মজিদ সাহেব বিছানায় উবু হয়ে শুয়ে আছেন। গত দুই বছর ধরে ভদ্রলোক বিছানায় পিঠ ঠেকিয়ে শোয় না। তার পিঠে একটা ফোড়া হয়েছিল। বাধ্য হয়েই তাকে উবু হয়ে শুতে হয়েছিল তখন। ফোড়া ভাল হয়ে গেছে। কিন্তু এতদিনে তার উবু হয়ে শুয়ে থাকার অভ্যাসটা আর এখনো ঠিক হয়নি।
বিছানা নরম হলে উবু হয়ে শুয়ে বেশ আরাম পাওয়া যায়। বিছানা একটু শক্ত হলেই ঝামেলা।
মজিদ সাহেব চির বেকার একজন মানুষ। চির বেকাররা একটু অলস টাইপের হয়। বেকারত্বের স্বাদ উপভোগ করার জন্য আলসতা প্রয়োজন। তাই বালুর বস্তা হয়ে সে সারাদিন বিছানায় পড়ে থাকে। বাজারে তার ২ ডজন দোকান আছে। তাই মাসের শেষে বালিশের তলায় টাকা চলে আসতে অসুবিধে হয় না।
অচরন বালুর বস্তার মত হলেও আকার অকৃতিতে সে মোটামোটি ছোটখাট একজন তিতুমীর।
মন্টু এসে অনেক্ষন ধরে দাড়িয়ে আছ। ঘুমন্ত বাবার পিঠের দিকে সে চেয়ে আছে। উবু হয়ে শুয়ে থাকার কারণে মজিদ সাহেব চেহারা দেখা যাচ্ছে না। তাই আপাতত পিঠের দিকে চেয়ে থাকা ছাড়া উপায় নাই।
মন্টু খুব মৃদুস্বরে কাশি দিয়ে মজিদ সাহেবকে নিজের উপস্থিতিটা বুঝানোর চেষ্টা করল। কিন্তু সেই কাশির শব্দ মজিদ সাহেবের কানে প্রবেশ করল না। মজিদ সাহেব এখন ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে একটা স্বপ্ন দেখছেন। খুবই অস্থির স্বপ্ন।
মন্টুর কাশির শব্দে তার ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। সেই সাথে স্বপ্নটাও হারিয়ে গেল। মন্টু দ্বিতীয়বার শরীরের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে একটা কাশি দিল। সেই কাশির শব্দে আরেকটু হলে মজিদ সাহেবের কানের পর্দা ফেটে যেত।
মজিদ সাহেব ধরমরিয়ে বিছানায় উঠে বসলেন। তার গুনধর পুত্রেটি সাথে সাথেই তাকে টুক করে একটা সালাম দিয় বসল। এরকম অপ্রত্যাশিত সালামে মজিদ সাহেব কিছুটা বিব্রত।
ছেলের দিকে সে সকরুন দৃষ্টিতে তাকালো। ছেলের মুখটা শুকিয়ে ঝালমুড়ির ঠোঙ্গার মত হয়ে গেছে। শরীরটা শুকিয়ে মটরসুটি হয়ে গেছে। আর চেহারার অবস্থা হয়েছে ঠিক গাজাখোরদের মত। নিজের ছেলেকে নিয়ে এসব ভাবতে তার খারাপ লাগছে। তবে ঘটনা সত্যি।
মন্টুর গালে খোচা খোচা দাড়ি। সে দাত বের করে হাসতে হাসতে বলল, “বাবা, কেমন আছেন?”
ছেলের দিকে তাকিয়ে মজিদ সাহেবের কান্না পাচ্ছে। কান্না লুকানোর জন্য চট করে সে অন্য দিকে মুখটা ফিরিয়ে নিল। চোখের পানি এসে গেলে সর্বনাশ। কঠিন হৃদয়ের এই মানুষটির কোমলতাটা নিজের ছেলের কাছে প্রকাশ পেয়ে যাবে।
অনেক কষ্টে মজিদ সাহেব চোখের পানি দমন করল।
আদর করে ছেলে নাম রেখেছিল মন্নান। এখন সবাই বলে মন্টু। আরো সাতাশ বছর আগের কথা। আশ্বিন মাস। সেদিন আকাশে অনেক বড় একটা চাঁদ উঠেছিল। মজিদ সাহেব অনুভব করেছিল বাবা হওয়ার স্বাদ।
আজও সে একজন বাবা।
মন্টু নীরস গলায় জিজ্ঞাসা করল, "বাবা, কেমন আছেন?"
মজিদ সাহেব কঠিন দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকালো। এই বেহায়া ছেলের গালে ঠাস করে একটা চর মারতে ইচ্ছে হচ্ছে। অনেক কষ্টে সেই ইচ্ছাটাকে দমন করলেন। আজকের দিনে ছেলের গালে সে চর মারতে চায় না। কারণ আজকের দিনে তার দাদু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
মজিদ সাহেব ছেলের হাতে এক হাজার টাকার একটা নোট গুজে দিয়ে বলল, “যা, বৌমার কাছে যা। যদি সুসংবাদ হয় এই টাকা দিয়া মস্টি কিনবি। আমি কালকে সকালে আরো মিস্টি নিয়া আসুম।”
মন্টু কাচুমাচু করতে করতে বলল,”অই বাড়িতে আমি যামু না।”
শ্বশুর বাড়িতে যেতে ছেলে অনীহা প্রকাশ করছে। মজিদ সাহেব আজ আর উত্তেজিত হয়ে কিছু বলল না।
ছেলের দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে বলল, “আজকে তোর যাওয়া উচিত। তোর মা ওই বাড়িতে গেছে। তুই না গেলে মানুষে খারাপ বলবে।”
মন্টু মাথা নিচু করে সম্মতি জানালো। অন্যদিন হলে সে রাজি হতো না। শ্বশুর বাড়িতে বিয়ের পরে সে মাত্র দুইবার গেছে। আজ আবার যাচ্ছে।
রাত হয়ে গেছে। আকাশে আজ অনেক বড় একটা চাঁদ।
মন্টু শ্বশুর বাড়িতে যাওয়ার পর সব ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে বড় শালা হেসে দিয়ে বলল, “দুলাভাই কেমন আছেন?”
মন্টুর মা ছেলেকে দেখে কেঁদে দিয়ে বলল, “বাবা তুই আইছিস? বউমার অবস্থাতো ভালো না। হাসপাতালে নেওয়া লাগবো।”
বাড়ির সবাই খুব ব্যাস্ত। এতিমধ্যেই উঠানে একটা অটোরিক্সা এসে থেমেছে। সুপারি গাছের নিচে দাড়িয়ে মন্টু একটা সিগারেট ধরাল। আকাশের দিকে তাকালো। আকাশে আজ বড় একটা চাঁদ।
মন্টু ঠিক করল, তার যদি ছেলে হয় তবে নাম রাখবে চাঁদ। আর যদি মেয়ে হয় তবে নাম রাখবে জোৎস্না।
ভাবতে খুব ভাল লাগছে।
রীনার অবস্থা নাকি খুব খারাপ। রীনা কি মারা যাবে?
স্ত্রী আজ মরনাপন্ন। কিন্তু মন্টুর তেমন একটা খারাপ লাগছে না। সিগারেটটা সম্পূর্ণ শেষ করার আগেই বাড়ির ভিতর থেকে সে একটা শব্দ শুনতে পেল। সারা শরীরে সে একটা শিহরন অনুভব করল। বাড়ির ভিতর থেকে একটা নবাগত শিশুর ওয়াও ওয়াও চিৎকার ভেসে আসছে।
“জামাই, তোমার ছেলে হইছে।”
মন্টু শুকনো কন্ঠে জিজ্ঞাসা করল, “রিনা কেমন আছে?”
“ভালো।”
মন্টু বাড়ি থেকে বের হয়ে মিস্টি আনার জন্য রওনা হলো। ছোট শালাটা আজান দিতে শুরু করল।
মাদ্রাসায় পড়ে। আজনের সুর ভালোই দিতে পারে।
মিস্টি নিয়ে সে বাড়ি ফিরল ঘন্টা খানেক পর। মন্টুর মা এসে ছেলেকে তার কোলে তুলি দিল। ছেলের দিকে ভালো করে তাকালো মন্টু। ছেলেটা তার দিকে চেয়ে আছে। ঠিক যেন বাবাকে চিনতে পারছে না। মন্টু ছেলেকে কোলে নিয়ে শপথ করল। কি শপথ করল সেটা সেই ভাল জানে।
শ্বশুর মশাই বললেন,”জামাইরে কিছু খাইতে দিছিস?”
রীনাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। সেটা কাউকে বলতে খুব লজ্জা হচ্ছে। বিয়ের এক বছর পর এই প্রথম এটা হচ্ছে।
কিছুক্ষন বাদে ছোট শালী এসে বলল, “রীনা বুবু আপনারে ডাকে।”
রীনার চেহারা মলিন দেখাচ্ছে। এই প্রথম রীনার জন্য মায়া হচ্ছে।
রীনা বলল,“কিছু খাইছো?”
“হুম”
“ছেলেটা দেখতে ঠিক তোমার মতো হইছে।”
মন্টু কিছু বলল না। শুধু চেয়ে রইলো। রীনার মুখে মলিন হাসি।
রাত বাড়ছে।
মন্টু বাইরে এসে দাড়াল।
আকাশে আজ অনেক বড় একটা চাঁদ।