদাস প্রথার নির্মম পরিনতিতে দাস হয়ে জীবন কাটানোর চিত্র।
সবচেয়ে বড় কথা হলো, এই উপন্যাসটি অনেক বড় উপন্যাস হলেও পড়া শুরু করলে খুব দ্রুত শেষ হয়ে যাবে। গল্পটাকে টেনে বড় করার চেষ্টা করা হয়নি। উপন্যাসটা শেষ হয়েছে একদম ঠিক জায়গাতে এসে। এটাই হলো একটি ভালো উপন্যাসের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য।
এই উপন্যাসটি পড়ার পর লেখক এম এ হাশেম খানের অন্যান্য বই খুজেছিলাম। কিন্তু পাইনি। লেখকের সম্পর্কে সামান্য খোজ খবর নেওয়ার চেষ্টা করেছি। খুব বেশি কিছু জানতে পারিনি। আমরা পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের নিয়ে এতো মাতামাতি করি অথচ আমাদের দেশের এতো গুনী একজন লেখক সম্পর্কে জানি না। ব্যাপারটা খুব দুঃখজনক।
এই বইটির জন্য লেখক বাংলা একডেমি সাহিত্য পুরষ্কার লাভ করেছিলেন। বাংলা একডেমি সাহিত্য পুরষ্কার দেওয়া শুরু করে ১৯৬০ সালে। সেই বছরেই উপন্যাস বিভাগে পুরষ্কারটি তিনি লাভ করেন।
প্রচুর সামাদৃত এই উপন্যাসটি না পড়লে বাংলা সাহিত্যের একজন পাঠক হিসেবে পূর্ণতা পাবেন না। মৃত্যুর আগে এই উপন্যাসটি পড়তে মিস করবেন না। বইটি সম্পর্কে অনলাইনে কোনো রিভিউ খুজে পাইনি। যারা বইটি পড়েছেন তারা দয়া করে রিভিউ দিয়ে পাঠকদের সাহায্য করুন।